—প্রতীকী ছবি।
খবরের কাগজের প্রবন্ধ, টেলিভিশনের তর্ক পেরিয়ে গ্রোস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা ‘জিডিপি’ কথাটা এখন চায়ের দোকানের আড্ডাতেও ঢুকে পড়েছে। আমরা জেনেছি, জিডিপি-র পরিমাপ হল কোনও একটা দেশের আর্থিক স্বাস্থ্য বোঝার মাপকাঠি। উন্নতির সূচক হিসাবে জিডিপি-র উল্লেখ তো একটা আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি বলা চলে। আমেরিকার কমার্স ডিপার্টমেন্ট তো ১৯৯৯ সালেই বলেছিল যে, জিডিপি নাকি বিশ শতকের অন্যতম সেরা ‘আবিষ্কার’। অনেকে আবার জিডিপি-কে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে পার ক্যাপিটা বা মাথাপিছু জিডিপি-কেই সূচক হিসাবে ভাবতে চান। কেন, তা ভারতের মতো দেশের হিসাব দেখলেই স্পষ্ট হবে— মোট জিডিপি-র অঙ্কে ভারত দুনিয়ায় পাঁচ নম্বরে, যা নিয়ে শাসকদের গর্বের শেষ নেই; কিন্তু মাথাপিছু জিডিপি-র হিসাবে ১৪০-এরও পরে।
জিডিপি যে কিছু অতিধনীর সম্পদ দ্বারা অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হয়, তা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। আমেরিকায় ১৯৮৪-র তুলনায় ২০২০-তে মাথাপিছু জিডিপি বেড়েছে ১৭২%, আর সেই একই সময়কালে আমেরিকার ‘মিডিয়ান ইনকাম’— অর্থাৎ দেশের সব মানুষকে সবচেয়ে কম আয় থেকে সবচেয়ে বেশি আয়ের হিসাবে পর পর দাঁড় করিয়ে দিলে সেই লাইনের ঠিক মাঝখানে যিনি থাকবেন, তাঁর আয়— বেড়েছে মাত্র ১২৭%। প্রশ্ন তাই উঠবেই, জিডিপি কি আমজনতার উন্নতি পরিমাপের ভরসাযোগ্য সূচক হতে পারে? প্রশ্নটি আজকের নয়। ১৯৬৮ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে তাঁর প্রথম প্রচার-বক্তৃতায় রবার্ট ফ্রান্সিস ‘ববি’ কেনেডি ‘জিডিপি’-র দোসর ‘জিএনপি’ সম্পর্কে বললেন, এটা সংক্ষেপে সব কিছুই পরিমাপ করে, কেবলমাত্র যা আমাদের জীবনকে ‘অর্থপূর্ণ’ করতে পারে সেগুলি ব্যতিরেকে। কেনেডির এই সমালোচনার সুর অনুরণিত হয়েছে রাষ্ট্রনায়ক, অর্থনীতিবিদ, এমনকি বহু নোবেল-বিজেতার কণ্ঠেও।
আসলে একুশ শতকের প্রযুক্তি আর উদ্ভাবনার উত্তাল স্রোতে ভেসে ১৯৪০-এর দশকের কোনও সূচকের সাহায্যে অর্থনীতির গতিপ্রকৃতিকে মাপতে চাওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত, সে প্রশ্ন উঠবেই। জিডিপি ‘আবিষ্কার’-এর পটভূমি ছিল এক অশান্ত সময়। মহামন্দা এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে মাথা তুলেছিল জিডিপি-র ধারণা। অর্থনীতিবিদ সাইমন কুজ়নেটস-এর হাত ধরে, আর্থিক সমৃদ্ধির ব্যাখ্যার জন্য যিনি নোবেল পান ১৯৭১ সালে। আমেরিকান কংগ্রেসে জমা দেওয়া ১৯৩৪-এর এক রিপোর্টে কুজ়নেটস ব্যক্তি, সংস্থা এবং সরকারের সমস্ত উৎপাদনকে একযোগে পরিমাপ করতে চান এমনই একটি সংখ্যার দ্বারা, যার মান বৃদ্ধি পাবে সমৃদ্ধি-কালে আর কমতে থাকবে কঠিন সময়ে। সেই তো জিডিপি-র জন্মক্ষণ। তার পর মহাযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধখাতে বিভিন্ন দেশ কতটা অর্থ জোগাতে পারবে, তার পরিমাপই মুখ্য হয়ে ওঠে। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে জিডিপি-র হিসাবও। জনকল্যাণ তো শান্তিপর্বের বিলাসিতামাত্র! যুদ্ধ অবশ্য শেষ হয়। এবং কী আশ্চর্য, জিডিপি-র শিকড় আরও শক্ত হয়। দুনিয়াকে এক প্রকার নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে জিডিপি। এর একটা প্রধান কারণ, এ এক সহজ সূচক। কেবলমাত্র একটি সংখ্যাই অর্থনীতির হালহকিকত নির্দেশ করে। এর উল্লেখ সহজ; সহজ বিভিন্ন অর্থব্যবস্থার মধ্যে, বা একই অর্থব্যবস্থার বিভিন্ন সময়ের মধ্যে তুলনাও।
আজকের জিডিপি-আবিষ্ট দুনিয়ায় কোনও দেশের নীতি নির্ধারিত হয় জিডিপি-কে টেনে তোলার লক্ষ্যেই। কারণ, জিডিপি-তে সামান্য বদলও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে নির্বাচনে, প্রভাবিত করতে পারে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে, নির্দেশ করতে পারে দেশ আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ঋণ নিতে পারবে কি না, বা দেশ মন্দার কবলে পড়েছে কি না।
কিন্তু অমিত পরাক্রমশালী এই জিডিপি-র গঠনশৈলীতেই বিস্তর গলদ। যেমন, ২০১৩-র মাঝামাঝি আমেরিকা বদলে দিল জিডিপি পরিমাপের পদ্ধতি, আর দেশটার জিডিপি এক দিনেই বেড়ে গেল ৩%। ২০১০-এ ঘানা তাদের জিডিপি পরিমাপের তুলনার মাপকাঠিটাকে ১৯৯৩ থেকে বদলে করল ২০০৬, আর দেশটার জিডিপি একলাফে বেড়ে গেল ৬০%। কেমব্রিজের অধ্যাপক ডায়ান কোয়েল তাঁর ২০১৬-র বই জিডিপি: আ ব্রিফ বাট অ্যাফেকশনেট হিস্ট্রি-তে বলছেন, জিডিপি হয়তো বিশ শতকের পক্ষে উপযুক্ত পরিমাপই ছিল; কিন্তু উদ্ভাবন, পরিষেবা এবং অস্পষ্ট পণ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একুশ শতকের অর্থনীতির জন্য তা ক্রমেই হয়ে পড়েছে অনুপযুক্ত।
১৯৫৯-এ স্ট্যানফোর্ডের অর্থনীতিবিদ মোজ়েস আব্রামোভিজ় প্রশ্ন তোলেন জনহিত পরিমাপে জিডিপি-র উপযোগিতা নিয়ে। যদিও ১৯৩৪-এ একই কথা বলেন স্বয়ং কুজ়নেটস-ই। আসলে জিডিপি যে কেবলমাত্র জগৎ শেঠদের সম্পদের দ্বারা গভীর ভাবে প্রভাবিত তা-ই নয়, আমাদের জীবন এবং জীবনযাপনের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একেবারে চোখ বুজে থাকে এই অতি-গুরুত্বপূর্ণ সূচকটি। যেমন, পরিবেশ দূষণ, সামাজিক অসাম্য, স্বাস্থ্য-পরিষেবার হাল, সামাজিক অপরাধ, বা যানজটে সময়ের অপচয় পর্যন্ত কোনও কিছুতেই হেলদোল নেই প্রায় সর্বশক্তিমান জিডিপি-র। এমনকি কোভিড-উত্তর কালে বিভিন্ন দেশের অর্থব্যবস্থা যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, তখন তাদের অন্তর্নিহিত অসাম্য কতটা প্রকটতর হচ্ছে, তারও কোনও হদিস মিলবে না জিডিপি-র সংখ্যার মধ্যে। অবৈতনিক কাজেরও কোনও হিসাব নেয় না জিডিপি। ডায়ান কোয়েল যেমন বলেছেন, গৃহস্থালির কাজকর্মকে অর্থনৈতিক মানদণ্ডের নিরিখে যোগ করলে অনেক দেশেরই জিডিপি বেড়ে যাবে ২০% থেকে ৫০% পর্যন্ত।
জিডিপি-র পরিপূরক হিসাবে কিংবা তাকে প্রতিস্থাপিত করে ‘অর্থপূর্ণ’ সূচক তৈরির প্রচেষ্টা তাই চলতে থাকে। ১৯৭০-এর দশকে ভুটানের তৎকালীন যুবক রাজা জিগমে সিংগে ওয়াংচুক বললেন যে, তাঁরা বিশ্বাস করেন ‘গ্রোস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস’-এ। জিডিপি-র পরিবর্ত সন্ধানের দিশায় সে এক দিকচিহ্ন। তার পর ১৯৯০ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের অর্থনীতিবিদ মাহবুব উল হক আমাদের জীবনযাপনের ক্ষেত্রে জিডিপি-র চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক কোনও সূচক তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন অমর্ত্য সেনকে। তৈরি হল ‘হিউম্যান ডেভলপমেন্ট ইন্ডেক্স’। আজ অবশ্য জিডিপি-র বিকল্প হিসাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এসেছে নানা সূচক। চিনে ‘গ্রিন জিডিপি’, নিউ জ়িল্যান্ডের ‘লিভিং স্ট্যান্ডার্ডস ফ্রেমওয়ার্ক’, মেরিল্যান্ড বা ভারমন্টের মতো আমেরিকার কয়েকটি প্রদেশে ‘জেনুইন প্রোগ্রেস ইন্ডিকেটর’ ইত্যাদি। জিডিপি-র আওতা থেকে বার হওয়ার তাগিদেই। কিন্তু কোনও সূচক আন্তর্জাতিক স্তরে সর্বজনগ্রাহ্য না হলে বিভিন্ন অর্থব্যবস্থার, এমনকি একই অর্থব্যবস্থার বিভিন্ন সময়ের পরিস্থিতিরও তুলনা অসম্ভব। আর এই তুলনাটাও তো প্রয়োজন নানা কারণে।
নানা সময়ে জিডিপি-র বিকল্প খোঁজার চেষ্টা কিন্তু হয়েছে বেশ উঁচু পর্যায় থেকেই। প্রাক্তন ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজ়ি ২০ জনের একটা কমিটি নিয়োগ করলেন, যার নেতৃত্বে নোবেল-জয়ী জোসেফ স্টিগলিৎজ়, অমর্ত্য সেন আর ফরাসি অর্থনীতিবিদ জাঁ-পল ফিটৌসি। কমিটি রিপোর্ট দেয় ২০০৯ সালে। বলে, জীবনযাপনের গুণগত মানের পরিমাপ করার সময় যেন অসাম্যকে ঠিক ভাবে হিসাবে রাখা হয়। পরে এই কমিটির পরম্পরা ধরেই আর একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি নিয়োগ করে ‘দি অর্গানাইজ়েশন ফর ইকনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট’ (ওইসিডি), নেতৃত্বে স্টিগলিৎজ়, ফিটৌসি, এবং ওইসিডি-র মুখ্য রাশিবিজ্ঞানী মার্টিন ডুরান্ড। দু’টি রিপোর্ট, ‘বিয়ন্ড জিডিপি’ আর ‘ফর গুড মেজারস,’ প্রকাশিত হয় ২০১৮-য়। কোনও দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের মূল্যায়নে অতিরিক্ত জিডিপি-নির্ভরতা সরিয়ে পরিবর্তে সর্ব স্তরে ভাল থাকা এবং সুস্থায়িত্বকে প্রতিফলিত করবে, এমন একগুচ্ছ সূচক ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে রিপোর্টে। ২০২১-এ ‘আওয়ার কমন অ্যাজেন্ডা’ শীর্ষক রিপোর্টে রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেস-এরও এক সুর— উন্নতির পরিমাপের জন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন জিডিপি-র পরিপূরক কোনও সূচক। ২০৩০-এর মধ্যেই।
অর্থশাস্ত্রীরা ক্রমে বুঝতে আরম্ভ করেন যে, জনগণের ‘ভাল থাকা’কে মাপতে প্রয়োজনে বহুমাত্রিক সূচকেরও সাহায্য নিতে হতে পারে। কিন্তু জিডিপি-কে প্রতিস্থাপিত করে সর্বজনগ্রাহ্য এক বা একগুচ্ছ সূচক তৈরির জন্য ঠিক কী কী দেখা উচিত, এবং কী ভাবে সেই পরিমাপ করা উচিত, সে নিয়ে এখনও কোনও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি আন্তর্জাতিক স্তরে।
ফলে, জিডিপি-র অঙ্কের ওঠাপড়া দেখে উত্তেজিত না হয়ে আমরা বরং ভাবতে পারি, সেটা কার ভাল থাকার গল্প বলছে।