উল্লাস: নির্বাচনে জয়লাভের পর বিধানসভার সামনে কংগ্রেস কর্মীরা। ১৪ মে, বেঙ্গালুরু। ছবি: পিটিআই।
ভারত এক বৈচিত্রময় ফুলের তোড়া। ভারতীয় জনতা পার্টি তার মধ্যে সমন্বয় খুঁজেছিল শুধু একটি লক্ষণে, যা হল ধর্মপরিচয়, হিন্দুত্ব। সেখানে সংখ্যালঘু ধর্মের মানুষই যে শুধু ব্রাত্য, তা নয়— উচ্চবর্ণের হিন্দুদের পাশে স্থান নেই নিম্নবর্ণের হিন্দুদেরও। কর্নাটকের ১০ মে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির এই মধ্যযুগীয় রাজনৈতিক বিশ্বাসটিকে— প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জাতীয় মঞ্চে উত্থানের পর অনেক ভারতীয় যে বিশ্বাসটিকে ধ্রুব সত্য বলে ধরে নিয়েছিলেন— সাংঘাতিক ভাবে টলিয়ে দিয়েছে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। বিজেপির ‘হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থান’ গোছের জাতিচেতনার পথে কর্নাটকে ফের সরকার গঠন করতে পারা ছিল এক অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সোপান। কারণ দক্ষিণ ভারত দখলের জন্য সেই রাজ্যটিই হল তার সিংহদ্বার। এটি হাতছাড়া হওয়ার অর্থ আপাতত শুধু উত্তর ভারতের গঙ্গাবিধৌত অংশে, এবং হয়তো উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রান্তবর্তী অঞ্চলে, শিকলবদ্ধ থাকবে হিন্দুত্বের বিজয়রথ। বিজেপির ৩০৩ লোকসভা আসনের মাত্র ত্রিশটি আহৃত দক্ষিণের পাঁচটি রাজ্য থেকে। আর কত কাল পুরো দাক্ষিণাত্য রয়ে যাবে বিজেপির প্রভাব বলয়ের বাইরে?
কত কিছুই না ঘটতে পারে এই বিলম্বের দরুন! অবসর নিতেই পারেন অভিযানের প্রধান নায়ক নরেন্দ্র মোদী; স্বেচ্ছায় নিশ্চয়ই নয়— তবে, কর্নাটকের পর আর দু’তিনটি রাজ্যে ‘অঘটন’ ঘটলে বিজেপির অন্দরমহল থেকেও তো ‘দুর্জন’-এ বলতে পারে যে, ক্রমশ অকেজো হয়ে পড়েছে তাঁর ম্যাজিক-ছড়িটি! এবং ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র মাধ্যমে রাহুল গান্ধী অনেক কমিয়ে এনেছেন দলের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব, যার ফলে এখন থেকে ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত যে সব রাজ্যে নির্বাচন বাকি— যথা রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ় ও তেলঙ্গানা— সেগুলিতে বিজেপির জয়ের উপর প্রশ্নচিহ্ন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েই চলেছে।
কর্নাটক নির্বাচন থেকে ভারতীয় রাজনীতির অনেক কিছু শেখার রয়েছে। প্রথমত, বৈষম্যের রাজনীতি কিছু দিনের জন্য সস্তা চটকে কিস্তিমাত করলেও এক দিন তা ধরা পড়বেই। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিজেপি ৩৬% ভোট পেয়ে জিতেছিল ১০৪টি আসন। এ বারেও বিজেপির ভোটের ভাগ অপরিবর্তিত রয়েছে, কিন্তু দল জিতেছে মাত্র ৬৫টি আসনে। এ কি ম্যাজিক? তা তো হতে পারে না। আসল কথা, পাঁচ বছর আগেও কর্নাটকের বিভিন্ন অঞ্চলের ভোটারের সঙ্গে বিজেপির আস্থাসূচক সুসম্পর্ক ছিল। কিন্তু এ বার বিজেপির অধিকাংশ ভোট এসেছে মাত্র তিনটি অঞ্চল থেকে। প্রথমত বেঙ্গালুরু শহর, যেখানে উচ্চবিত্ত মানুষে ঠাসাঠাসি আসনের ১৬টি পেয়েছে বিজেপি। অঞ্চলটি গমগম করছে নতুন শিল্পে, উড়ছে নতুন বিত্ত। এখানে মোদীর উপর্যুপরি ‘রোড শো’ এবং তাঁর ‘ডাবল এঞ্জিন সরকার’-এর আকর্ষণ অনুভূত না হলে হবেটা কোথায়?
অপর একটি অঞ্চল যেখানে বিজেপি ২০১৮ সালের মতো চুটিয়ে না জিতলেও মোটের উপর সাফল্যের মান ধরে রাখতে পেরেছে, তা হল রাজ্যের উপকূলবর্তী অঞ্চল ঘিরে। তার কারণটি সহজ। সেখানে বাসিন্দাদের এক অংশ মুসলমান হওয়ার দরুন অঞ্চলটিকে বলা হয় ‘হিন্দুত্বের ল্যাবরেটরি’। হিজাব পরা চলবে না, হালাল মাংস বিক্রি বন্ধ করতে হবে— এই সব ‘মহতী’ আন্দোলনের স্রষ্টা হলেন যশপাল সুবর্ণ, যিনি রাজনীতিতে যোগদানের পূর্বে ছিলেনএক জন গো-রক্ষক। ফলে অঙ্কটি মিলে যায়। তিনি কিন্তু কংগ্রেস প্রতিপক্ষকে হারিয়েছেনবত্রিশ হাজার ভোটের ব্যবধানে। অর্থাৎ, ওই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িকতা জিতেছে বুক ফুলিয়ে।দক্ষিণ কন্নড় জেলায় বিজেপি জিতেছে আটটির মধ্যে ছ’টি আসনে। গত বারের চেয়ে একটি কম হলেও ক্ষতি কী? হেরেছেন কেবল বিজেপির জাতীয় প্রধান সম্পাদক সি টি রবি, যিনি ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের যজ্ঞে রাজনীতির দীক্ষা গ্রহণ করে হয়ে উঠেছিলেন সাধারণ ভাবে শান্তিপ্রিয় রাজ্যটিতে ওই ধরনের হিংসাত্মক চিন্তার অন্যতম মূল প্রবক্তা।
কর্নাটকে এই নির্বাচনে বিজেপির প্রচারের তার বাঁধা ছিল উগ্র হিন্দুত্ববাদের সুরে। কংগ্রেস তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে জানাল যে, তারা ক্ষমতায় এলে যুগপৎ ইসলামবাদী দল পিপলস ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া এবং হিন্দুত্ববাদী বজরং দলকে রাজ্যে বেআইনি ঘোষণা করবে। এটি সর্বজনবিদিত যে, বজরংবলী হলেন অনেকের কাছে পূজনীয় শ্রীহনুমানের অপর নাম। বজরং দল কিন্তু বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অধীন একটি গৈরিক ভ্রাতৃত্বের অঙ্গীভূত সংস্থা, যাদের নাম শোনা গেছে অসংখ্য হিংসাশ্রয়ী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে— বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অনুষঙ্গে তো বটেই। বেঙ্গালুরুতে নির্বাচনী প্রচারে এসে মোদী বলে দিলেন, “ওরা বলছে, ক্ষমতায় এলে জেলে পুরবে হনুমানজিকে।” এটি সহজেই অনুমেয় যে, প্রধানমন্ত্রীর এই অসত্য ভাষণটি রীতিমতো হিসাব করা, কারণ কর্নাটকের উপকূলবর্তী অঞ্চলটি হল বজরং দলের এক প্রধান ঘাঁটি।
তা ছাড়া কর্নাটকের মুম্বাই-নিকটবর্তী অঞ্চলের পঞ্চাশটি আসন— যা মূলত লিঙ্গায়েত সম্প্রদায় অধ্যুষিত— থেকে বিজেপি জিতেছে ১৬টি আসন। ব্রাহ্মণ ও লিঙ্গায়েত— এই দুই ‘উচ্চ’ শ্রেণিকে ক্ষমতার উচ্চাসনে বসিয়ে অন্যদের মিষ্টান্নমিতরে জনাঃ করলেই চলবে, এই ছিল কর্নাটকের মতো এক অগ্রগণ্য অর্থনৈতিক রাজ্য সম্পর্কে বিজেপির রাজনৈতিক ভাবনা। চিন্তার দৈন্য কোথায় নামলে পরে বিজেপির তরফ থেকে আনা হয় এক চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রস্তাব, যেখানে ইতিহাসকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে দেখানো হবে যে, ১৭৯৯ সালের মে মাসে টিপু সুলতানের হত্যাকারী কোম্পানির সেনাও ছিল না, নিজ়ামের লোকও ছিল না— বরং তারা দু’জন ছিল ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের হিন্দু (প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও জেডি(এস)-এর গোষ্ঠীপতি এইচ ডি দেবগৌড়া যে সম্প্রদায়ভুক্ত)। এই মূর্খামির প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসেন রাজ্যের প্রভাবশালী লিঙ্গায়েত মঠসমূহ।
কর্নাটক নির্বাচনে কংগ্রেস শুধু আশাতিরিক্ত ফলই লাভ করেনি। বুঝিয়েছে যে, একটি দেশের সংবিধানের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে লঙ্ঘন করে রাজনীতিতে ব্যাপক ভাবে ধর্মের আমদানি করে বিজেপি কয়েক বার সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হলেও তা সত্যের পথ নয়, সুতরাং তার আয়ুষ্কাল সীমিত হবেই। তা ছাড়া বিজেপি মোটেই বুঝতে চায়নি দেশের সাংস্কৃতিক বিভিন্নতার অর্থ ও পরিমণ্ডল। ঠিক এই কারণেই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে এসে মোদী ও অমিত শাহের দল আমদানি করেছিল শুধু ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি— এ কথা উড়িয়ে দিয়ে যে, ফৈজ়াবাদের সাধারণ মানুষ বাবরি মসজিদকে ঠিক যে দৃষ্টিতে দেখতেন, বাংলার মানুষ সেই চোখে হয়তো দেখেন না এই রাজ্যে অতীত মুসলমান শাসনের নিদর্শনগুলিকে। এই তো সাংস্কৃতিক বিভিন্নতার উদাহরণ। সম্রাট আকবরকে সুদক্ষ শাসক বললে সব ভোট যদি চলে যায় বিজেপির বাক্সে, এই ভয়ে সর্বদা থরথর করে কাঁপলে কী তফাত রইল বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে?
এই কথাটি হয়তো এ বার প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলটির চেতনার অন্তর্গত হবে। সেই সঙ্গে জাতীয়তাবাদ, ধর্ম এবং জাতপাতের ঊর্ধ্বে এক শ্রেণিবোধ তৈরি হবে। সে রাজ্যে অন্তত পাঁচ বছরের জন্য বিজেপি বিদায় নিল এই কারণে যে, কংগ্রেস শুধু উচ্চবর্ণের ভজনা না করে এ বার মন দিয়েছিল ‘আহিন্দা’র প্রতি, যা মুসলমান দলিত অনগ্রসর শ্রেণি ও জনজাতির এক সংমিশ্রণ। ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য কর্নাটক রেখে গেল অঢেল শিক্ষা।
পরিশেষে, কর্নাটকে বিজেপির বিভাজনের রাজনীতিকে যা পিছু হটতে বাধ্য করেছে, তা হল এক সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার ঐতিহ্য। যেমন ইউ আর অনন্তমূর্তি বা গোপালকৃষ্ণ আদিগার মতো লেখক। সেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে উঠে আসা মানুষ ছিলেন কর্নাটকের কংগ্রেস নেতা, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দেবরাজ উরস, যিনি সামাজিক ন্যায়ের রাজনীতির মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন উত্তর ভারতের রামমনোহর লোহিয়ার সমাজতন্ত্রের সঙ্গে। তারই পরিণাম ‘আহিন্দা’। রাজ্যের বর্তমান কংগ্রেস নেতা সিদ্দারামাইয়া, যিনি নিজে ‘কুরুবা’ (যাদব) গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, তিনি ওই উরস-লোহিয়া ধারার উত্তরসূরি। তাই নির্বাচনের আগেই কংগ্রেস প্রার্থীদের সই করা ‘অন্নভাগ্য’ ‘গৃহজ্যোতি’ প্রভৃতি পাঁচ প্রতিশ্রুতি— যা তাঁদের থেকে আগাম আদায় করেছিলেন দলের জাতীয় সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে, যিনি নিজে কন্নদিগা এবং তফসিলি জাতিভুক্ত। কংগ্রেস বহু দিন ভুলে গিয়েছিল ভারতের ইতিহাসের কাছে তাদের অঙ্গীকার। কর্নাটকের মানুষ হয়তো এ বার তাদের স্মরণ করিয়ে দেবে সেই কথা।