কোভিড-উত্তর যুগে ডেটিং অ্যাপের বাড়বাড়ন্ত অবাক করে না। প্রতীকী ছবি।
আমি এখানে মানুষ উইন্ডো-শপিং করতে এসেছি, আপনিও তো তা-ই?” একটি বাক্যের আত্মপরিচিতি, এক ডেটিং অ্যাপের প্রোফাইল থেকে উদ্ধৃত। বিজ্ঞাপনের পণ্য-বর্ণনার মতোই, মানুষ অল্প কথায় তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ-প্রত্যাশার কথা জানাচ্ছে। আমরা যেন একে অপরকে দেখছি সুদৃশ্য বিপণির আকাঙ্ক্ষিত পণ্যের মতো। নিজেদের পরিবেশন করছি চটকদার ভাষার মোড়কে। বেশি পড়ার সময় কারও নেই, অস্থির আঙুল ডানে-বামে চলছে দ্রুতলয়ে। ডান মানে পছন্দ, বাম: বাতিল।
এতটাই সহজ, তরল হয়েছে আজ অপরিচিত মানুষের সন্ধান। অক্লান্ত দেখনদারি, বাহ্যিক রূপ ও বর্ণনা দেখে চটজলদি সিদ্ধান্ত। হুজুগে কেনাকাটার মতো। যে সুখ নিহিত ছিল পণ্য দেখে বা ছুঁয়ে, তা এখন মানুষ পাচ্ছে ডেটিং অ্যাপ ঘেঁটে। নিজের পরিচিতিতে এক জন লিখছেন: “আমি অনেকটা হট-অ্যান্ড-সুইট সসের মতো... কখনও আবার ফ্রেঞ্চ ফ্রাই।” পণ্যের সঙ্গে অনায়াস তুলনা, নিজেকে অনায়াসে পণ্য রূপে ভাবার নিদর্শন। হতাশার অভিব্যক্তিও পণ্যের ভাষা অনুসারী: “এ বিশ্বে আমিই কেবল অবিক্রীত রয়ে গেলাম।” আত্মকেন্দ্রিক নগর-জীবনে কথা বলার লোকের অভাব, অতিমারির পর যেন আরও। কোভিড-উত্তর যুগে ডেটিং অ্যাপের বাড়বাড়ন্ত তাই অবাক করে না। অ্যাপেই প্রথম দেখা থেকে প্রণয় সেরে ফেলছেন অনেকে।
অ্যাপের মাধ্যমে অপরিচিত দু’জনের সাক্ষাৎ ও আলাপের সম্ভাবনা বাড়লেও, অ্যাপের অস্তিত্বই দাঁড়িয়ে আছে কমে আসা সামাজিকতার উপর। ডেটিং বা অন্য অ্যাপ মানুষের একাকিত্ব কতটা কাটাতে পারে সে নিয়ে ধন্দ থাকলেও, মানুষের একাকিত্বকে যে বিপণনের স্বার্থে কাজে লাগানো হচ্ছে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কেউ লিখছেন, “আশাহত হতে ভাল লাগে খুব, তাই এই অ্যাপে এলাম। আশাহত হওয়ার জন্য এর থেকে ভাল জায়গা আর আছে কি?” ক্রেতা সংস্কৃতির মূলেও এ-হেন অসন্তোষ ও হতাশা, তা কাজে লাগিয়েই সমাধান হিসাবে পণ্যের বিজ্ঞাপন সাজায় বাজার, নিত্যনতুন চাহিদা তৈরি করে। কিন্তু সব নতুনই খুব তাড়াতাড়ি পুরনো হয়ে গিয়ে নতুনতর-র জন্য জায়গা করে দেয়। পণ্য ও মানুষ, দুই ক্ষেত্রেই। এই পণ্যপালিত ও চালিত দৌড়ঝাঁপের একটা নির্দিষ্ট বৃত্ত আছে: বাসনার প্রবেশ ও জাগরণ, তার উত্থান ও ভোগ, তার অবসান ও প্রস্থান— এবং এদের পুনরাবৃত্তি। এই চক্রের মেয়াদ অনন্ত, এবং তা ভোগ ও সম্ভোগ দুই ক্ষেত্রেই সত্যি। তাই জনৈকের দাবি: “প্রতি সপ্তাহে নতুন সঙ্গী চাই।” পণ্যের তত্ত্ব মেনে খুব তাড়াতাড়ি পুরনো হচ্ছে শরীর ও সঙ্গ, প্রয়োজন হচ্ছে নতুনের অফুরন্ত জোগান— অ্যাপ মারফত। স্থায়িত্ব নয়, আরও আকর্ষণ ও উত্তেজনা চাইছেন কিছু মানুষ।
এ জিনিস সামাজিক অবক্ষয়ের প্রমাণ কি না, তা সমাজতাত্ত্বিকের বিচার্য নয়। দিল্লির শ্রদ্ধা-হত্যাকাণ্ডে উঠে এসেছে বিশেষ একটি ডেটিং অ্যাপ। ডেটিং অ্যাপের মতো মঞ্চগুলিকে কাঠগড়ায় তুলেছে সমাজের একাংশ, যেন এগুলিই সমাজের ঘৃণ্যতম অপরাধের কেন্দ্র। এদের উপর নিষেধাজ্ঞার দাবি উঠেছে। যদিও প্রশ্ন উঠতে পারে, দু’জন অচেনা মানুষের দেখাসাক্ষাতের সূত্র, প্রক্রিয়া বা স্থান-কালের সঙ্গে ভবিষ্যতে একে অপরের প্রতি দুর্ব্যবহারের কী সম্পর্ক থাকতে পারে। আলাপের মাধ্যম যা-ই হোক, তা কি কখনও আগাম নির্যাতনের বাহক হতে পারে? ডেটিং অ্যাপ ভাল না মন্দ, প্রশ্ন তা নয়। সামাজিকতার ক্ষেত্রে এর কেমন প্রভাব দেখা যাচ্ছে, সেটাই আসল কথা। জীবনচর্চায় কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে, স্বল্পস্থায়ী আদানপ্রদান কোন স্তরে গিয়ে পৌঁছচ্ছে, মানবিক বা অ-মানবিক কথোপকথন হচ্ছে কোন সেই বিধি মেনে যেখানে প্রবেশ বা প্রস্থানের কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম নেই, নেই দায়বদ্ধ থাকার বাধ্যবাধকতা! যার সঙ্গে বেশ কথা এগোচ্ছিল, সে হঠাৎ উধাও হয়ে যাচ্ছে কৈফিয়ত না দিয়ে। এই স্বাধীনতা যেন ভূতের রাজার বর।
এখানে কোনও কিছুরই নিশ্চয়তা নেই। অ্যাপে দেখলেই যে আসল দেখা হবে তা নয়, এক জনের ইচ্ছে হলেই যে অন্য জন সাড়া দেবে তা নয়। কথা চললেই যে দেখা হবে, তা-ও নয়, আর দেখা হলেই যে সম্পর্ক হবে এমনটা ভাবনারও অতীত। তবু সকলে মগ্ন— পর্দায় পাওয়া-মানুষদের বাছাই বা বাতিল করার খেলায়। এই দায়বদ্ধতাহীনতা এক অভিনব সামাজিকতার রূপরেখা। কর্মক্ষেত্র, পাড়া, পরিবার, পার্টি, যে কোনও জনপরিসরে না বলে উধাও হওয়াটা মানুষের স্বভাবোচিত নয়। সেই ‘মানবিক’ সম্পর্ক থেকে উত্তর দেওয়ার দায়বদ্ধতাটাই মুছে ফেলেছে অ্যাপ। গন্তব্যহীন, পূর্বনির্ধারিত গতিপথহীন এ এক আজব যাত্রা, তাকে প্রতিনিয়ত আরও রহস্যময় করে তুলছে অ্যাপের অ্যালগরিদম। তাই স্বপ্নপুরুষ বা মানসী নয়, চলছে অ্যাপে পাওয়া মানুষের খোঁজ। কেউ খুঁজছে সঙ্গী, কেউ মুহূর্তসুখ। মুক্ত বাজারের নিয়মানুসারে সবার জন্যই আছে কিছু না কিছু, কেউ না কেউ।