ঐতিহ্য: গারো জনজাতির লয়েন লুমে কাপড় বোনা চলছে। অমিতাভ গুপ্ত।
কথা শেষ করে ফের নিজের যন্ত্রে মন দিলেন মেরি সাংমা। মেঘালয়ের পশ্চিম গারো পাহাড়ে তখন সূর্যও পশ্চিমে হেলেছে, বসন্তের রোদ এসে পড়ছে মধ্যচল্লিশের মেরির নিবিষ্ট মুখে। যন্ত্র বলতে অবশ্য দুটো দেড় হাত লম্বা লাঠি, গোটাকয়েক রোগা-মোটা কাঠি, এবং পুরো জিনিসটাকে টান করে ধরে রাখার জন্য কোমরে বাঁধার পট্টি। গারো জনজাতির হস্তচালিত তাঁত বলতে এটুকুই। দু’রঙের সুতো কাঠি দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে তাতে নকশা ফুটিয়ে তুলছেন মেরি। বুনছেন একটা মাফলার। জানালেন, এক সপ্তাহ সময় লাগবে এই একটা মাফলার বুনতে— পুরো কাজের জন্য মজুরি পাবেন পাঁচশো টাকা। তাঁকে কাজ দিয়েছেন ডেজ়ি মোমিন— পেশায় ফ্যাশন ডিজ়াইনার, গারো জনজাতির হাতে বোনা কাপড় নিয়ে কাজ করেন তিনি।
যে যন্ত্রে একটা মাফলার বুনতে এক সপ্তাহ সময় লাগে, তার পক্ষে বাজারে টিকে থাকা অসম্ভব। গারো জনজাতির লয়েন লুম-ও বিলুপ্তপ্রায়। ইউনেস্কো তাকে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ’-এর তকমা দিয়েছে। শুধু লয়েন লুমই নয়, উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে ছড়িয়ে থাকা জনজাতিগুলির একশোটি বিপন্ন সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের তথ্য সংরক্ষণের প্রকল্প নিয়েছে ইউনেস্কো, এবং সেই প্রকল্পের শরিক হিসাবে বেছে নিয়েছে রয়্যাল এনফিল্ড-কে। এমন কাজে হঠাৎ এক মোটরসাইকেল সংস্থা কেন? রয়্যাল এনফিল্ডের তরফে প্রকল্পটির দায়িত্বে থাকা বিদিশা দে জানালেন, গোটা দেশে ছড়িয়ে আছে তাঁদের ‘রাইডার কমিউনিটি’— বাইক নিয়ে দূরদূরান্তে পৌঁছে যাওয়া যাঁদের কাছে জীবনের অন্যতম অর্থ। এত দিন তাঁরা ‘বাইরে’ যেতেন— দুর্গম পাহাড়ি পথে, আদিগন্ত মরুভূমির রাস্তায়; এ বার সেই যাত্রার অভিমুখ ‘অন্তর’-এর দিকে— বাইকে কয়েকশো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তাঁরা পৌঁছচ্ছেন প্রত্যন্ত সব গ্রামে, কথা বলছেন জনজাতি গোষ্ঠী মানুষদের সঙ্গে, প্রত্যক্ষ করছেন তাঁদের সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক রীতিনীতি, আর সেই কথোপকথন ভিডিয়ো ক্যামেরা-বন্দি হয়ে তৈরি করছে এক ডিজিটাল দৃশ্য-শ্রাব্য ভান্ডার। বিপন্ন সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়াগুলি কালের নিয়মে বিলুপ্ত হলেও যাতে থেকে যায় তার চিহ্ন। ইতিমধ্যেই উত্তর-পূর্ব ভারতের ৬৬টি ঐতিহ্য ক্যামেরাবন্দি হয়েছে।
অবশ্য স্মৃতির ভান্ডার কি শুধু ক্যামেরা-বিধৃতই হয়? মুম্বই-দিল্লি-কলকাতার বাইকারোহীরা যখন ওয়েস্ট গারো হিলস-এর আমিন্ডা রংসাগ্রে গ্রামে হান্দাম মারাক নামক যুবকের সামনে দাঁড়ান, সে মুহূর্তটি তাঁদের ব্যক্তিগত স্মৃতির ভান্ডারেও অনপনেয় হবে। হান্দাম কাঠ খোদাই করে ভাস্কর্য তৈরি করেন। জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে আনা মৃত গাছের শরীরে তো বটেই, যে গাছ মাটিতে দাঁড়ানো অবস্থায় মৃত, হান্দাম তাকে স্থানচ্যুত না করেই তার আদল বদলে দেন সম্পূর্ণ। গাছ কখনও হয়ে ওঠে রণোদ্যত গারো যোদ্ধা, কখনও আবার সন্তান কোলে অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত নারী। সে ভাস্কর্য আক্ষরিক অর্থেই আমিন্দা রংসাগ্রে গ্রামের জমিতে শিকড় গেঁথে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে স্থানান্তরিত করার উপায় নেই। ফলে, তার কোনও বাজারও নেই— সেই শিল্পকর্মের কোনও ক্রেতা নেই, প্রত্যন্ত গ্রামে বহিরাগত দর্শকও নেই তেমন। তবু হান্দাম মারাক মাসের পর মাস ছেনি আর বাটালি হাতে একটু-একটু করে মৃত গাছের শরীরে ফুটিয়ে তোলেন তাঁর কল্পনাকে। কেন? জানালেন, কাঠখোদাইয়ের এই শিল্প যেমন হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত, তেমনই হারিয়ে যাচ্ছে তাঁদের সম্প্রদায়ের অতীত গল্পগুলো। একই সঙ্গে দুটোই ধরে রাখার চেষ্টা। দূরের শহর থেকে তাঁদের দেখতে আসা বাইকারোহীদের নাগরিক অভিজ্ঞতায় কোনও হান্দাম মারাক ছিলেন না কোনও দিন। এই প্রকল্পের দেখা আর তথ্য সংগ্রহের কাজ ফুরিয়ে গেলেও হয়তো তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ নতুনতর কোনও প্রান্তে গিয়ে খোঁজ করবেন সেখানকার মানুষদের— জেনে নেবেন, তাঁদের প্রাত্যহিকতায় কোথাও বিস্ময় লুকিয়ে আছে কি না এ রকম।
বিস্ময় যদি না-ও বা থাকে, প্রাত্যহিকতায় ধরা থাকতে পারে অন্য কোনও জীবনদর্শনও। পশ্চিম গারো পাহাড়ে পথ চললেই চোখে পড়বে, স্কুলপাঠ্য ভূগোল বইয়ে পড়া ঝুমচাষের জন্য সাফ করা হয়েছে একের পর এক পাহাড়ের ঢাল। দারিবকগ্রে নামে এক গ্রামের প্রধান— জনজাতির ভাষায় তাঁকে বলে নোকমা— জানালেন, সব পাহাড়েরই মালিক নোকমার পরিবার। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ— উত্তরাধিকার সূত্রে মায়ের পরে নোকমা হন মেয়ে, সব পাহাড়ের মালিকানাও পান তিনিই। নোকমা জানালেন, সরকার থেকে খুব করে বলছে ঝুমচাষ বন্ধ করে দিতে। বিকল্প হিসাবে নানান গাছের বীজ দিচ্ছে, সে চাষে উৎসাহও দিচ্ছে বিভিন্ন ভাবে। কমেও এসেছে ঝুমচাষ।
কেন সরকার ঝুমচাষে নিরুৎসাহ করছে গারো পাহাড়ের বাসিন্দাদের, সে কারণও স্কুলপাঠ্য বইয়েই আছে— পাহাড়ের গাছ পুড়িয়ে জমি তৈরি করার ব্যবস্থা পরিবেশের পক্ষে খারাপ। হয়তো সত্যিই খারাপ। যদিও, বিরুদ্ধ মতবাদীরাও আছেন, যাঁরা বলেন যে, ঝুমচাষ সম্বন্ধে এই নেতিবাচক পর্যবেক্ষণ আসলে ঔপনিবেশিক জ্ঞানচর্চার ফসল। ঔপনিবেশিক প্রভুদের প্রয়োজন ছিল পাহাড়ের কাঠের অধিকার, তার জন্য জনজাতিকে সেই অধিকার থেকে বিচ্যুত করারও প্রয়োজন ছিল। তার জন্য আদিবাসীদের পদ্ধতির বৈধতা অস্বীকার করাই ছিল সবচেয়ে সভ্য পথ। উত্তর-ঔপনিবেশিক জ্ঞানচর্চার গবেষণা বলে, ঝুমচাষে নাকি পাহাড়ের জীববৈচিত্র বাড়ে, জমির উর্বরতাও বাড়ে।
কোন পক্ষের যুক্তি ঠিক, অধিকতর গ্রহণযোগ্য, সে বিচার করার দায় বাইক-আরোহী স্মৃতি সংগ্রাহকদের নেই। তবে, তাঁরা এটুকু বুঝতে পারেন যে, সরকার চাক বা না-ই চাক, ঝুমচাষের আয়ু আর দীর্ঘ নয়। যতখানি খাটুনিতে যেটুকু ফসল ফলে, তরুণ প্রজন্মের কাছে তার আকর্ষণ নেই। ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে যাবে জনজাতির এই প্রথাটি। সেই সঙ্গে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে এই কৃষিপদ্ধতির যাবতীয় জ্ঞানও— তার তো কোনও লিখিত নথি নেই, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাহিত হয়ে এসেছে সেই জ্ঞান। কৃষিবিজ্ঞানীরা সেই জ্ঞানকে এক ভাবে সংরক্ষণ করতে পারেন। আর এক ভাবে করা যায়, যদি স্মৃতির ডিজিটাল ভান্ডারে জমা করে নেওয়া যায় এই চাষের সঙ্গে গোটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া মানুষদের অভিজ্ঞতার কথা। তা হলে, অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে কোনও দিন যদি বিজ্ঞানের মনে হয় যে, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কৃষি-সঙ্কটের থেকে বাঁচার একটা পথ হতে পারত ঝুম, তার পথনির্দেশটুকু থাকবে।
লেখার শুরুতে যে লয়েন লুমের কথা বলেছিলাম, যাতে সারা সপ্তাহ খেটে এক জন বড় জোর পাঁচশো টাকা উপার্জন করতে পারেন, বাজারের ঝাপটা সামলাতে পারবে না তা-ও। পারার দরকারও নেই— জনজাতির ঐতিহ্য বজায় রাখার দায় মাথায় নিয়ে কেউ তীব্র দারিদ্রের জীবন কাটাবেন কেন? কিন্তু, এই তাঁতের ব্যবহার বন্ধ হয়ে যেতে দেওয়া মানেই তো সেই প্রথার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা গল্পগুলোকেও হারিয়ে ফেলা? বুনোটের মধ্যে ত্রিভুজাকৃতি সাদা নকশা যে আসলে চাঁদের দেবীর চোখ, অথবা কাপড়ের প্রান্তে বুনে দেওয়া হাড়ের টুকরোগুলো যে আসলে কোনও না কোনও বিজয়াভিযানের স্মৃতিচিহ্ন, সে কথাগুলো তো জমিয়ে রাখা দরকার কোথাও? ডেইজ়ি মোমিনের সঙ্গে বাইক-সওয়ার অতিথিদের কথার রেকর্ডিং হতে থাকে। পাশাপাশি চলতে থাকে মেরির হাত, এক একটা লাইন তৈরি হয়ে ওঠে পাঁচ-সাত মিনিটের গভীর মনোযোগের ফসল হিসাবে। দেখতে দেখতে মনে হয়, কী বিপুল ধৈর্য আর পরিশ্রম ধরা থাকে একটা সামান্য মাফলারের মধ্যে, সেটা এক বার জানা হয়ে গেলে আর কখনও কোনও হাতে তৈরি বস্ত্রখণ্ডকে সাধারণ বা অসুন্দর ভাবা সম্ভব হবে না।
দিন ফুরোয়। গারো পাহাড় থেকে ফিরে আসে বাইকযাত্রীর দল। আশ্চর্য, সেই পাহাড়ও নেমে আসে তাদের সঙ্গেই— শহরে যায়, দৈনন্দিনতায় ঘুরে-ফিরে দেখা দেয়। সেই পাহাড়ের কথা বলিয়ে নেয় পাঁচ জনের সামনে। স্মৃতির সম্প্রসারণ ঘটতে থাকে। হয়তো আরও কেউ কেউ বোঝে, যাঁদের জায়গায় বেড়াতে যাই, তাঁদেরও সেই পর্যটনের শরিক করে নেওয়াই যায়। সহমানুষের মর্যাদায়।