ইতিহাস: মহেঞ্জোদরোয় সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ। ফাইল চিত্র।
সেটা ১৭৮৬ সাল। ভারততত্ত্ববিদ উইলিয়াম জোনস আলোড়ন সৃষ্টি করলেন সংস্কৃতের সঙ্গে গ্রিক ও লাটিন ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক মিল তুলে ধরে। তাঁর গবেষণা দেখাল, একই আদিভাষা ক্রমে বহু শাখায় ভাগ হয়ে জন্ম দিয়েছে সংস্কৃত, প্রাচীন পারসিক, ইউরোপের বিভিন্ন ভাষার। ভাষাতত্ত্ববিদরা এর নাম দিয়েছেন ‘ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবার’। অথচ ঔপনিবেশিক রাজনীতির পাকেচক্রে ভাষাপরিবার হয়ে গেল একটি নরগোষ্ঠী (রেস)। নরগোষ্ঠীর ধারণাটি ঊনবিংশ-বিংশ শতকের ইউরোপে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল। ঔপনিবেশিক ইউরোপীয়রা প্রাণী বা উদ্ভিদের মতো মানুষকেও সাজিয়েছিল বিভিন্ন নরগোষ্ঠীতে। এর মূলে ছিল শ্বেতাঙ্গ, দীর্ঘদেহী, টিকলো নাক, সোনালি চুলের ‘ককেশীয়’ নরগোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা। ভাষাগোষ্ঠীকে নরগোষ্ঠীর সঙ্গে গুলিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘আর্যজাতি’-র ধারণা— যারা প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সভ্যতার পাশাপাশি বৈদিক সভ্যতারও পূর্বসূরি।
এই তত্ত্ব ছিল ঔপনিবেশিক রাজনীতির স্বার্থের উপযোগী। ইউরোপের প্রাচীন ‘আর্য সভ্যতা’ যেমন ‘বর্বর জাতিদের’ আক্রমণে ধ্বংস হওয়ায় এসেছিল ‘মধ্যযুগের অন্ধকার’, যার অবসান ঘটেছিল ‘নবজাগরণ’-এ প্রাচীন গ্রিক-রোমান ভাবধারার পুনরুজ্জীবনে; ভারতেও সংস্কৃতভাষী হিন্দু ‘আর্য সভ্যতা’র গৌরব অস্তমিত হয় ‘বহিরাগত’ মুসলমান আক্রমণে, আর সেই মধ্যযুগের অবসান ঘটাতে আসে ‘আর্য সভ্যতার উত্তরাধিকারী’ ইংরেজ— এমনই ধারণা তৈরি হয়। তৈরি হয় এক ভিন্ন রাজনীতি, যেখানে হিন্দু ভারতীয়ের কাছে প্রতিবেশী মুসলমান হয়ে ওঠে ‘বহিরাগত আক্রমণকারী’, আর সাগরপারের ইংরেজ শাসক হন পরমাত্মীয়। ভারতের মুসলমান শাসকদের সরকারি ভাষা ছিল ফারসি, যা সংস্কৃতের ঘনিষ্ঠতম ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা প্রাচীন পারসিকের বিবর্তিত রূপ, এ কথাও চাপা পড়ে যায় এই রাজনীতিতে।
এ দিকে, ভারতীয় উপমহাদেশের সব ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় নয়। দ্রাবিড়ীয়, অস্ট্রিক, তিব্বতি-বর্মি— নানা ভাষাগোষ্ঠীর বাস এখানে। ১৯২০-র দশকে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদরোর আবিষ্কার সামনে আনে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের এক নগরসভ্যতাকে। এ দিকে পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য (সাম, যজুঃ, অথর্ববেদের সংহিতা এবং বিভিন্ন ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ) যে জনপদগুলির উল্লেখ করে, তাদের উৎপত্তি খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের প্রথমার্ধে। ঋগ্বেদ-সংহিতা প্রাচীনতর হলেও বড়জোর খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শেষভাগের। হরপ্পা সভ্যতার নাগরিক ও কৃষিজ অর্থনীতি, দেবীমূর্তিপূজা, গৃহপালিত ঘোড়ার অনুপস্থিতির সঙ্গে ঋগ্বৈদিক সভ্যতার যাযাবর পশুচারণনির্ভর অর্থনীতি, ঘোড়ার গুরুত্ব, যজ্ঞকেন্দ্রিক পুরুষপ্রধান ধর্মবিশ্বাস প্রভৃতির তফাত সহজেই চোখে পড়ে। ঘোড়া ও ঘোড়ায় টানা রথে বলীয়ান ইন্দো-ইউরোপীয়দের আক্রমণেই কি খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে ভেঙে পড়ে হরপ্পীয় নগরগুলি?
ঔপনিবেশিক রচনার আর্য আক্রমণ তত্ত্ব এক কালে জনপ্রিয় হলেও কিন্তু একটি বিস্তীর্ণ নাগরিক সভ্যতার ধ্বংস ঘটানোর মতো সামরিক আক্রমণের কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নেই। লম্বা, ফর্সা, টিকলো নাকের আর্যদের সঙ্গে বেঁটে, কৃষ্ণকায় ‘অনার্য’দের বৈপরীত্যের প্রমাণও ঋগ্বেদে বেশি মেলে না। বরং বৈদিক ‘আর্য’ শব্দটি মূলত একটি ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে বোঝাত, যা প্রতিদ্বন্দ্বী ‘দাস’ ও ‘দস্যু’-র থেকে আলাদা।
হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা দাবি করেন, বৈদিক ও হরপ্পা সভ্যতা অভিন্ন, এবং ঋগ্বেদের রচনাকাল সুপ্রাচীন। বৈদিক সভ্যতার মানুষের কাছে কৃষি বা নগরজীবন অজানা ছিল না। হরপ্পা সভ্যতার কোনও কোনও প্রত্নক্ষেত্রে বৈদিক যজ্ঞকুণ্ডের অনুরূপ নিদর্শনও মেলে। এই সভ্যতার বহু প্রত্নক্ষেত্র পাওয়া গিয়েছে অধুনাশুষ্ক হকরা-ঘগ্গর নদীখাত (অধুনালুপ্ত সরস্বতী নদী?) ঘিরে। সরস্বতী ঋগ্বেদেও এক গুরুত্বপূর্ণ নদী। অথচ, এ নদী শুকিয়ে যায় খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের গোড়াতেই। তাই খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের নাগরিক সভ্যতার সঙ্গে বৈদিক সভ্যতাকে অভিন্ন মনে করে, ‘সিন্ধু সভ্যতা’-র বদলে ‘সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা’ শব্দবন্ধ ব্যবহারের পক্ষপাতী এঁরা। তবে কি ভারতীয় উপমহাদেশ থেকেই এশিয়া-ইউরোপের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল ইন্দো-ইউরোপীয়রা? তাও বলা চলে না।
দ্রাবিড়ীয় ভাষায় মূর্ধন্য ব্যঞ্জনধ্বনির (ট, ঠ, ড, ঢ, ণ, ষ) ব্যবহার সংস্কৃতে থাকলেও অধিকাংশ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় নেই। ভারতীয় উপমহাদেশের ভাষাগোষ্ঠীগুলির এই প্রভাব অন্যান্য ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাতেও থাকত, যদি এখান থেকেই তারা ছড়িয়ে পড়ত। তুরস্কের বোগাজ়কোইতে প্রাপ্ত খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতকের একটি লেখ-এ বৈদিক দেবতাদের নাম পাওয়া যায়, ঋগ্বেদের ভাষার থেকে প্রাচীনতর ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষারূপে। তাই ঋগ্বেদের সময়কাল তার চেয়ে পুরনো হওয়া অস্বাভাবিক। সরস্বতী নামটিও কোনও নিশ্চিত প্রমাণ নয়— এ নামে একাধিক নদী ছিল (যার একটি আফগানিস্তানে, বৈদিক আর্যদের পরিচিত এলাকায়)।
আধুনিক বিজ্ঞান ‘রেস’-এর ধারণা বাতিল করে দেখায় যে, সমস্ত মানুষ একটি অভিন্ন প্রজাতিভুক্ত, এবং সমস্ত মানুষেরই উৎস আফ্রিকায়। পারস্পরিক রক্তসংমিশ্রণ ঘটেনি, এমন কোনও জনগোষ্ঠী পৃথিবীতে নেই। বরং পৃথিবীতে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের ইতিহাস আসলে আফ্রিকা থেকে মানুষের ছড়িয়ে পড়ার, বিভিন্ন গোষ্ঠীর নানা অঞ্চলে পরিযাণ ও সংমিশ্রণের ইতিহাস। এই ইতিহাস ধরা থাকে মানুষের জিনের মধ্যে থাকা ডিএনএ-তে, বিশেষ করে মা থেকে মেয়ের দেহে সঞ্চারিত মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ এবং বাবা থেকে ছেলের দেহে সঞ্চারিত ওয়াই ক্রোমোজ়মে। কোনও একটি অঞ্চলের অধিবাসীদের ডিএনএ কোনও নতুন উপাদানের ছাপ সাক্ষ্য দেয় সেই অঞ্চলে নতুন পরিযায়ী গোষ্ঠীর পদার্পণের। যেমন, পশ্চিম এশিয়া থেকে পূর্ব-মধ্য ইউরোপ পর্যন্ত এলাকার অধিবাসীদের জিনে উপস্থিত ‘আর১এ১এ’ ভারতীয় উপমহাদেশের অধিবাসীদের জিনেও পরিলক্ষিত হয় খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের পরে। এই উপাদানের উপস্থিতি উত্তর ও পশ্চিম ভারতের অধিবাসীদের মধ্যে এবং উচ্চবর্ণ হিন্দুদের মধ্যে অধিকতর। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের আগেকার দেহাবশেষগুলিতে, যেমন রাখিগর্হি নামের হরপ্পীয় প্রত্নক্ষেত্রটিতে প্রাপ্ত দেহাবশেষটিতে, এই উপাদান অনুপস্থিত।
অন্য দিকে, এর অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে প্রায় চার হাজার বছর আগে ইউরেশীয় তৃণভূমি থেকে পশ্চিমে মধ্য এশিয়ার দিকে ছড়িয়ে পড়া প্রাচীন সিন্তাশতা ও অ্যান্ড্রোনোভো সংস্কৃতির অধিবাসীদের মধ্যে। তাই এর বাহকদের প্রাচীন পরিযাণপথ নির্দেশ করা যায় সহজেই। এই আনুমানিক পরিযাণপথের মধ্যে অবস্থিত স্রুবনা সংস্কৃতির সমাধিগুলিতে পাওয়া দেহাবশেষগুলিতেও ‘আর১এ১এ’ দেখা যায়, কিন্তু এদের মধ্যে দক্ষিণ এশীয়দের থেকে আসা কোনও জিনগত বৈশিষ্ট্য দেখা যায় না। হয়তো এই বৈশিষ্ট্যের বাহকগোষ্ঠীর উৎপত্তি দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, ইউরেশীয় তৃণভূমিতে। সব মিলিয়ে জিনগত সাক্ষ্য বলে, খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের পরে ইউরেশীয় থেকে মধ্য এশিয়া ও ইরান হয়ে একটি গোষ্ঠী দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবেশ করে।
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম দু’টি সহস্রাব্দে উত্তর ভারতের ইতিহাস বহু গোষ্ঠীর সচলতার ইতিহাস। বিস্তীর্ণ হরপ্পা সভ্যতার উত্তর-পশ্চিমভাগ ছুঁয়ে গিয়েছিল ইন্দো-ইরানীয় অঞ্চলের পূর্বপ্রান্ত। তাই উভয়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আদানপ্রদানের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দাস ও দস্যুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা যেমন ঋগ্বেদে রয়েছে, তেমনই বৈদিক যজ্ঞের পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে দাস বলবূথ ও তরুক্ষের উল্লেখ। জিন-গবেষণা শুধু ওয়াই ক্রোমোজ়মেই ‘আর১এ১এ’-র উপস্থিতির সাক্ষ্য দেয়, মাইটোকন্ড্রিয়ার ডিএনএ-তে তার ছাপ নেই। তবে কি পরিযায়ী পশুপালকেরা ছিলেন মুখ্যত পুরুষ, যাঁরা প্রায়শই মিলিত হয়েছেন স্থানীয় ‘দাস’ গোষ্ঠীভুক্ত নারীদের সঙ্গে? তাঁদের সন্তানেরা পেয়েছে সামাজিক স্বীকৃতিও? কবষ ঐলূষ থেকে সত্যকাম জাবাল— বৈদিক সাহিত্যে মাতৃপরিচয়ে পরিচিত ‘দাসীপুত্র ব্রাহ্মণ’-দের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়।
বৈদিক আর্যরা কোনও আকস্মিক আক্রমণে ধ্বংস করে দেননি হরপ্পীয় নগরগুলি। আবার তাঁরা এই উপমহাদেশের আদিবাসিন্দাও নন। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে হরপ্পীয় নগরগুলির অবক্ষয়ের সুযোগে বিভিন্ন পরিযায়ী গোষ্ঠী ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে। যে সভ্যতা তারা গড়ে তোলে তার পর, তা এক মিশ্রসংস্কৃতি— তা যেমন আর্য পুরুষদের, তেমন ‘দাস’ নারীদেরও।
সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়