Durga Puja 2023

‘বিশ্বের সেরা উৎসব’?

দুর্গোৎসব তার ধর্মীয় কাঠামোয় সমাজের সকল শ্রেণির যোগদান নিশ্চিত করেই সমন্বয়ের এই বার্তা দিয়ে থাকে। সে জন্যই বাংলার দুর্গাপুজোয় বিভিন্ন ধরনের বৃত্তিজীবী মানুষের অংশগ্রহণ নির্দিষ্ট করা রয়েছে।

Advertisement

অমিতাভ পুরকায়স্থ

শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২৩ ০৫:০১
Share:

‘আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসাবে ইউনেস্কো-র স্বীকৃতি কলকাতার দুর্গোৎসবকে নিশ্চিত ভাবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান দিয়েছে। —ফাইল চিত্র।

গত বছরের একটি পুজোর স্মারক পুস্তিকা হাতে পড়ল সে দিন। উল্টেপাল্টে দেখতে গিয়ে চোখে পড়ল একটা লাইনে দাবি করা হচ্ছে, ইউনেস্কো নাকি কলকাতার দুর্গাপুজোকে ‘বিশ্বের সেরা উৎসব’ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা কি না তার খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেল, আরও বহু জায়গায় এমন কথা ভেসে বেড়াচ্ছে। এমন দাবির সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে এই স্বীকৃতি আদায়ের কৃতিত্ব দাবির ইঙ্গিতও।

Advertisement

‘আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসাবে ইউনেস্কো-র স্বীকৃতি কলকাতার দুর্গোৎসবকে নিশ্চিত ভাবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান দিয়েছে। সেই সঙ্গে আরও একটা জিনিস খেয়াল করতে হবে। ইউনেস্কো-র ওয়েবসাইট বলছে, পারম্পরিক বা প্রাচীন ঐতিহ্যের পাশাপাশি সমাজের বিবিধ গোষ্ঠীর স্বতঃস্ফূর্ত অনুশীলনের ফলে সমকালীন ও প্রাণবন্ত সংস্কৃতিগুলিও গুরুত্ব সহকারে সংরক্ষণ করা দরকার। বিশেষ করে বিশ্বায়নের ফলে চাপে পড়ে যাওয়া আঞ্চলিক বিবিধতা ও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় বজায় রাখার অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো, সামাজিক সমন্বয় অর্জনের লক্ষ্যে সংস্কৃতির ভূমিকাও মনে করিয়ে দিতে চায়।

দুর্গোৎসব তার ধর্মীয় কাঠামোয় সমাজের সকল শ্রেণির যোগদান নিশ্চিত করেই সমন্বয়ের এই বার্তা দিয়ে থাকে। সে জন্যই বাংলার দুর্গাপুজোয় বিভিন্ন ধরনের বৃত্তিজীবী মানুষের অংশগ্রহণ নির্দিষ্ট করা রয়েছে। ঔপনিবেশিক যুগে এসে তাই ভিন্ন ধর্মের মানুষও এই উৎসবে খুব সহজেই শামিল হয়ে গিয়েছেন। ধর্মীয় আচারের সমান্তরালে আনন্দ ও উদ্‌যাপনের এক স্বতন্ত্র পরিসর তৈরি হয়েছে, যা নানা আর্থ-সামাজিক বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে রূপ পেয়েছে আজকের বিশাল ‘স্ট্রিট আর্ট ফেস্টিভ্যাল’-এ।

Advertisement

সারা ভারতে যে নবরাত্রি পালন করা হয়, শাস্ত্রীয় ও তাত্ত্বিক দিক থেকে দুর্গাপুজো তার অংশ হলেও, সমাজ-বিবর্তনের নিয়মে বাংলায় তা উৎসবের চেহারা নিয়েছে। তার সঙ্গে এও খেয়াল রাখতে হবে, বাঙালির আত্মপরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে এই উৎসব। প্রতিমা নির্মাণ থেকে শুরু করে ভোগ-নৈবেদ্য, আরতি, বিসর্জনের মতো নানা শাস্ত্রীয় আচারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শুধু আঞ্চলিকই নয়, পারিবারিক প্রথা ও কুলাচারও। দেবীর ধ্যানমন্ত্র অনুসারী প্রতিমাই তো তেমন তৈরি হতে দেখা যায় না— কোথাও স্বপ্নাদেশ তো কোথাও অকালে হারানো বাড়ির মেয়ের আদলে তৈরি হওয়া চিন্ময়ী মূর্তির আরাধনা হয়ে আসছে দুই শতক বা আরও বেশি সময় ধরে। এই অনন্য সাংস্কৃতিক পরিচয়কে বাঁচিয়ে রাখার বার্তাটাই কিন্তু ইউনেস্কো-র দেওয়া সম্মানের অন্তরকথা।

ইউনেস্কো-র সম্মান এই অনন্যতাকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার সুযোগ করে দিয়েছে। আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর সুযোগও এসেছে। কিন্তু সে জন্য সর্ব স্তরে যে সমন্বয় ও পরিকল্পনা প্রয়োজন, সেখানে রীতিমতো ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এই পুজো-পুজো ভাবকে কেন্দ্র করে বিশেষত সমাজমাধ্যমে প্রচুর ‘কনটেন্ট’ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু ঘুরেফিরে সেই কুমোরটুলি, হলুদ ট্যাক্সি, গঙ্গার ঘাট— তার বাইরে কেউ যেতে পারছেন না। অথচ কুমোরটুলি ছাড়াও কলকাতার বহু প্রাচীন ঐতিহ্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরে, তাদের সংরক্ষণের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের সুযোগ আছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় কুমোরটুলি ও আশপাশে বিষ্ণুরাম চক্রবর্তীর মন্দিরগুচ্ছ, বা বনমালী সরকারের বাণেশ্বর শিবমন্দিরের মতো প্রাচীন ভগ্নপ্রায় স্থাপত্যগুলির সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা।

পুজোর সঙ্গে যুক্ত থাকেন প্রতিমাশিল্পী ছাড়াও আরও নানা ধরনের শিল্পী-কারিগররা। তাঁদের কাজ, জীবনসংগ্রামের কথা আজও তত উঠে আসছে না মূলধারার বা বিকল্প প্রচারমাধ্যমে। মাটির বাসন বাঁশ চাটাই থার্মোকল শোলা নিয়ে কাজ করেন যাঁরা, তাঁরাও গুরুত্বপূর্ণ এই উৎসবে। যে পরিযায়ী শ্রমিকেরা উৎসবের মরসুমে নানা ধরনের ঠিকা কাজে যুক্ত হন, তাঁদের কথাও তেমন বলা হয় না। অথচ উৎসবকে সামগ্রিক ভাবে তুলে ধরতে সার্বিক পরিকল্পনা করারই দরকার ছিল। সেই পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের অভাব অনুভূত হয় প্রতি পদে। কলকাতার পুজো ঘুরিয়ে দেখানোর কাজে যে সব ভ্রমণ সংস্থা যুক্ত, তাদের কাজ দেখেও মনে হয় যেন আর কিছু নয়, বাণিজ্যিক হিন্দি ও বাংলা ছবি দুর্গাপুজোর যে ছাঁচ তৈরি করে দিয়েছে, সেটাই অনুসরণ করে চলেছে। বেশির ভাগ সময়ে অতিথিদের সামনে উৎসবের অভিনবত্ব বা চোখ-ধাঁধানো চমক তুলে ধরার আগ্রহই থাকে ষোলো আনা, তুলনায় বাঙালির দুর্গাপুজো উদ্‌যাপনের অনন্য বিশিষ্টতার উপর আলোকপাতের প্রয়াস থাকে ছিটেফোঁটা।

আসলে এই সব কিছু ছাপিয়ে আমরা যেন একটা প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ছি। পুজো উদ্যোক্তারা দৃশ্যতই আছেন হরেক পুরস্কার, প্রশংসা সম্মানের দৌড়ে, আর দর্শক ব্যস্ত সমাজমাধ্যমে রিল-ভিডিয়োর ‘ভিউ’ সংগ্রহের দৌড়ে। এই মানসিকতাই জন্ম দিচ্ছে দুর্গাপুজোকে ‘বিশ্বের শ্রেষ্ঠ উৎসব’ দেগে দেওয়ার মতো আত্মকেন্দ্রিক দাবিকে— দুর্গাপুজোর গুরুত্বকে আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকার করে নেওয়ার পিছনে যে সমাজদর্শন, তা ক্রমশ চলে যাচ্ছে ক্রমে আলোচনা ও মনোযোগের বাইরে। এত বড় এক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় এ হয়তো বা বাঙালির সাময়িক উচ্ছ্বাস। হয়তো সেটা থিতিয়েও যাবে সময়ে। আসল কাজটা অন্য। সরকার, পুলিশ, পুজো উদ্যোক্তা, শিল্পী, ইতিহাসবিদ, নাগরিক গোষ্ঠী সবার এক সঙ্গে বসে পরিকল্পনা— দুর্গাপুজোর অনন্যতা তুলে ধরার পাশাপাশি এই শহর ও রাজ্যের নানা ‘ঐতিহ্য’-এর সংরক্ষণ ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের প্রয়াসে ব্রতী হওয়া।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement