পরিসংখ্যান-মতে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অন্যদের মতোই।
India's Population

সত্য তথ্য বনাম অন্ধ বিশ্বাস

ঐতিহাসিক ভাবে, ভারতীয় উপমহাদেশের অন্য যে কোনও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের তুলনায় মুসলমানদের মধ্যে জন্মহার বেশি ছিল। এমনকি স্বাধীনতার পরেও এই একই প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছে।

Advertisement

শাশ্বত ঘোষ

শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২৩ ০৪:৩৬
Share:

পশ্চিমবঙ্গে ১৯৯২-৯৩ এবং ২০১৯-২১ সালের মধ্যে মুসলমানদের মধ্যে জন্মহার ৪.৬ থেকে কমে ২.০ হয়েছে, হিন্দুদের মধ্যে ২.৫ থেকে কমে হয়েছে ১.৫। ফাইল ছবি।

ভারতের প্রেক্ষাপটে ধর্ম, জনসংখ্যা, জন্মহার ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই একটা সংশয় উপস্থিত হয়— আমরা বৈজ্ঞানিক পন্থায় প্রাপ্ত সমীক্ষার পরিসংখ্যানকে প্রাধান্য দেব, না কি ব্যক্তিগত কিছু বা পর্যবেক্ষণ বা বিশ্বাসকে? জন্মহার বিষয়ে রাজনীতিসঞ্জাত পর্যবেক্ষণ থেকে কিছু বিশ্বাস ভারতে প্রবল, বৈজ্ঞানিক পরিসংখ্যানের বিচার-বিশ্লেষণে যার সমর্থন মেলে না। যেমন, হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের মধ্যে জন্মহার বেশি, ফলে ক্রমে মুসলমানরাই ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠবে; মুসলমানদের মধ্যে গর্ভনিরোধক পদ্ধতির ব্যবহার কম, কারণ ইসলাম গর্ভনিরোধক পদ্ধতি ব্যবহার অনুমোদন করে না; বহুবিবাহের কারণে মুসলমানদের মধ্যে জন্মহার অন্যান্য সম্প্রদায়ের তুলনায় বেশি; এবং, বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবল মুসলমান অনুপ্রবেশ ঘটছে।

Advertisement

ঐতিহাসিক ভাবে, ভারতীয় উপমহাদেশের অন্য যে কোনও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের তুলনায় মুসলমানদের মধ্যে জন্মহার বেশি ছিল। এমনকি স্বাধীনতার পরেও এই একই প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছে। যেমন, ১৯৯২-৯৩ সালে সমস্ত ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে মুসলিমদের জন্মহার— অর্থাৎ, মহিলা-পিছু সন্তানসংখ্যা— ছিল ৪.৪, যা ছিল সর্বাধিক। এই সময় হিন্দুদের মধ্যে জন্মহার ছিল ৩.৩। কিন্তু একই সঙ্গে এ কথাও উল্লেখ্য যে, গত ত্রিশ বছরে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত জন্মহার হ্রাস পেয়েছে মুসলমানদের মধ্যেই। মুসলমানদের মধ্যে জন্মহার ১৯৯২-৯৩ এবং ২০১৯-২১ সালের মধ্যে ৪.৪ থেকে ২.৪-এ নেমে এসেছে। একই সময়ে হিন্দুদের মধ্যে জন্মহার ৩.৩ থেকে কমে ১.৯ হয়েছে। অর্থাৎ, একই সময়কালে মুসলমানদের ক্ষেত্রে জন্মহার হ্রাস পেয়েছে ৪৬.৫%, হিন্দুদের ক্ষেত্রে ৪১.২%। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৯২-৯৩ এবং ২০১৯-২১ সালের মধ্যে মুসলমানদের মধ্যে জন্মহার ৪.৬ থেকে কমে ২.০ হয়েছে, হিন্দুদের মধ্যে ২.৫ থেকে কমে হয়েছে ১.৫। অর্থাৎ, এই সময়কালে মুসলমানদের জন্মহার কমেছে ৫৫.৮%, হিন্দুদের ৪১.৭%।

যদিও হিন্দুদের মধ্যে জন্মহার হ্রাসের প্রবণতা মুসলমানদের তুলনায় বেশ কিছুটা আগে শুরু হয়েছিল, কিন্তু গত তিন দশকে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের মধ্যে জন্মহার কমার গতি এতটাই বেশি ছিল যে, দুই ধর্মের মধ্যে জন্মহারের পার্থক্য কমে আসার প্রক্রিয়াটি স্পষ্টতই শুরু হয়েছে। জন্মহারের অভিক্ষেপ অনুযায়ী, আগামী ১০ বছরের মধ্যে এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হবে, অর্থাৎ হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে জন্মহারে আর পার্থক্য থাকবে না। তাই জন্মহারের পরিবর্তনের গতিপথের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে বা পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের জনসংখ্যার আকারে (বা শতাংশে) হিন্দুদের ছাড়িয়ে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। ২০১৯-২১ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, হিন্দুদের মধ্যে জন্মহার পশ্চিমবঙ্গের সব জেলায় প্রতিস্থাপনযোগ্য স্তরের (মহিলা-পিছু সন্তান সংখ্যা ২.১ বা তার কম, যে স্তরে জনসংখ্যা স্থিতিশীল হয়) নীচে চলে গিয়েছে, এবং মুসলমানদের ক্ষেত্রেও ১৫টি জেলায় এই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই সম্পন্ন। উত্তর দিনাজপুরে মুসলমানদের মধ্যে জন্মহার ৩-এর বেশি; কিন্তু তার কারণ ধর্ম নয়, ওই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অনুন্নয়ন।

Advertisement

সাধারণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, নারীশিক্ষা ও ক্ষমতায়ন ইত্যাদি ছাড়াও ভারতে জন্মহার হ্রাসের অন্যতম প্রধান কারণ হল গর্ভনিরোধক পদ্ধতির ব্যবহার। অধিকাংশ ইসলামিক গবেষক বলেছেন যে, মুসলমানদের মধ্যে গর্ভনিরোধক ব্যবহারে কোনও সমস্যা নেই। ভারতীয় গবেষকদের মতে, ভারতে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে গর্ভনিরোধক পদ্ধতির গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান মূলত স্থানীয় স্তরে মৌলবিদের করা ধর্মীয় পাঠ্যের ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করে। কারণ, সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামীণ স্বল্পশিক্ষিত মুসলমান মূল ধর্মগ্রন্থগুলি সে ভাবে পড়েননি। ভারতে প্রজননক্ষম বয়সের মহিলাদের মধ্যে গর্ভনিরোধক পদ্ধতির ব্যবহার ১৯৯২-৯৩ থেকে ২০১৯-২১’এর মধ্যে ৪০% থেকে বেড়ে প্রায় ৬৭% হয়েছে। ভারতে ১৯৯২-৯৩ সালে হিন্দুদের মধ্যে গর্ভনিরোধক ব্যবহার ছিল ৪২%, মুসলমানদের মধ্যে যা ছিল মাত্র ২৭%। ২০১৯-২১ সালে তা হিন্দুদের মধ্যে ৬৮% ও মুসলমানদের মধ্যে ৬০% হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে ১৯৯২-৯৩ সালে গর্ভনিরোধক পদ্ধতির ব্যবহার হিন্দুদের মধ্যে ছিল প্রায় ৩৭%, মুসলমানদের মধ্যে মাত্র ১৬%। ২০১৯-২১ সালে, এ-হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৭৫ ও ৭৩%। বড় রাজ্যগুলোতে বসবাসকারী সমস্ত মুসলমানের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের গর্ভনিরোধক পদ্ধতির ব্যবহার সর্বোচ্চ। আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানও একই সাক্ষ্য দিচ্ছে। বাংলাদেশ, টিউনিসিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ইরানের মতো বহু মুসলিম-প্রধান দেশে জন্মহার প্রতিস্থাপনযোগ্য স্তরে বা তার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। ইসলাম গর্ভনিরোধকের বিরোধী হলে এই প্রবণতা দেখা যেত না।

ভারতীয়দের মধ্যে বহুবিবাহ একেবারেই বলার মতো ঘটনা নয়। ২০১৯-২১ সালের জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে দুই শতাংশেরও কম মহিলা জানিয়েছেন যে, তাঁদের স্বামীদের অন্য স্ত্রী আছে। হিন্দু মহিলাদের মধ্যে ১.৪% এমন রিপোর্ট করেছেন, মুসলিম মহিলাদের মধ্যে প্রায় ২%। পশ্চিমবঙ্গে এই অনুপাত দু’টি যথাক্রমে ১.৫% ও ২.৮%। মুসলিম মহিলাদের এমন রিপোর্টিং যদিও হিন্দু মহিলাদের তুলনায় বেশি, কিন্তু ততটা বেশি নয় যে, তা দেশ বা রাজ্যের জনবিন্যাসকে উলটপালট করে দিতে পারে।

অনুপ্রবেশ বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন। ২০১৬ সালে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মতে, ভারতে অনুপ্রবেশের সময় মোট ১৬০১ জন বাংলাদেশি ধরা পড়েছিল। ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে সেই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৯০৭ এবং ৮৮৪। ২০১৯ সালে সংখ্যাটি সামান্য বেড়ে হয় ১১০৯, ২০২০ সালে ৯৫৫। বিএসএফ-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের এপ্রিল অবধি বাংলাদেশ থেকে ভারতে বেআইনি ভাবে সীমান্ত অতিক্রম করার সময় মোট ১৪,৩৬১ জনকে আটক করা হয়। তাঁরা কোন ধর্মের, রিপোর্টে তার উল্লেখ নেই। কিন্তু, এ কথা বোঝা সম্ভব যে, এই সংখ্যাগুলি যথাযথ নয়, কারণ দক্ষিণবঙ্গে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তেঅন্তত ৫০ শতাংশ এলাকায় হয় কাঁটাতার নেই, অথবা নদী আছে। ধরে নেওয়া যায়, প্রকৃত অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা রিপোর্টে উল্লিখিত সংখ্যার দশ গুণ, এবং তাঁরা সবাই মুসলমান। কিন্তু, তা হলেও এই অনুপ্রবেশ কি দশ কোটির বেশি জনসংখ্যার পশ্চিমবঙ্গের জনবিন্যাসে কোনও দাগ কাটতে পারে?

বাস্তবে অন্য একটি ব্যাপার বরং লক্ষণীয়। তা হল বাংলাদেশ থেকে হিন্দু জনসংখ্যা ক্রমাগত কমে যাওয়ার ঘটনা। ১৯৭৪ সালে সে দেশের জনসংখ্যায় হিন্দুরা ছিল ১৩.৫%, ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮.০%। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে গবেষণাকারীরা যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন যে, পার্শ্ববর্তী দেশে অভিবাসন এবং কম জন্মহার ছাড়াও বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে নবজাতক মৃত্যুর হার মুসলমানদের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বরকতের মতে, ‘শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি আইন’-এর কারণে অনেক হিন্দু সর্বস্ব খুইয়ে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন, এবং এই ঘটনার সিংহভাগ ঘটেছে গ্রামের দুর্বল হিন্দুদের ক্ষেত্রে। তাঁরা কোথায় গিয়েছেন, তা সহজেই অনুমেয়। এর মানে অবশ্যই এই নয় যে, এর পাল্টা হিসাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী মুসলমানদের বাংলাদেশে চলে যেতে বাধ্য করা হবে।

সুতরাং, যদি কেউ বলেন যে, মুসলমানমাত্রেরই কমপক্ষে ৪-৫টি সন্তান, বা বেশির ভাগ মুসলমানই চারটি বিয়ে করে, টিকিয়াপাড়া থেকে উলুবেড়িয়া রেললাইনের পাশে নবনির্মিত বস্তিগুলিতে রোহিঙ্গা মুসলমান গিজগিজ করছে ইত্যাদি, সে সব কথার কোনও বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি নেই। সেগুলো চোখের দেখাকেই পরিসংখ্যান হিসাবে ধরে নেওয়ার ভ্রান্ত প্রবণতা, হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি প্রদত্ত জ্ঞান, অথবা নিতান্তই ব্যক্তিগত বিদ্বেষ। আশ্চর্যের কথা হল, ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে এই বৈজ্ঞানিক উপায়ে সংগৃহীত তথ্যকে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কোনও প্রচেষ্টা চোখে পড়ে না। হয় তারা এই তথ্যগুলো জানে না, বা জানলেও ‘ভোট-ব্যাঙ্ক’ রাজনীতির কারণে চুপ করে থাকে। এ ক্ষেত্রে উদারপন্থী ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সামাজিক সংগঠনগুলোকে দায়িত্ব নিতে হবে, যাতে এই তথ্য-পরিসংখ্যান জনগণের কাছে পৌঁছয়, যাতে এই ধর্মনিরপেক্ষ দেশে ধর্মীয় লাইনে জনগোষ্ঠীর মধ্যে অপ্রয়োজনীয় বিভাজন রোখা যায়।

ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement