—ফাইল চিত্র।
উনি হঠাৎই শুরু করলেন নিউ ইয়র্কের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং-এর কথা। ১০২ তলা ওই সু-উচ্চ অট্টালিকা দীর্ঘ দিন বিশ্বের উচ্চতম শিরোপায় ভূষিত থাকলেও এখন তার স্থান ৫৪তম। তবু আমার নির্মাণ-প্রযুক্তিবিদ বন্ধু শেষ বিকেলে তিন তলার বাইরের বারান্দায় বসে চা-পানের আলাপনে তার প্রসঙ্গ শুরু করলে অবাক হওয়ার কথা। বন্ধু বললেন যে, শুধু উচ্চতার জন্য নয়, এই ১০২ তলা বাড়িটি আজ থেকে ৯৩ বছর আগে, ১৯৩০ সালে নির্মাণ শুরু হয়েছিল এবং বিশ্বের উচ্চতম অট্টালিকা তৈরি হয়েছিল মাত্র ১ বছর ৪৫ দিনে।
আবার বলি, ১০২ তলা বাড়ি প্রায় একশো বছর আগে তৈরি হচ্ছে মাত্র ১ বছর ৪৫ দিনে। অট্টালিকাটি নির্মাণ হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত মহানগর নিউ ইয়র্কের কেন্দ্র অঞ্চলে। এর চার ধারেই অনেক বড় বড় বাড়ি, ব্যবসাবাণিজ্যের ব্যস্ততম কেন্দ্র, একেবারে মহানগরের প্রধান রাজপথের উপর সেই নির্মাণস্থল। সুতরাং রাজপথ বন্ধ করা যাবে না, চার পাশেই গুরুত্বপূর্ণ অফিস দোকান ইত্যাদির ফলে নির্মাণের মালপত্র রাখার স্থান নেই বললেই চলে। তবু সেখানেই অবিশ্বাস্য গতিতে নির্মিত হয়ে গেল এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং।
বন্ধুর বাড়ির সামনে নাতিপ্রশস্ত একটি পথের ওপারেই রয়েছে ছোট একটি পার্ক, যেখানে এলাকার শিশু, কিশোর-কিশোরীরা খেলাধুলা করে, ক্যারাটে শেখে। আর পার্কের পরই রয়েছে একটি সুন্দর জলাশয়, স্থানীয় কথায় লেক। তিন তলার বাইরের বারান্দায় বসে সেই দৃশ্য আস্বাদন এখন মাস আড়াই বন্ধ। পাড়ার খুদেদের খেলা বন্ধ, অন্যান্যের সকাল বা সন্ধ্যার হাঁটাহাঁটি, একটু পার্কের বেঞ্চে বসা, জলাশয়ের স্নিগ্ধ বায়ু সেবন সব বন্ধ। কারণ ওই পার্কে হবে শারদোৎসব, তৈরি হচ্ছে দারুণ থিমের মণ্ডপ, গড়া হচ্ছে প্রতিমা। আর এ জন্য সময় লাগবে প্রায় মাস আড়াই, ফলে বাঁশের ত্রিপলের এক উঁচু ধূসর প্রাকার বানিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে সেই পার্ক। অদৃশ্য হয়েছে জলাশয় অনেক বাতায়ন থেকেই। চার-পাঁচ দিনের পুজোর জন্য তিন মাসের শাস্তি। সে জন্যই মনে হল এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং-এর কথা। একশো বছর আগে ১০২ তলা বাড়ি হয়ে যায় ১ বছর ৪৫ দিনে আর একবিংশ শতাব্দীতে পুজোর প্যান্ডেল করতে তিন মাস! পুজোর সময় পরিবেশ নিয়ে কিছু আলোচনা হয়, বিসর্জন নিয়েও। কিন্তু প্রাক্-পুজো সময় থেকেই শুরু হয়ে যায় যে পরিবেশের বিসর্জন— তাতে আমাদের খেয়াল নেই।
নাগরিকদের জীবনযাপনের এই সব কিছু অধিকার অহেতুক হরণ করার নতুন উৎসব খুঁটিপুজো। এক সময় মহালয়ার ক’দিন আগে দৈনিক পত্রিকায় বাটা কোম্পানির পৃষ্ঠা জুড়ে জুতার বিজ্ঞাপন ছাপা হলে প্রাক্-পুজো সিজ়ন শুরু হত। এখন রথযাত্রার দিনে, ভরা বর্ষায়, শুরু হয়ে যাবে খুঁটিপুজো, মানে প্রাক্-পুজো সিজ়ন শুরু হল। দেবদেবীদের বিশাল দলে যেমন স্রষ্টা ব্রহ্মা আছেন, তেমনই ধ্বংসের জন্য আছেন রুদ্র শিব। আমাদের খুঁটিদেব মাঠ ধ্বংসের দেবতা। বর্ষার নরম মাঠে তিনি তাঁর অভিযান শুরু করেন। পাড়ায় পাড়ায় তাঁর অভিযানের ছবি বেরোয় সব দৈনিক পত্রিকায়। এ বার আমাদের খেলার মাঠ, পাড়ার কোণের পার্ক, একটু স্বস্তির ফাঁকা জায়গা সব এখন দখল হয়ে যাবে পুজোর দাদাদের কল্যাণে। শুধু পাড়ার মাঠ কেন, অনেক ইস্কুলের মাঠে প্যান্ডেলের কাজ শুরু হয়ে যাবে কিছু দিন পরেই। সুতরাং ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা বন্ধ, একটু ফাঁকা জায়গায় চলাচল বন্ধ থাকবে মাস দুয়েক। বিভিন্ন জায়গায় আটকে যাবে পথ, এ দিক ও দিক দুর্ভেদ্য ফ্লেক্সের বিজ্ঞাপনে আটকে যাবে হাওয়া আর আকাশের মুখ আর সেখানের বসবাসকারীদের দু’মাস ধরে সহ্য করতে হবে উৎসবের এই দূষণ। শহর থেকে বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ুন একটু আধা শহর আধা গ্রামে— দেখবেন ভীষণ নির্মাণকার্য শুরু হয়ে গেছে ফুটবল খেলার মাঠে মাঠে। একটু হাওয়া খেলবার, সন্ধেয় একটু মাঠের পাশে বসবার, একেবারে কচিকাঁচাদের বিকেলে যা খুশি করবার— সব কেড়ে নিয়ে গেছেন ওই খুঁটিবাবা। আনন্দবাজারের (১৫/৯) প্রতিবেদনে জানা গেল এ বার নাকি ইউনেস্কোর পুরস্কার পাওয়ার জন্য সব কিছু প্রস্তুত রাখতে হবে পুজো শুরুর দু’সপ্তাহ আগেই। সুতরাং আরও বেশি দিন মাঠ রাস্তা দখলের নৈতিক অনুমতি পাওয়া গেল।
ফিরে আসি এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং-এর কথায়। এত কম সময়ে এত বড় নির্মাণ সম্ভব হয়েছিল কুশলী পরিকল্পনার জন্য। বাড়ি নির্মাণের বিভিন্ন জিনিস বানানো হচ্ছিল বিভিন্ন স্থানে, ইস্পাত আসছে সাড়ে তিনশো কিলোমিটার দূরে নদীপথে পেনসিলভেনিয়া থেকে, বা শ্বেত পাথর আসছে ইটালি থেকে। সেগুলিকে এ রকম পরিকল্পনার মাধ্যমে আনা হচ্ছিল যে বন্দরে সেগুলি এলেই পাঠানো হচ্ছিল নির্মাণস্থলে, আর সেখানে আনা মাত্র সঙ্গে সঙ্গে কাজে লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। ফলে সময় বাঁচছিল অনেক আর কোনও জিনিস জমিয়ে রাখার প্রয়োজন হচ্ছিল না। অনেক শ্রমিককে এক সঙ্গে কাজে লাগিয়ে মাত্র দশ দিনে চোদ্দো তলার উপকাঠামো নির্মাণ সম্ভব হয়েছিল। যখন এই মহাযজ্ঞ চলছে তখন পাশের রাজপথে যানবাহন চলছে রোজকার মতোই। তা হলে শারদোৎসবের এই মহাযজ্ঞ করতে কেন এত দিন লাগবে?
না, পরিবেশ উন্নয়নের জন্য কেবল ঘটপুজো করে চার দিন ধরে পাড়ায় পাড়ায় গাছ লাগাতে বলছি না। বরং থিমপুজো খুব ভাল লাগে। সেই কুমোরটুলির ‘ট্র্যাডিশনাল’ মূর্তি আর পাড়ার ডেকরেটরের প্যান্ডেলের পর এখন থিম এনেছে কত শিল্প ভাবনার প্রবাহ। আর্ট কলেজের শিল্পীরা পুরনো ট্র্যাডিশন ভেঙে উন্মুক্ত করেছেন বৈচিত্রের ফোয়ারা। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে নেমে পড়েছেন শিল্পীর দল, এ ভাবেই থিমেরা ছড়িয়ে যাচ্ছে অসীমে, কিন্তু দাবি করছে অনেকটা ভূমি আর অনেকটা সময়। আগে মহালয়ার দিন বাঁশ পড়ত মাঠে, তার পর সাত দিনে, সপ্তমীর সকালে প্যান্ডেল তৈরি। এখন পাঁচ দিনের উৎসবের জন্য দু’মাস আমাদের ঢুকে পড়তে হয় গহ্বরে। আমাদের পরিবেশ চলে যায় থিমেদের হাতে। আমাদের আবার ফিরিয়ে আনতে হবে সেই সাত দিনের পুজার আনন্দের পরিবেশ। এর জন্য নতুন চিন্তার আবাহন করতে হবে নির্মাণ পদ্ধতিতে।
কারখানা গড়তে বিশেষ পরিবেশ অনুমতি লাগে। তাতে বলা থাকে যে কারখানার এক-তৃতীয়াংশে বৃক্ষরোপণ করতে হবে, এ ছাড়া অন্যান্য দূষণ নিয়ন্ত্রণের যন্ত্রপাতি লাগানোর কথা থাকেই। পুজোর ক্ষেত্রেও সে রকম নিয়ম বেঁধে দিতে হবে যে এক সপ্তাহের মধ্যে পুজোর মণ্ডপ ও অন্যান্য সাজসজ্জা শেষ করতে হবে এবং দশমীর তিন দিন পরেই সব নির্মাণ খুলে নিতে হবে। সম্পূর্ণ পথ বন্ধ করে কিছু করা যাবে না। থিমের পরিকল্পনা সে ভাবে করতে হবে। এ জন্য প্যান্ডেল সজ্জার অনেক কিছু বাইরে বানিয়ে তার পর পুজোর স্থানে এনে সংযোজিত করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন হবে নতুন ধরনের নির্মাণ সামগ্রী, নতুন নির্মাণ পদ্ধতি ইত্যাদি। ঠিক যেমন আর্ট কলেজের প্রশিক্ষিত শিল্পীরা থিমে বিপ্লব এনেছেন, এ বার এই নির্মাণ কর্মে নতুন ভাবনা দিতে আসতে হবে রাজ্যের প্রযুক্তি বিদ্যার শিক্ষক ছাত্রদের। কুমোরটুলির মতন গড়ে উঠবে মণ্ডপ বানানোর অনেক কর্মশালা। প্রায় তৈরি মণ্ডপ এনে শুধু পুজো প্রাঙ্গণে জোড়া লাগানো হবে। মুক্ত থাকবে খেলার মাঠ, বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ, রাজপথ থেকে পাড়ার উপপথ। বলছি সাত দিনে, মনে হয় হয়তো আরও কম দিনেই সম্ভব।
এ সবের বাইরেও একটি পরিবেশ আছে। মানব পরিবেশ। কলকাতা শহর ও শহরতলিতে এই থিম পুজোর অঙ্গসজ্জা, প্যান্ডেল গড়া ইত্যাদি অনেক কাজে বিশ ত্রিশ হাজার লোক দু’তিন মাস শহরে থাকেন। এঁরা কি ঠিক ভাবে থাকেন? এঁদের প্রাতঃকৃত্যাদির জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকে কি? কিংবা স্নানের, রান্না করার? অনেক শিশু কাজ করে, তা কি আইনসম্মত? যাঁরা অনেক উঁচু জায়গায় কাজ করেন তাঁদের নিরাপত্তার কি কোনও ব্যবস্থা থাকে? তাঁদের কি বিমা করা হয়? এঁরা কি ন্যূনতম মজুরি পান? পুরসভা, মিউনিসিপ্যালিটি, পরিবেশ দফতর, শ্রম দফতর, সবাই মিলে পরিবেশ ও শ্রমিক স্বার্থের কিছু নিয়মকানুন এ বার পুজোর আয়োজনে যোগ করুন। পুজো শুরুর অনেক আগে থেকেই আমাদের পরিবেশ রক্ষায় নজর দিতে হবে। আমাদের শারদোৎসব এখন বিশ্বখ্যাত, আমাদের এই পুজো পরিকল্পনাও হোক বিশ্বখ্যাত— এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং-এর মতো।