সাংবাদিকের নৈতিকতা, পেশাদারিত্বের দুটো পরীক্ষা ছিল এ বছর
Journalists

কলমে আইনের ফাঁস

পশ্চিমবঙ্গে এ বছর জেলায় জেলায় সাংবাদিকরা রাস্তায় নামেন সাংবাদিক গ্রেফতারের প্রতিবাদে। এক কঠিন ধারায় গ্রেফতার করা হয় সাংবাদিক দেবমাল্য বাগচীকে।

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৯:১২
Share:

স্পষ্টভাষ: প্রেস ক্লাবের সামনে সাংবাদিক ও সমাজকর্মীদের প্রতিবাদ সমাবেশ, দিল্লি, ৫ অক্টোবর। পিটিআই।

আগামী কাল, ২৭ ডিসেম্বর, সাংবাদিক প্রবীর পুরকায়স্থের বন্দিদশার পঁচাত্তর দিন পূর্ণ হবে। এই ক’দিনে বোঝা গেল যে, এই বর্ষীয়ান সম্পাদক একই সঙ্গে ঠিক, এবং ভুল। তাঁর আত্মজীবনীতে (কিপিং আপ দ্য গুড ফাইট, ২০২৩) তিনি লিখেছিলেন, ডিজিটাল যুগে খবর পরিবেশনের উপায় বিচিত্র, অসংখ্য। তাই ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ইমার্জেন্সির সময়ে যে ভাবে খবর ‘সেন্সর’ করত, আজ আর তা সম্ভব নয়। এখন অল্প ক’জন বেসুরো সাংবাদিককে জেলবন্দি করে ‘দৃষ্টান্ত’ তৈরি করছে সরকার, যাতে অন্যদের হাড় হিম হয়। নিজের তত্ত্ব ঠিক প্রমাণ করে ৩ অক্টোবর ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম ‘নিউজ়ক্লিক’-এর কর্ণধার প্রবীরবাবু নিজেই ইউএপিএ ধারায় অভিযুক্ত হয়ে জেলে গেলেন। সেই সঙ্গে বিরূপ সংবাদের প্রতি সরকারের প্রতিক্রিয়া ‘দু’একটি দৃষ্টান্ত’-র চৌকাঠ পেরিয়ে গেল। এই সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত চল্লিশ জনেরও বেশি সাংবাদিক, প্রতিবেদককে জেরা করল পুলিশ, দু’শোরও বেশি ল্যাপটপ, স্মার্টফোন বাজেয়াপ্ত করল। সরকারি প্রতিক্রিয়ার এই মাত্রা অভূতপূর্ব।

Advertisement

২০১৯-পরবর্তী সময়ে কাশ্মীরে সরকারি বয়ানের বিরোধিতাকে যে ভাবে ‘অপরাধ’ করে তুলেছে পুলিশ-প্রশাসন— সাংবাদিকদের গ্রেফতার করেছে, সংবাদপত্রের দফতরে তালা দিয়েছে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সিল করেছে— ২০২৩ সালে বাকি ভারতে তার ছায়া আরও গাঢ় হল। গুজরাত দাঙ্গায় নরেন্দ্র মোদীর ভূমিকা নিয়ে বিবিসি-র তথ্যচিত্র (ইন্ডিয়া: দ্য মোদী কোয়েশ্চন) জানুয়ারিতে কেন্দ্র নিষিদ্ধ করল, ফেব্রুয়ারিতে বিবিসি-র মুম্বই ও দিল্লির দফতরে আয়কর দফতর হানা দিল। কত টাকা কর ফাঁকি দিয়েছিল বিবিসি, তা অবশ্য জানা যায়নি। তবে কিছুটা এই ঘটনার জেরেই সংবাদ স্বাধীনতা সূচকে এক লাফে এগারো ঘর পিছিয়ে এ বছর ভারত দাঁড়াল ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬১তম স্থানে।

সাংবাদিকের অকারণ হয়রানির বিরুদ্ধে সরব হয়েছে আদালতও। এপ্রিলে ‘মিডিয়া ওয়ান’ মালয়লি চ্যানেলের লাইসেন্স পুনর্বহাল করে সুপ্রিম কোর্ট বলে, সরকারের সমালোচনা প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা নয়, আর স্রেফ হাওয়া থেকে ‘জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকি’ তৈরি করা যায় না। সন্ত্রাসে অভিযুক্ত হয়ে ছ’শো দিন জেলে ছিলেন ‘দ্য কাশ্মীরওয়ালা’ সংবাদ-ওয়েবসাইটের সম্পাদক ফাহাদ শাহ্। নভেম্বরে তাঁকে জামিনের নির্দেশ দিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরের হাই কোর্ট বলে, কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনাকে সন্ত্রাসবাদী কাজ বলে ধরা চলে না।

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গে এ বছর জেলায় জেলায় সাংবাদিকরা রাস্তায় নামেন সাংবাদিক গ্রেফতারের প্রতিবাদে। এক কঠিন ধারায় গ্রেফতার করা হয় সাংবাদিক দেবমাল্য বাগচীকে। খড়্গপুরে অবৈধ মদের ভাটি নিয়ে খবর করেছিলেন তিনি। ন’দিনের মাথায় জামিন পেয়ে তিনি কাজে ফিরেছেন। তবে এমন চাপের মুখে বহু সুপরিচিত সাংবাদিক সরে গিয়েছেন বড় মিডিয়া থেকে। যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের একটা বড় অংশ মগজে কুলুপ এঁটে সরকারি বয়ান প্রচার করছেন। বিভাজন এতটাই, যে সেপ্টেম্বরে বিজেপি-বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোট তৈরির পরে এক মুখপাত্র ঘোষণা করেন, চোদ্দো জন নিউজ় অ্যাঙ্করের অনুষ্ঠান বয়কট করবে জোটসঙ্গী দলগুলো। এ হয়তো সাংবাদিকের নিরপেক্ষতার অভাবের প্রতিক্রিয়া, তবু অস্বস্তিকর— প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও কেবল বাছাই সাংবাদিককেই সাক্ষাৎকার দেন!

সাংবাদিকের নৈতিকতা ও পেশাদারিত্বের দুটো বড় পরীক্ষা এসেছিল এ বছর। প্রথমটি মণিপুরের তীব্র জাতিদাঙ্গা, যার শুরু মে মাসে। বেলাগাম হিংসার স্রোত চার-পাঁচ মাস ধরে চলে, কিন্তু রাজ্য ও কেন্দ্রের সরকারের উপর চাপ বাড়ানোর বদলে, ভারতের অধিকাংশ প্রধান কাগজ, চ্যানেল ক্রমে মণিপুরকে অন্য খবরের পিছনে ঠেলে দেয়। মোড় ফেরে ১৯ জুলাই, যখন দুই কুকি আদিবাসী মহিলাকে সর্বসমক্ষে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের একটি ভিডিয়ো ভাইরাল হয়, আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় শোরগোল ওঠে। ভারতীয় সম্পাদকদের সংগঠন এডিটর্স গিল্ড-এর তিন সদস্য মণিপুরে গিয়ে কথাবার্তা বলে প্রতিবেদনে লেখেন যে, ইম্ফলের মিডিয়া কার্যত ‘মেইতেই মিডিয়া’ হয়ে গিয়েছে। ইন্টারনেট বন্ধ, সাংবাদিকদের পক্ষপাত, দু’য়ে মিলে পাহাড়ের আদিবাসীদের বিপন্নতা উপেক্ষিত হয়েছে খবরে। সেপ্টেম্বরে এই রিপোর্ট বার হওয়ামাত্র গিল্ডের সদস্যদের বিরুদ্ধে এফআইআর করে মণিপুরের পুলিশ। অভিযোগ, তাঁরা বিদ্বেষ উস্কোচ্ছেন, ভ্রান্ত তথ্য দিচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহ এডিটর্স গিল্ডকে ‘অ্যান্টিন্যাশনাল’ বলেন।

অপর পরীক্ষাটি ছিল হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের প্রকাশ, যাতে ছিল প্রধানমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ আদানি গোষ্ঠীর দুর্নীতি নিয়ে বিশদ বিবরণ। একটি অসরকারি সংস্থার সমীক্ষা দেখিয়েছে, ২৫ জানুয়ারি রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার পরের দু’দিন প্রধান ইংরেজি কাগজগুলি খবরটি প্রথম পাতায় বার করে। তবে বহু টিভি চ্যানেল ওই রিপোর্ট উপেক্ষা করে। এতে সংবাদের উপর মালিক গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ কতখানি, সে প্রশ্ন ফের প্রবল হয়।

কিছু সাংবাদিককে ‘দৃষ্টান্ত’ করাই সরকারের হাতে সংবাদে রাশ টানার উপায়, এই চিন্তাকে এ বছর ছাড়িয়ে গিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। কার্যত বিতর্ক ছাড়াই ডিসেম্বরে টেলিকমিউনিকেশনস বিল পাশ হল সংসদে। ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, এর ফলে কেবল খবর নয়, সমাজমাধ্যমের কথাবার্তাও এল সরকারি নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণে। কী কী কারণে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারে, তার শর্তগুলি এতই আবছা আইনে যে, ব্যক্তিগত কথোপকথন, ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা কৌতুক-নকশা, এমনকি ব্যক্তিগত ইমেল-এও সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

টেলিকম প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের বায়োমেট্রিক পরিচিতি ব্যবহারেও জোর দিয়েছে আইন। ফলে সাংবাদিকদের পক্ষে সংবাদের সূত্রের গোপনীয়তা রক্ষা করা কঠিন হবে। সমাজমাধ্যম অ্যাপ-এর মালিক সংস্থাগুলিকে ভারত সরকার বাধ্য করতে পারে গ্রাহকের সংলাপ প্রকাশ করতে, প্রেরণকারীর তথ্য দিতে। তেমনই, সম্প্রতি পাশ-হওয়া পোস্ট অফিস বিল ডাকব্যবস্থার মাধ্যমে পাঠানো যে কোনও বস্তু খোলার ক্ষমতা দেয় সরকারকে। এ সবই সরকার করতে পারে ‘নিরাপত্তা’ বা ‘জনস্বার্থ’ রক্ষার জন্য। তবে সরকারের ভাবগতিক যেমন, তাতে সাংবাদিকের বাক্‌স্বাধীনতার নিরাপত্তা, নাগরিকের তথ্যের গোপনীয়তা নিয়ে শঙ্কা জাগে বেশি। সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে খসড়া ব্রডকাস্টিং বিল, যা নিয়ন্ত্রণ করতে চায় ইন্টারনেটে প্রচারিত সব কিছুকেই— ওটিটি-র ছায়াছবি, ইউটিউব-এর ভিডিয়ো, আবার ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমকেও! এমন ‘কম্বো-প্যাক’ তৈরি করে যে খবরকেও সেন্সর বোর্ডের ধাঁচে তৈরি এক ‘কনটেন্ট ইভ্যালুয়েশন কমিটি’-র অধীনে আনা যেতে পারে, তা এত দিন ছিল অকল্পনীয়।

লক্ষণীয়, এ বছরই বাংলাদেশ ‘ডিজিটাল সিকিয়োরিটি অ্যাক্ট, ২০১৮’ খারিজ করেছে। দুশোরও বেশি সাংবাদিক অভিযুক্ত, পঞ্চাশেরও বেশি গ্রেফতার হয়েছেন এই আইনে। নতুন আইনে মানহানির জন্য জেলে দেওয়ার ধারা বাতিল করে রাখা হয়েছে কেবল জরিমানা, কমেছে অন্যান্য শাস্তির তীব্রতাও। তবে নতুন আইনটিরও
প্রত্যাহার চেয়ে সে দেশের সাংবাদিকরা লড়াই চালাচ্ছেন। তাঁদের দাবি, সেটিও বাক্‌স্বাধীনতাকে ব্যাহত করে।

ডিজিটাল দুনিয়া প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে সকলের কণ্ঠ শোনা যাবে, গণতন্ত্র আরও মজবুত হবে, এই স্বপ্ন আবছা হয়ে এল ২০২৩ সালে। ফের দেখা গেল, প্রযুক্তি হয়ে উঠছে ক্ষমতাসীনের অস্ত্র, নজরদারির উপায়। প্রায় দু’বছরের ইউক্রেন যুদ্ধে এখনও অবধি আঠারো জন সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন, কিন্তু গাজ়ার যুদ্ধে নিহত এখনই আটষট্টি জন সাংবাদিক, সংবাদকর্মী। এআই প্রযুক্তি নাকি সাংবাদিকদের নিশানা করতে সাহায্য করছে ইজ়রায়েলকে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement