দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল। ছবি: সংগৃহীত।
জীবিতাবস্থায় আমি যে শির কাহারও নিকট অবনত করি নাই, মৃত্যুর পরও যেন আমার সেই শির অবনমিত না করা হয়— কথাগুলো জানিয়ে উইল করে গিয়েছিলেন তিনি, তাঁকে যেন দণ্ডায়মান অবস্থায় সৎকার করা হয়। তাই মৃত্যুর পর তাঁকে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে দাঁড় করিয়ে দাহ করা হয়! এ এক অনন্য নজির। মানুষের সঙ্কল্প কতটা দৃঢ় হলে এই বাসনা পোষণ করা যায়! ১৯৩৪ সালের ২৪ নভেম্বর এই মানুষটি আমাদের ছেড়ে যান। তিনি দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল (ছবি)। শুধু মেদিনীপুর নয়, বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুদের পাশাপাশি গান্ধীজি, মোতিলাল নেহরুদের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল।
অধুনা পূর্ব মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম চণ্ডীভেটিতে ১৮৮১-এর ২৬ নভেম্বর তাঁর জন্ম। বাবা বিশ্বম্ভর শাসমল, মা আনন্দময়ী দেবী। শিক্ষিত এই পরিবারে ব্রাহ্মধর্মের প্রভাব ছিল। এই বাড়িতেই মেদিনীপুর জেলার প্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন বীরেন্দ্রনাথের কাকা রামধন শাসমল। কাঁথি হাই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই বীরেন্দ্রনাথ স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখতেন। পরবর্তী কালে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের কাছে পড়ার জন্য রিপন কলেজে ভর্তি হন। ইংরেজদের সঙ্গে লড়তে ঠিকঠাক আইন জানতে হবে ভেবে তিনি ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন আইন পড়ার জন্য। দেশে ফিরে প্রথমে মেদিনীপুর ও পরে কলকাতায় আইনব্যবসায় যুক্ত হন। বাংলার বিপ্লবীদের আইনি সহায়তা দেন। অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলায় বিনা পারিশ্রমিকে বিপ্লবীদের পাশে দাঁড়াতে চট্টগ্রামে দৌড়ে যান। স্বাধীনতা আন্দোলনে মেদিনীপুর তথা বাংলার গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠেন।
কিন্তু এ সবের উপরেও তাঁকে স্মরণ করার প্রয়োজনটা অন্যত্র। আমরা মনে রাখিনি কী ভাবে তখনকার এই ব্যস্ত রাজনৈতিক নেতারা স্থানীয় মানুষের পাশে থাকতেন। কোনও প্রচারলোভে নয়, মানুষের পাশে থাকাটাকেই তাঁরা ‘রাজনীতি’ বলে মনে করতেন। তখন কয়েক বছর অন্তরই কেলেঘাই, কংসাবতী, সুবর্ণরেখার বন্যায় সমুদ্রতীরবর্তী মেদিনীপুরের মানুষ কষ্ট পেতেন। দুর্যোগের সময় খালি পায়ে হেঁটে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছতেন এই নেতা, সঙ্গে থাকত খাবার। বন্যাবিধ্বস্ত মানুষদের উদ্ধার, ঘর তৈরির ব্যবস্থা করতেন। কোনও সরকারি উপাধি নয়, মানুষকে সাহায্য, স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর লড়াই দেখে মানুষই তাঁকে ‘দেশপ্রাণ’ নাম দেন। মেদিনীপুরের দুর্বার স্বাধীনতা আন্দোলনকে কমজোরি করতে দু’-দু’বার ইংরেজরা জেলাটি বিভাজনের চেষ্টা করে। দু’বারই তিনি রুখে দাঁড়ান। এক বার ইংরেজরা প্রস্তাব দেয় মেদিনীপুরের অংশ ওড়িশার সঙ্গে জোড়া হোক। তা ঘটলে সেই অংশের মানুষ প্রশাসনিক কাজ ও আইন আদালতের জন্য কলকাতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কটকের সঙ্গে যুক্ত হতেন। বাংলা ছেড়ে ওড়িয়া ভাষায় রপ্ত হতে হত। তাতে সাধারণ বাঙালির স্বার্থ হানি হত বলে মনে করেছিলেন তিনি।
অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদও ছিল তাঁর লড়াইয়ের জায়গা। কেবল প্রচ্ছন্ন কাজ নয়, প্রকাশ্য ভাবে এই কাজের গুরুত্ব বোঝানো দরকার, জানতেন তিনি। স্রোতের তৃণ বইতে লিখেছেন, “গত বৎসর একদিন আমি কাঁথির মেথরানিগণকে একটা সভায় ‘মা-বোন’ বলে সম্বোধন করতে পেরেছিলাম বলে আমি হৃদয়ে যে গভীর আনন্দ উপভোগ করেছিলাম— তা বলে বুঝাতে পারবো না।”
তাঁর নেতৃত্বে মেদিনীপুর জেলার ইউনিয়ন বোর্ড গঠনের প্রতিরোধ আন্দোলনের জয় সারা ভারতে বিখ্যাত। প্রাথমিক ভাবে কংগ্রেস এই আন্দোলনকে সমর্থন করলেও পরে সরে আসে। কিন্তু বীরেন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন এই আইন চালু হলে মেদিনীপুরবাসীদের দুর্দশা বাড়বে। তাই তিনি একক প্রচেষ্টায় গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষদের সংঘটিত করেছিলেন। ঘোষণা করেছিলেন, এই আন্দোলনে জয়ী না হওয়া পর্যন্ত খালি পায়ে থাকবেন। তাঁর এই আন্দোলন এমন প্রভাবশালী ছিল যে, ইংরেজ পুলিশ গ্রামে গ্রামে জিনিসপত্র ক্রোক করতে গেলে মানুষ নগদ টাকার পরিবর্তে বাড়ির সব জিনিসপত্র তাদের হাতে তুলে দিতে থাকেন। কিন্তু পুলিশ এই সব জিনিস আনতে অসমর্থ হয়। নিলাম করতে গিয়ে তারা খরিদ্দারও পায়নি। আন্দোলনের তীব্রতায় ইংরেজরা সেই আইন তুলে নিয়ে পিছু হটে। আন্দোলন জয়ের পরে এক বিশাল জনসভায় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁকে ‘মেদিনীপুরের মুকুটহীন সম্রাট’ বলে অভিহিত করেন। তাঁর স্বাধীন মনোভাব, অকাট্য যুক্তিতে চমৎকৃত বহু ইংরেজ তাঁকে ‘ইন্ডিয়ান ব্ল্যাক বুল’ বা ভারতীয় কালো ষাঁড় বলেও অভিহিত করেছিলেন।
দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের নাম আজ রাজনীতিবিদরা মাঝেমধ্যে উচ্চারণ করলেও তিনি ঠিক কেমন রাজনীতি করতেন, কেউ জানেন না। বীরেন্দ্রনাথের সততা, দেশপ্রেম, মাথা উঁচু করে বাঁচা, মানুষের জন্য আন্দোলন— এ সব কোনও ইতিহাস পাঠ্যবইতে নেই। তাই তরুণ প্রজন্ম জানেও না, ইনি কে। পরপ্রজন্মের কাছে বলারও কেউ রইল না আর।