—প্রতীকী ছবি।
অর্থনীতিবিদ তোমা পিকেটি এবং তাঁর সহগবেষক নীতিন কুমার ভারতী, লুকাস চ্যান্সেল, এবং আনমোল সোমাঞ্চি গত মাসে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন, যার নাম: “ভারতে আয় ও সম্পদের অসাম্য, ১৯২২-২০২৩: বিলিয়নেয়ার রাজের উত্থান।” তাঁরা দেখাচ্ছেন যে, ২০২২-২৩ সালে আয়ের নিরিখে জনসংখ্যার ধনীতম এক শতাংশ মোট আয়ের ২৩% অর্জন করেছেন, আর বিত্তের হিসাবে ধনীতম এক শতাংশ মোট সম্পদের ৪০%-এর মালিক। শুধু গত এক শতকের পরিপ্রেক্ষিতেই বর্তমান ভারতে অসাম্যের মাত্রা সর্বাধিক নয়, সারা বিশ্বের নিরিখেও ভারত এখন অসাম্যের নিক্তিতে একদম প্রথম সারিতে। উদারীকরণের সময় থেকেই অসাম্যের এই ঊর্ধ্বগামী প্রবণতা সুস্পষ্ট— ডলারের মূল্যে বিলিয়নেয়ার, অর্থাৎ একশো কোটি ডলারের মালিকের সংখ্যা ১৯৯১ সালে ছিল এক, ২০২২ সালে হয়েছে ১৬২। আজ বিলিয়নেয়ার মানে অন্তত ৮০০০ কোটির টাকার মালিক।
অসাম্যের প্রসঙ্গে যে বিতর্ক তৈরি হয়, তাকে প্রধানত তিনটে ভাগে ভাগ করা যায়: নীতিগত, চরিত্রগত, ও ব্যবহারিক কৌশলগত। নীতিগত প্রশ্ন হল, অসাম্য কি মৌলিক ভাবেই অবাঞ্ছিত, না কি অন্তত আংশিক ভাবে সহনীয়? সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার পঙ্ক্তিতে এই প্রসঙ্গে বামপন্থীদের মনোভাব ধরা যেতে পারে: “বলতে পারো বড়মানুষ মোটর কেন চড়বে? গরীব কেন সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে?” আবার দক্ষিণপন্থীদের মত হল, মানুষের মেধা, কর্মদক্ষতা, বা অন্যান্য গুণের মতো আয় বা সম্পদের অসাম্যও অন্তত খানিকটা মাত্রায় স্বাভাবিক এবং তা মেনে নেওয়াই ভাল। তবে, অসাম্যের ধারণাটির মধ্যে যে আপেক্ষিক তুলনা আছে, তা ছেড়ে এই আলোচনায় দারিদ্র বা বঞ্চনা যে অবাঞ্ছনীয় তা নিয়ে বিতর্ক কম। আসল কথা হল, বড়লোকের গাড়ি থাকাটা সমস্যা নয়, সমস্যা হল গরিবের তার তলায় চাপা পড়া।
অসাম্য কি সুযোগের, না ফলাফলের? এটা অসাম্যের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন। যে বেশি পরিশ্রম করে বা বেশি উদ্যমী, সে বেশি রোজগার করলে সমস্যা কোথায়? ধরে নেওয়া যাক যে, অন্তত কিছুটা মাত্রায় ফলাফলের অসাম্য অবধারিত; এবং সরকার যদি করব্যবস্থার (বা প্রত্যক্ষ পুনর্বণ্টনের) মাধ্যমে সেই অসাম্য দূর করে সমতা আনার জন্য অত্যুৎসাহী হয়, তবে লোকে কাজ করার, উদ্যোগ করার, নতুন কিছু উদ্ভাবন করার উদ্যম হারাবে। তা হলেও প্রশ্ন থেকে যায়— যারা সুযোগ পাচ্ছে, তারাই কি সবচেয়ে যোগ্য, সবচেয়ে দক্ষ, সবচেয়ে প্রতিভাবান? অর্থাৎ, প্রশ্নটি মেধাতন্ত্রের। কে অস্বীকার করতে পারে যে, দারিদ্রের কারণে কত মানুষের স্বাভাবিক দক্ষতার বিকাশের সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়? আবার একই ভাবে উল্টো দিকে তুলনায় গুণহীন কেউ বিত্তবান পরিবারে জন্মের ফলে সমস্ত রকম সুযোগ পেয়ে কোনও পেশার বা ক্ষমতাশীল আসনের সর্বোচ্চ স্তরে ওঠে, তেমন উদাহরণও প্রচুর। এই দুই ভাবেই সুযোগের অসাম্যের কারণে যোগ্যতা আর ফলাফলের মধ্যে ফারাক থেকে যায় এবং তাই সুযোগের প্রসারের জন্যে করব্যবস্থার মাধ্যমে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগের স্বপক্ষে যুক্তিটি জোরদার।
যদি মেনেও নেওয়া হয় যে, খানিকটা অসাম্য অনিবার্য হলেও তা মূলত অবাঞ্ছিত এবং সুযোগের অসাম্যের সমস্যাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা হলেও তা নিয়ে কী করা যেতে পারে? এটা ব্যবহারিক কৌশলের প্রশ্ন। আমূল সমাজ পরিবর্তন যদি সম্ভাবনার তালিকায় না থাকে, তা হলে হাতে থাকে করব্যবস্থা, আইনকানুন, এবং নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা। এখানে বিতর্কটা বেশ জমে ওঠে। পিকেটি ও তাঁর সহগবেষকদের গবেষণাপত্রটির বিপক্ষে যে বক্তব্যগুলো এসেছে, তার মোদ্দা কথা হল, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সঙ্গে যেমন দারিদ্র কমে, তেমনই অসাম্যও বাড়ে, কারণ বৃদ্ধির ফলে অর্থনৈতিক সুযোগের যে প্রসার হয়, তার সদ্ব্যবহার করার ক্ষমতা বিত্তবান শ্রেণির বেশি। অতএব, বৃদ্ধি চাইলে অসাম্যকেও মেনে নিতে হবে। এই যুক্তি বলে যে, বৃদ্ধির কারণে অর্থনৈতিক সুযোগের বিস্তার হয়, যার ফলে শ্রমের বাজারে মজুরি ও আয় বাড়ে, এবং রাজকোষের আয়তন বৃদ্ধি হয়, যার থেকে নানা জনকল্যাণমূলক নীতির উপরে ব্যয়ের ক্ষমতা বাড়ে। শুধু অসাম্যের বৃদ্ধির দিকে তাকিয়ে উদারীকরণ-পূর্ব জমানার প্রতি স্মৃতিমেদুরতায় ভুগলে চলবে না, কারণ সেই সময় অসাম্য তুলনায় কম ছিল ঠিকই, কিন্তু মাথাপিছু জাতীয় আয় ও তার বৃদ্ধির হারও কম ছিল, আর দারিদ্র ছিল অনেকটা বেশি।
আর্থিক বৃদ্ধির প্রক্রিয়ার সুফল যদি সমস্ত শ্রেণির মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে— যাকে সর্বজনীন বৃদ্ধি বলা হয়ে থাকে— তা হলে উপরের যুক্তিটি বৈধ। এর নানা মাপকাঠি আছে। যেমন, দেখতে হবে যে, অসাম্য সত্ত্বেও দরিদ্রতর শ্রেণিগুলির আয় বৃদ্ধি যথেষ্ট হারে হচ্ছে কি না; শ্রমের বাজারে কর্মসংস্থান ও মজুরি যথেষ্ট হারে বাড়ছে কি না; করব্যবস্থা প্রগতিশীল কি না; এবং যে যে খাতে সরকারি বিনিয়োগ থেকে দরিদ্ররা সবচেয়ে লাভবান হন, সেগুলোর আপেক্ষিক গুরুত্ব বাড়ছে কি না।
আমার নিজস্ব গবেষণা থেকে দেখতে পাচ্ছি যে, উদারীকরণ-পরবর্তী জমানায় আয়ের নিরিখে শীর্ষ ১% এবং ১০% গোষ্ঠীর আয় গড় বৃদ্ধির হারের চেয়ে অধিকতর হারে বেড়েছে। শুধু তা-ই নয়, নিম্ন ৫০% এবং মধ্যবর্তী ৪০%-এর বৃদ্ধির হার কাছাকাছি ছিল, এবং দুটোই ছিল গড় বৃদ্ধির হারের নীচে। মনে রাখতে হবে যে, দরিদ্র শ্রেণির আয় যে-হেতু কম, তাই শতকরা হারের হিসাবে তা বাড়া তুলনায় সোজা। সেখানে যদি বিত্তবান শ্রেণির আয় বেশি হারে বাড়ে, তা হলে অসাম্য— যার মাত্রা এখনই উদ্বেগজনক অবস্থায়— তা সময়ের সঙ্গে আরও বাড়তেই থাকবে। বিশ্বের সর্বত্রই এক অবস্থা, তা কিন্তু নয়। যেমন, উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, চিনের গড় আয়বৃদ্ধির হারের তুলনায় শীর্ষ ১% এবং ১০% গোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধির হারের তফাত ভারতের মতোই, কিন্তু মধ্যবর্তী ৪০% এবং নিম্নতম ৫০% গোষ্ঠীর আয় গড় বৃদ্ধির হারের তুলনায় ভারতের থেকে অনেকটা বেশি হারে বেড়েছে।
শ্রমের বাজার নিয়ে এই পাতায় একটি লেখায় দেখিয়েছি যে, দেশের সার্বিক আয়বৃদ্ধির তুলনায় শ্রমের বাজারে কাজের গুণগত মান ও মজুরির বর্তমান চিত্রটি যথেষ্ট উদ্বেগজনক (‘কাজের বাজারে অন্ধকার’, ১-৩)। কোনও শ্রমিক নিয়োগ না করা স্বনিযুক্ত কর্মী, ঠিকা শ্রমিক ও অবৈতনিক পারিবারিক শ্রমে নিযুক্ত কর্মীরা দেশের মোট কর্মরত জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশ এবং গত এক দশকে মোট কর্মরত জনসংখ্যায় এদের অনুপাত বেড়েছে। মজুরির দিক থেকে দেখলেও, দেশের সার্বিক আয়বৃদ্ধির তুলনায় শ্রমজীবী শ্রেণির গড় প্রকৃত আয়ের বৃদ্ধির হার নেহাতই অকিঞ্চিৎকর। তাই শ্রমের বাজার থেকেও যে ছবি ফুটে উঠছে তাতে বৃদ্ধির প্রক্রিয়া থেকে দরিদ্রতর শ্রেণিও যথেষ্ট উপকৃত হচ্ছেন, এই যুক্তিটি এখানে খাটছে না।
কেন্দ্রীয় সরকারের কর রাজস্বের ১৭% আসছে জিএসটি এবং অন্যান্য পরোক্ষ কর থেকে, আয়কর থেকে আসছে ১৫% আর কর্পোরেশন কর থেকে আসছে ১৫%। মনে রাখতে হবে, জিএসটি-র দুই-তৃতীয়াংশ আসে জনসংখ্যার দরিদ্রতম ৫০ শতাংশের কাছ থেকে, এক-তৃতীয়াংশ মধ্যবর্তী ৪০ শতাংশ থেকে, এবং শুধুমাত্র ৩-৪ শতাংশ আসে শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনীদের থেকে। সম্পদের উপরে কর তুলে দেওয়া হয়েছে ২০১৬ সাল থেকে। ভারতের মতো দেশে, যেখানে জনসংখ্যার ৯০%-এর বেশি আয়করের আওতার বাইরে, সেখানে করসংগ্রহের প্রক্রিয়াটি সহজ নয় ঠিকই, তবুও করব্যবস্থার যে ছবিটা ফুটে উঠছে, তাকে ‘প্রগতিশীল’ বলা যায় না।
২০১৪ সাল থেকে জাতীয় আয়ের অনুপাতে শিক্ষার ক্ষেত্রে বরাদ্দের হার ধারাবাহিক ভাবে নিম্নগামী। স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বরাদ্দের হার খানিকটা বেড়েছিল ২০১৭ থেকে ২০২১ অবধি। কিন্তু তার পর থেকে সে হারও নিম্নমুখী, এখন তা ২০১৪ সালের বরাদ্দের হারের থেকে সামান্যই বেশি। তবে, অতিমারির সময় থেকে রেশনব্যবস্থায় বরাদ্দ খানিকটা বেড়েছে, যেমন তা বেড়েছে আবাসন, এবং পানীয় জল খাতেও। দেরিতে হলেও এবং আংশিক হলেও সরকারি নীতির এই জনকল্যাণমুখী-অভিমুখ কাম্য। কিন্তু সার্বিক যে ছবিটা ফুটে উঠছে তা আশাজনক নয়।
করব্যবস্থা যথেষ্ট প্রগতিশীল নয় বলেই যে অতিধনীরা লাভবান হয়ে থাকেন, শুধু তা নয়। সাম্প্রতিক নির্বাচনী বন্ড-কাণ্ডে এটা স্পষ্ট যে, তাঁরা রাজনৈতিক ভাবে সক্রিয় এবং নানা ভাবে সরকারি নীতির উপরে নিজেদের সুবিধার্থে তাঁরা প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলেন। সব মিলিয়ে, সর্বজনীন বৃদ্ধির কারণেই আর্থিক অসাম্য মানতে হবে, এই যুক্তিটি নিতান্ত অচল।