শ্রীরণজিৎ গুহ (২৩ মে ১৯২৩ - ২৮ এপ্রিল ২০২৩)
Ranajit Guha

বিদগ্ধ, জেদি ব্যতিক্রম

রণজিৎ গুহ-র শেষ জীবনে এই বাংলা ভাষায় ফেরাকে কখনওই মাইকেল মধুসূদনের মতো ‘রেখো মা দাসেরে মনে’-র প্রতিফলন হিসাবে দেখা যাবে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:১৫
Share:

পথপ্রদর্শক: বিশ্বময় জ্ঞানচর্চাজগতে বরেণ্য ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ, আনন্দ পুরস্কার অনুষ্ঠান, ২০০৯।  ফাইল চিত্র।

সদ্যপ্রয়াত রণজিৎ গুহকে বাঙালি সমাজ কী ভাবে মনে রাখবে? ইতিহাসচর্চায় নিম্নবর্গের ইতিহাস বা সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ় নামে এক নতুন দর্শনের স্রষ্টা? যে চেতনায় সত্তর দশকে একযোগে আলোড়িত বহু তরুণ ইতিহাসবিদ? যিনি প্রজন্মান্তরে চারিয়ে দেন নতুন ইতিহাসবোধ? প্রগতি এবং শ্রেণি-সচেতনতার ছকবাঁধা গণ্ডির বাইরে শুরু হয় কৌমচেতনার নতুন বিশ্লেষণ?

Advertisement

না কি এমন এক মানুষ যিনি প্রবাসে ইংরেজি ভাষায় ইতিহাসচর্চা করেও শেষ জীবনে বাংলা ভাষায় নিয়ে আসেন অন্য বৈদগ্ধ্য, রামমোহন রায়ের দয়া থেকে রবীন্দ্রনাথের ছয় ঋতুর গান সব কিছুকে দেখেন নতুন ভাবে? শঙ্খ ঘোষ থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় উৎপলকুমার বসু অবধি সকলের কবিতার বিশ্লেষণে নিয়ে আসেন ভর্তৃহরি থেকে লাকাঁর বিদগ্ধ বৈদুর্যদীপ্তি!

রণজিৎ গুহ-র শেষ জীবনে এই বাংলা ভাষায় ফেরাকে কখনওই মাইকেল মধুসূদনের মতো ‘রেখো মা দাসেরে মনে’-র প্রতিফলন হিসাবে দেখা যাবে না। প্রবাসে, ইংরেজি ভাষায় নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার উত্তুঙ্গ দিনগুলিতেও তিনি বাংলাতেই ছিলেন। উনিশ শতকে বীরভূমে এক চাষি-বৌয়ের মৃত্যুর পুরনো আদালতি সাক্ষ্য, দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে ‘চন্দ্রা’জ় ডেথ’ নামের ইংরেজি নিবন্ধ যখন লিখছিলেন, গ্রামবাংলার কৃষকচৈতন্য-কেই খুলে দেখাচ্ছিলেন তিনি। আসলে সাহিত্য, ইতিহাস এ সব পরের কথা। রণজিতের প্রিয় উক্তি ছিল মার্ক্সের ‘নাথিং হিউম্যান ইজ় এলিয়েন টু মি’— মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক যা কিছুর, সবই আমার বিষয়। সবের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিলেন। প্রথম বই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূত্রপাত-এ জানান, “সমস্যা শব্দটির মধ্যে এক প্রকার অভাবের ধারণা আছে, যা তার পরিপূরক সমাধানকে চায়।” সমাধান আজ আসতে পারে, পঞ্চাশ বছর পরেও। কিন্তু প্রশ্নটাকে সেই ভাবেই তৈরি করতে হবে। কুতর্ক-প্রিয় বাঙালি সমাজ অবশ্য আজও সেই দীক্ষিত প্রশ্ন শেখেনি।

Advertisement

তিনিই সেই বিরল বাঙালি, যিনি নিছক প্রশ্নের জন্য প্রশ্ন, বা কথা বলার জন্য প্রশ্ন করায় বিশ্বাসী নন। এই ভক্তিবাদের দেশে তাঁর প্রিয় উক্তি মার্ক্সের ‘ডাউট এভরিথিং’। নিম্নবর্গের চৈতন্য নিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার সময় তাঁকেও রেয়াত না করে প্রশ্নে প্রশ্নে বিদ্ধ করতে হত— নইলে রেগে যেতেন। ভবিষ্যতে সঙ্ঘ ভেঙে যাবে, দীপেশ চক্রবর্তী চলে আসবেন পরিবেশের ইতিহাসে, গৌতম কথকতা ও বটতলার ঐতিহ্যে, শাহিদ আমিন দেখাবেন গাজি মিয়ার দ্বন্দ্বসঙ্কুল ইতিবৃত্ত, হার্ডিম্যান জানাবেন গুজরাতে মহাজন ও কৃষকের জটিল সম্পর্ক, জ্ঞানেন্দ্র পান্ডে জানাবেন দাঙ্গার হিংসা ও মানবিকতার কাহিনি, পার্থ দেখাবেন রাষ্ট্র কী ভাবে ‘আমি’র কর্তৃত্বে বলবান হয়ে ওঠে। কিন্তু ‘আর জি’-র ইতিহাসশিক্ষার ঐতিহ্য সকলে আজও স্মরণ করবেন বিনম্র শ্রদ্ধায়।

১৯২৩ সালে জন্মানো, বরিশালের সিদ্ধকাঠি গ্রামের জমিদার রাধিকারঞ্জন গুহবক্সীর পুত্র রণজিতের এই প্রশ্নবাচী, সংশয়-সত্তার উদ্ভব ছেলেবেলার পারিপার্শ্বিকতা থেকে। মাঠে খেলার সঙ্গী বা তাদের বাবা-কাকারাও বাড়িতে এলে তাঁদের একটাই পরিচিতি— প্রজা। কেন এঁদের পরিচয় শুধুই নামগোত্রহীন প্রজা? বাবা-জেঠাদের সামনে কেন এঁরা বসেন না? শুধুই হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে থাকেন? বালক রণজিতের মনে তখন থেকেই এই প্রশ্ন। উত্তর মিলল অনেক দিন পরে, কলেজ জীবনে। বালক রণজিৎ গুহ তত দিনে কলকাতায়। গ্রামের পাঠশালার পর ১৯৩৪ সালে মিত্র ইনস্টিটিউশন, তার পর ১৯৩৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিহাস বিভাগ। সেখানেই জড়িয়ে পড়লেন কমিউনিস্ট আন্দোলনে। রাজনীতি নিয়ে আতুপুতু করা, পরীক্ষার নম্বরকে প্রাধান্য দেওয়া এ যুগের বঙ্গীয় অভিভাবককুল স্মরণে রাখতে পারেন, ফাইনাল পরীক্ষায় সুশোভন সরকারের প্রিয়, মেধাবী ছাত্রটি অনার্সও ধরে রাখতে পারেননি।

অতঃপর এম এ। বাংলায় তখন ফজ়লুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি। লর্ড কর্নওয়ালিসের পুরনো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলায় থাকা উচিত কি না, তা নিয়ে সদ্য বেরিয়েছে ছয় খণ্ডে ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্ট। মেধাবী ছাত্রটি পড়ে ফেলল পুরো রিপোর্ট, কলেজে ডুব দিয়ে। ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক ইতিহাস পড়তে গিয়ে ফিলিপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে ওয়ারেন হেস্টিংসের মতানৈক্য জেনেছেন রণজিৎ। তা হলে কি ফিলিপ ফ্রান্সিস এক রকম চাইছিলেন, হেস্টিংস আর এক রকম? প্রশ্ন তোলায় শুভানুধ্যায়ী শিক্ষক নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ বললেন, ও সব থাক। আগে পরীক্ষাটা ভাল ভাবে দাও।

কিন্তু উত্তর যে চাই-ই! ফিলিপ ফ্রান্সিস নিয়ে পড়াশোনা করে রণজিৎ জানলেন, তাঁর অনুমান অভ্রান্ত। শিব গড়তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইংল্যান্ডের স্বার্থে বানর গড়েছে! জমিদারি লোপ করে ইংল্যান্ডের মতো পুঁজির পূর্ণ বিকাশ এ দেশে হয়নি। ম্যানচেস্টারের বস্ত্রশিল্পের স্বার্থেই এ দেশে চালু হয়েছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। রণজিৎ বুঝলেন, সিদ্ধকাঠি গ্রামে তাঁর খেলার সাথিরা উপনিবেশে কৃষিব্যবস্থার এই অসম্পূর্ণ নিয়মের কারণেই ‘প্রজা’।

এ দিকে ইতিহাসের ছাত্র তখন পুরোদস্তুর কমিউনিস্ট পার্টির হোলটাইমার, গ্রামে গ্রামে জমিদারি শোষণ ও জনযুদ্ধের চরিত্র বিশ্লেষণ করে দেখান। দাঙ্গাবিধ্বস্ত স্বাধীনতার সময়ে পার্টির কাজে তাঁকে যেতে হল ইউরোপে। এই সময়েই পোল্যান্ডে প্রথম স্ত্রী মার্থার সঙ্গে পরিণয়। ১৯৪৭-৫৩, টানা ছ’বছর ইউরোপ-প্রবাসী। দেশে ফিরে পার্টির মুখপত্র স্বাধীনতা পত্রিকায় লেখালিখি, বিদ্যাসাগর কলেজ, চন্দননগর কলেজে অধ্যাপনা। ১৯৫৮ সালে সদ্যনির্মিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে শিক্ষকতার জন্য তাঁকে ডেকে নিলেন তাঁর মাস্টারমশাই সুশোভন সরকার। সে সময় রণজিতের জীবনবৃত্তে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়। স্বাধীনতা পত্রিকার টেলিপ্রিন্টারে হাঙ্গেরিতে সোভিয়েট আগ্রাসনের খবর দেখে তিনি সে দিনই পার্টির সভ্যপদ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন।

কিন্তু মাথায় চেপে আছে সেই প্রজা ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভূত। সুশোভন সরকারের উৎসাহে লেখাটি ধারাবাহিক ভাবে ছাপা হতে লাগল স্বাধীনতা পত্রিকায়। কিন্তু সম্পাদক গোপাল হালদার পছন্দ করলেন না বিষয়টি, ‘লেখাটা বড্ড বড় হয়ে যাচ্ছে।’ পার্টির সঙ্গে সংযোগ নেই, কেউ পছন্দ করেন না তাঁর ধী-মান চিন্তা। অতএব রণজিৎ আবার পাড়ি জমালেন বিদেশে। ১৯৬৩ সালে প্যারিস থেকে ইংরেজিতে প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম বই আ রুল অব প্রপার্টি ফর বেঙ্গল। পার্টির দলাদলিতে বাংলায় অসমাপ্ত লেখা, তার পর সেই বিষয় নিয়েই প্যারিস থেকে প্রথম বই। একেই কি বলে বরিশালী গোঁ? বরিশাল বলতে আমরা জীবনানন্দ, শঙ্খ ঘোষ জানি। জানি আর এক বিখ্যাত ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীকেও। কমিউনিস্ট পার্টিকে বাদ দিয়ে একা হেঁটে যাওয়া রণজিৎ গুহ কিন্তু স্বভাবতই বরিশালী। এত গবেষককে কী ভাবে এক ছাতার নীচে আনলেন? তাঁর উত্তর, “ভুলো না, আমি কমিউনিস্ট পার্টির অর্গানাইজ়ার ছিলাম।”

অতঃপর ম্যানচেস্টার, সাসেক্স এবং অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা। এই সময়ে এই দেশে তাঁর লেখা কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালে নয়, বেরোয় বন্ধু সমর সেনের ফ্রন্টিয়ার পত্রিকায়। সত্তর দশকের এই সময়েই দ্বিতীয় স্ত্রী মেখতিল্ড-কে নিয়ে এ দেশে আসেন রণজিৎ। ১৯৮২ সালে কলকাতায় সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ়-এর প্রথম বৈঠক, ১৯৮৩ সালে তাঁর ‘ম্যাগনাম ওপাস’ এলিমেন্টারি আসপেক্টস অব পেজ়্যান্ট ইনসারজেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া-র প্রকাশ। রণজিৎ দেখান, শুধু শ্রেণি-সংগ্রামের তত্ত্বে নিম্নবর্গকে বোঝা সম্ভব নয়। সে একই সঙ্গে সংঘাত ও সমঝোতার কথা বলে, যেখানে কৌমচেতনার আলো-আঁধারি মিশে থাকে। ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৮ অবধি সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ়-এর সম্পাদনা, সোভিয়েট জমানার পতনের পর হিস্ট্রি অ্যাট দ্য লিমিট অব ওয়ার্ল্ড-হিস্ট্রি। নিম্নবর্গের চেতনার সন্ধান যে জনপরিসরে কী সাড়া জাগিয়েছিল, তার প্রমাণ গৌতম ঘোষের ছবি দেখা-য় সৌমিত্র তাঁর সহযোগীকে বলেন সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ়-এর খণ্ডগুলি আনিয়ে দিতে। ইতিহাসচেতনা তখন আর অ্যাকাডেমিক পরিসরে আবদ্ধ নয়।

কিন্তু তিনি তো সহজে থেমে যাবেন না। ২০০৯-এ মাত্র পাঁচ মাসের ব্যবধানে বেরোল ভিয়েনাবাসী ইতিহাসবিদের দু’টি বাংলা বই কবির নাম ও সর্বনাম এবং ছয় ঋতুর গান। রবীন্দ্রনাথের গানে আমি আসলে আত্মমুখী অহংভাব, রণজিৎ ভর্তৃহরি থেকে দেখালেন। এর পরে তিন আমির কথা। দেখালেন তিনি, কৃত্তিবাস যুগের তিন কবির স্বকীয়তার অভিযান। সুনীলের ‘আমি’ স্বচ্ছতায়, অভিমানমুক্ত ঢঙে নিজেকে মিলিয়ে দিতে পারে সারা পৃথিবীর সঙ্গে, শঙ্খ ঘোষের ‘আমি’ তার যাবতীয় ঐতিহাসিকতা নিয়েও আত্মলিপ্ত, বারে বারে অজস্র ‘আমি’র সঙ্গে মেলবন্ধন করতে গিয়েও সে ফিরে আসে নিজের দিকে। তার পর দয়া— ছকবাঁধা নবজাগরণের পথিকৃৎ পরিচিতি ভেঙে রণজিৎ গুহ জানাবেন, রামমোহন রায়ের প্রাথমিক চারিত্রগুণ, তাঁর দয়া। লোকে ভাবে, বার্ধক্যেই স্মৃতিকাতর হয়ে তাঁর বাংলা লেখা। তাঁরা ভুলে যান, একদা নীরেন্দ্রনাথ রায়ের অসার ম্যাকবেথ অনুবাদকে পরিচয় পত্রিকার পাতায় কী ভাবে বিদ্ধ করেছিলেন তরুণ রণজিৎ!

চেখভের গল্পের আলোচনায় তিনি বলেন, নির্বাসিতের বেদনা সব সময় ভাষায় ধরা পড়ে না। রণজিৎ নিজেকে অভিবাসী ‘ডায়াস্পোরা’র মানুষ বলে ভাবেননি, বরাবর ‘এগজ়াইলড’ বা নির্বাসিত বলেই ভেবে এসেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকার শতবর্ষ-ক্রোড়পত্রে ছিল তাঁর শেষ সাক্ষাৎকার, যেখানে তিনি বলেছিলেন, অসুস্থতার মধ্যেও কেবল বাংলা ভাষা, বাংলা অক্ষরের কাছে তিনি খুঁজে পান প্রতি মুহূর্তের আশ্রয়। আত্মবিস্মৃত বাঙালি জীবনে বরিশাল থেকে ভিয়েনার একরোখা মেজাজি রণজিৎ গুহ এ ভাবেই সর্বার্থে ব্যতিক্রম।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement