—ফাইল চিত্র।
মাসদুয়েক আগে এনসিইআরটি-র ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক সংশোধনের উদ্দেশ্যে গঠিত সাত সদস্যের কমিটির প্রধান, সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ এবং সদ্য পদ্ম সম্মানে ভূষিত সি আই আইজ়াক পরামর্শ দিলেন, সমস্ত পাঠ্যবইতে ‘ইন্ডিয়া’-র বদলে ‘ভারত’ শব্দটি ব্যবহৃত হোক। কারণ, ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটি আধুনিক, এবং বিষ্ণুপুরাণে ‘ভারতবর্ষ’ শব্দটির ব্যবহার ৭০০০ বছরের পুরনো। মন্তব্যটি ইতিহাসবিরুদ্ধ। ৭০০০ বছর আগে যে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রস্তর যুগ চলছিল, এই প্রত্নতাত্ত্বিক সত্য আইজ়াকের অজানা নয়। বিষ্ণুপুরাণের আনুমানিক রচনাকাল খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক। অন্য দিকে, ‘ইন্ডিয়া’ নামটি ইংরেজদের করা আধুনিক নামকরণ নয়, বরং সিন্ধু/সপ্তসিন্ধু এবং প্রাচীন পারসিক হপ্তহিন্দু/হিন্দুজ় থেকে আসা সুপ্রাচীন গ্রিক নাম, এও সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু, রাজনীতি আর কবেই বা ইতিহাসের পাঠ নিয়েছে!
কিন্তু, তার চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ হল, আইজ়াক ভারতীয় ইতিহাসের প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক, এই ত্রিস্তর বিভাজন পাল্টে প্রাচীনের বদলে ‘ধ্রুপদী’ শব্দটির ব্যবহার চান। তাঁর মতে, ঔপনিবেশিক আমলে করা যুগবিভাজন এখনও মেনে চলা ভিত্তিহীন। তিনি হয় নিজে ভুলেছেন, অথবা ভুলিয়ে দিতে চান যে, ইতিহাসকে ধ্রুপদী, মধ্য, আধুনিক এই তিন ভাগে ভাগ করার ঔপনিবেশিক রীতি ভারতীয় ইতিহাসচর্চায় বহু পূর্বেই বদলে গিয়েছে।
ঔপনিবেশিক ইতিহাসবিদ জেমস মিল ইউরোপের ইতিহাসের ধ্রুপদী, মধ্য, আধুনিক এই তিনটি যুগের অনুকরণে ভারতের ইতিহাসকে ভাগ করলেন, কিন্তু যুগ তিনটির নাম দিলেন যথাক্রমে হিন্দু, মুসলিম, ও ব্রিটিশ যুগ। যুক্তি সরল— প্রাক্-ঔপনিবেশিক ভারতে শাসকের ধর্মই প্রধান; কিন্তু ব্রিটিশ যুগ (খ্রিস্টান যুগ নয়) ধর্মনিরপেক্ষ ও আধুনিক, সবার জন্য নিরাপদ। কিন্তু, এই ঔপনিবেশিক বিদ্যাচর্চা ভুলল যে, ভারতে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার আগেও বৌদ্ধ, জৈন শাসকরা ছিলেন। আবার দিল্লির সুলতান বা মোগলদের পাশাপাশি ছিল বিজয়নগর বা রাজপুত রাজ্যগুলি। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র বা ইসলামি শরিয়ত মেনে শাসন চালানো শাসকের সংখ্যা ভারতের সুদীর্ঘ ইতিহাসে মুষ্টিমেয়। তাই অধিকাংশ জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদ মিলের নামকরণ বর্জন করে ব্যবহার করেছেন প্রাচীন, মধ্য, আধুনিক নামগুলি।
কিন্তু, সাম্প্রদায়িক নামকরণ বর্জিত হলেও থেকে যায় সাম্প্রদায়িক কালবিভাজন। মিলের হিন্দু যুগ (দ্বাদশ শতক পর্যন্ত) ও মুসলিম যুগ (অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত)-ই পরিচিত হয় যথাক্রমে প্রাচীন ও মধ্যযুগ নামে। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী অবশ্য তাঁর প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস শেষ করেছিলেন গুপ্তযুগের শেষে (খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতক)। নীহাররঞ্জন রায় মিলের কালবিভাজনকে বদলানোর কথা বলেন। তাঁর বাঙ্গালীর ইতিহাস-এ ‘প্রাচীন যুগ’-এর বদলে লেখেন ‘আদিপর্ব’। কিন্তু ঔপনিবেশিক ত্রিস্তরীয় যুগবিভাজনের কোনও বিকল্প কাঠামো এঁরা দেননি। সেই অবদান ভারতের মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদদের, যাঁরা এ ক্ষেত্রে কার্ল মার্ক্সের ইতিহাস-ব্যাখ্যাকেও অস্বীকার করলেন।
ধ্রুপদী মার্ক্সবাদ ইতিহাসের যে বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দেয়, তাতে রাজনৈতিক ইতিহাসের বদলে প্রাধান্য পায় অর্থনৈতিক পরিবর্তন। মার্ক্সের মতে, সমাজ পরিবর্তনের ইতিহাস আসলে শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। প্রতিটি সমাজে উৎপাদনের উপকরণ ও উৎপাদিত দ্রব্য বণ্টনের মালিকানা যাঁদের হাতে আছে এবং যাঁদের হাতে নেই, এই দুই শ্রেণির নিরন্তর সংগ্রাম চলে। তার ফলে অবশেষে একটি নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এলে বদলে যায় রাজনৈতিক-সামাজিক কাঠামোও। নতুন ব্যবস্থা আগের থেকে উন্নততর হলেও বৈষম্যমূলকই থাকে, আবারও হয় নতুন শ্রেণিসংগ্রাম। এ ভাবেই দাস সমাজ বদলে আসে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ, এবং অবশেষে ধনতান্ত্রিক সমাজ। মার্ক্সের এই ইতিহাসবীক্ষা গড়ে উঠেছিল ইউরোপের ইতিহাসের নিরিখে— ধ্রুপদী গ্রিক-রোমান সভ্যতায় দাসপ্রথার ব্যাপকতা ও মধ্যযুগের ইউরোপে সামন্ততন্ত্র ঐতিহাসিক সত্য। এশিয়া-আফ্রিকার ইতিহাসকে কিন্তু এই ছাঁচে ফেলা যায় না। মার্ক্স একে দেখেছিলেন এশিয়া-আফ্রিকার পশ্চাৎপদতা হিসাবে। ‘এশীয় উৎপাদন ব্যবস্থা’ মার্ক্সের মতে এক অপরিবর্তনশীল রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত স্বৈরতন্ত্র, যার ফলে এশীয় সমাজে ঐতিহাসিক পরিবর্তন শুরুই হয়নি।
স্বাধীন ভারতের মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদেরা মার্ক্সের মতোই সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তনের নিরিখে ভারতের ইতিহাসকে বোঝার চেষ্টা করলেও তাঁরা অনেকেই মার্ক্সের সিদ্ধান্ত মানলেন না। তাঁরা বললেন, ভারতের অতীত কোনও ইতিহাসবিহীন, পরিবর্তনহীন স্বৈরতন্ত্র নয়। ভারতের ইতিহাসেও গুরুত্বপূর্ণ আর্থসামাজিক পরিবর্তনের নিরিখে যুগবিভাজন সম্ভব। ডি ডি কোসাম্বির দেখানো পথ অনুসরণ করে রামশরণ শর্মা তাঁর ইন্ডিয়ান ফিউডালিজ়ম-এ এবং বিভিন্ন প্রবন্ধে দেখান যে, দ্বাদশ শতক অবধি প্রাচীন ভারত একটি অবিভাজ্য কালপর্ব নয়। ৩০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ যুগান্তকারী আর্থসামাজিক পরিবর্তনের সময়— যার মূলে রয়েছে ব্রাহ্মণদের এবং বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে নিষ্কর জমিদান (অগ্রহার ব্যবস্থা)। ৩০০-৬০০ খ্রিস্টাব্দে পরিবর্তনের শুরু। ৬০০-১২০০ পর্ব নতুন এক রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থার যুগ, যা ইউরোপের সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে তুলনীয়।
রোমান সভ্যতার পতনের পর মধ্যযুগের ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের উন্মেষ ঘটে। এর বৈশিষ্ট্য ছিল রাজার ক্ষমতাহ্রাস এবং রাজা ও কৃষকের মধ্যে স্তরবিন্যস্ত, মধ্যস্বত্বভোগী ভূস্বামীদের উত্থান। এই সামন্তপ্রভুরা সামরিক আনুগত্যের বিনিময়ে রাজা বা ঊর্ধ্বতন প্রভুর থেকে লাভ করতেন ভূমিখণ্ড, যাতে চাষ করত নির্দিষ্ট জমিতে আবদ্ধ ভূমিদাসেরা। ভূমিকেন্দ্রিক ও গ্রামীণ সামন্ততন্ত্রের নেপথ্যে ছিল ইসলামের উত্থান ও ভূমধ্যসাগরে তাদের আধিপত্য বিস্তারের ফলে ইউরোপের বাণিজ্য, মুদ্রাব্যবস্থা, নগরায়ণের অবক্ষয়। শর্মার মতে, ভারতে গুপ্ত-উত্তর কালপর্ব (৬০০-১২০০) অনুরূপ অবক্ষয়ের যুগ। সপ্তম শতকের চিনা পরিব্রাজক শুয়ানজাং-এর বিবরণে প্রাচীন নগরগুলির ক্ষয়িষ্ণু রূপ, পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনে রোম-ভারত সমৃদ্ধ সমুদ্রবাণিজ্যের অবসান, দাক্ষিণাত্যের বাকাটক বা বাংলার পাল-সেন রাজাদের মুদ্রার বিরলতা, মুদ্রার অভাবে বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে কড়ির ব্যবহার উল্লেখ পাওয়া যায়। রাজা ও কৃষকের প্রত্যক্ষ সম্পর্কের মধ্যে উত্থান ঘটে মধ্যস্বত্বভোগী অগ্রহার-প্রাপকদের। জমিদানের সনদে ‘ধনজনসহিত’ শব্দের ব্যবহার ভূমিদাসত্বের ইঙ্গিত দেয়। আবার প্রদত্ত জমিতে রাজার প্রশাসনিক ও সামরিক হস্তক্ষেপ প্রত্যাহার রাজক্ষমতা হ্রাসেরই পরিচায়ক। মৌর্য বা গুপ্তদের মতো বড় সাম্রাজ্যের বদলে গড়ে ওঠে ভূস্বামী-শাসিত ছোট ছোট আঞ্চলিক রাজ্য।
এই তত্ত্ব অবশ্য বিতর্কিত। দীনেশচন্দ্র সরকার দেখান, জমিদান মানেই রাজক্ষমতা হ্রাস নয়— রাজদ্রোহের কারণে প্রদত্ত জমি প্রত্যাহারেরও সম্ভাবনা ছিল ওড়িশার করশাসনগুলিতে। হরবনস মুখিয়ার মতে, এই সময় কৃষকের অবস্থার অবনতি ঘটলেও চুক্তিভিত্তিক ভূমিদাসত্বের নিদর্শন নেই। তাই ‘সামন্ততন্ত্র’ শব্দটি তর্কযোগ্য। মুদ্রার সংখ্যা কমলেও ছিল বিনিময়ের বিকল্প মাধ্যম (যেমন স্বর্ণচূর্ণ, রৌপ্যচূর্ণ); বন্দর-সংলগ্ন অঞ্চলে (যেমন বাংলার হরিকেল) মুদ্রাব্যবস্থা ছিল অব্যাহত, দেখিয়েছেন ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। সমুদ্রবাণিজ্য জারি ছিল বাইজ়ান্টিয়ামের পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য, আরব অঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে। কড়ির ব্যবহারও বাণিজ্যহীনতার পরিচায়ক নয়, কারণ কড়ি আমদানি হত মলদ্বীপ থেকে। বিবিধ অভ্যন্তরীণ স্থলবাণিজ্যকেন্দ্রের উপস্থিতি তুলে ধরেছেন রণবীর চক্রবর্তী। পুরনো নগরগুলির পতনের পাশাপাশি বহু নতুন নগরের উত্থান ঘটেছে এই সময়, যা ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়ের মতে ‘তৃতীয় নগরায়ণ’। বৃহৎ সাম্রাজ্যের বদলে আঞ্চলিক রাজ্যের উত্থান মানেই রাজনৈতিক অবক্ষয়, এই সাম্রাজ্যবাদ-ঘেঁষা ধারণাও তর্কসাপেক্ষ।
একাধিক ইতিহাসবিদের মতে, এই কালপর্ব সুসংহত আঞ্চলিক রাষ্ট্রগঠনের যুগ। অগ্রহার-প্রাপকরা অনাবাদি জমিকে আবাদি জমিতে পরিণত করতে থাকেন। ব্রাহ্মণ্য ধর্মসংস্কৃতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রসার ঘটতে থাকে অরণ্য-অঞ্চলেও। অরণ্য উপজাতিরা কৃষিজীবী হয় এবং কালক্রমে বর্ণজাতিব্যবস্থার আওতায় আসে। রাষ্ট্র তাদের আত্তীকৃত করে আঞ্চলিক ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ে। রাজপুত শক্তিগুলির উত্থান বা গঙ্গশাসিত ওড়িশায় জগন্নাথকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক রাষ্ট্রীয় সংহতি এর উদাহরণ। সামন্ততন্ত্র বিতর্কে তাই রয়েছে বিভিন্ন অভিমত। কিন্তু, প্রতিটি মতই স্বীকার করে শর্মার প্রারম্ভিক বক্তব্য: গুপ্তোত্তর ভারতে দেখা যায় নতুন কিছু যুগবৈশিষ্ট্য। তাই ঔপনিবেশিক ত্রিস্তরীয় যুগবিভাজন বদলে যায়। ৬০০-১২০০ কালপর্ব চিহ্নিত হয় ‘আদি মধ্যযুগ’ নামে।