Bengali Language

নিজের ভাষায় পড়ার অধিকার

ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রদেরও এই বাংলা বইটিই নির্দিষ্ট। এ তো শুধু পাঠ্যক্রম নয়, ভাষার মাধ্যমে বিষয়কে চেনা নয়, একই সঙ্গে ভাষা ও ইতিহাসের সাংস্কৃতিক আলিঙ্গন এক।

Advertisement

ঈশা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৫:৩১
Share:

ভবিষ্যতের জন্যও বাঁচিয়ে রাখতে হবে বাংলা ভাষার এই অক্ষর, এই কথন, এই ভাষ্য। প্রতীকী ছবি।

সব ঐতিহাসিক মাইলফলকের এমন দীর্ঘস্থায়িত্বের সৌভাগ্য হয় না। হয় সে অস্পষ্ট, ভঙ্গুর হয়ে যায়, অথবা প্রাসঙ্গিকতা ছেড়ে যায় তাকে। একুশে ফেব্রুয়ারি, ভাষা দিবস কিন্তু থেকে গিয়েছে একই রকম প্রাসঙ্গিক, এত বছর পরেও। কেবল একটি ভাষার জন্য। তার সম্মানের জন্য জীবন দেওয়ার কথা ভোলেননি কেউ, ইতিহাসেও তা একক। তবে বাংলা ভাষার অস্তিত্বযুদ্ধের পরিবর্তন হয়েছে, এ কথা অনস্বীকার্য।

Advertisement

এ যুদ্ধের একটি পরত নিশ্চয়ই বহুমাত্রিক, বহু ভাষাভাষী-পরাক্রম। উন্মুক্ত বিশ্বের স্বাভাবিক নিয়মেই পশ্চিমবঙ্গে এখন অসংখ্য ভাষাভাষী মানুষ বসবাস করেন। দুই বাংলা ও দেশের বাইরে বসবাসকারী মানুষ মিলিয়ে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা ৩০ কোটি। অবাক করার মতো একটি তথ্য হল, পৃথিবীতে সর্বোচ্চ ব্যবহৃত ভাষার তালিকায় বাংলা ভাষা পঞ্চম। এই গৌরবের ভাষায় সহোদর বাংলাদেশ তার ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছে সসম্মানে, আমরাই তার সম্মান রাখতে পারিনি।

অথচ রাজনৈতিক পালাবদলের মধ্যেও দু’টি ভিন্ন মেরুর সরকার ভিন্ন ভাবে হলেও বাংলা ভাষাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার চেষ্টা করেছে অনেকটা। বাম আমলে চেষ্টা করা হয় মাতৃভাষায় শিক্ষানীতির প্রচলনের। সেই শিক্ষানীতি ঠিক না ভুল, সে বিষয়ে তর্ক গড়িয়েছে বহু দূর। তবে মাতৃভাষাকে অগ্রাধিকারের চেষ্টায় কোনও ত্রুটি ছিল না। পরবর্তী কালে সেই শিক্ষানীতির পরিবর্তন হলেও, মাতৃভাষাকে প্রশাসনিক কাজে অগ্রাধিকার দেওয়ার সরকারি নিয়ম প্রতিষ্ঠা হয়। এ ছাড়া সব সরকারি পরীক্ষায় বাংলা ভাষায় লেখার অধিকার, ইংরেজির সঙ্গে আবশ্যিক ভাবে বাংলা ভাষায় প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে এই সম্মান স্থায়ী করা সম্ভব হয়েছে।

Advertisement

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষা ও প্রশ্নপত্রে, স্নাতক-স্নাতকোত্তর সর্ব স্তরেই বাংলা ভাষা বাধ্যতামূলক। সব বিষয়ের স্নাতকোত্তর, পিএইচ ডি গবেষণাপত্র লেখা সম্ভব, লেখা হচ্ছেও বাংলায়।

তবু ঔপনিবেশিক দাসত্ব গিয়েও যেতে চায় না। বেশ কিছু ঘটনা এর সাক্ষী। সম্প্রতি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটি যেমন। সব শিক্ষক, অধ্যাপক স্বীকার করবেন, নিজেদের অধ্যাপক জীবনেও, সহ-অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের কথনেও ভাষাচিহ্ন কম দেখা যায় না। উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা মেয়েটি ইংরেজি বুঝতে পারে না মোটেই। একাধারে স্নাতকের বিষয় এবং ভাষার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় তাকে। তার এই সমস্যার কথা সে সাহস করে বলতে পারে না। বলতে গেলে পাঠ্যক্রমে বাংলায় লেখা বইয়ের অপ্রতুলতা, বিষয়ের প্রযুক্তিগত কারণে ইংরেজি ভাষার উপযোগিতা ইত্যাদি শুনতে হয়। এমনকি, কখনওসখনও অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে আবশ্যিক বাংলা ভাষার অংশও থাকে অমিল।

নিয়ম যে বড় কথা নয়, মনোভাবটাই বড় কথা, তার সদর্থক প্রকাশ দেখা যায় অধ্যাপকের ব্যবহারেও। নামী কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে নীহাররঞ্জন রায়ের সময়ের দলিল বইটি শুধু ইতিহাস নয়, বাংলা ভাষারও এক অসামান্য খনি, তা অজানা নয়। ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রদেরও এই বাংলা বইটিই নির্দিষ্ট। এ তো শুধু পাঠ্যক্রম নয়, ভাষার মাধ্যমে বিষয়কে চেনা নয়, একই সঙ্গে ভাষা ও ইতিহাসের সাংস্কৃতিক আলিঙ্গন এক।

একই চেষ্টা করতে পারেন সব অধ্যাপক, শিক্ষকও। তাঁদের বিষয়েও নিশ্চয়ই আছে এমন অমূল্য সব বই, যা মাতৃভাষায় রচিত। বিপণনের দুনিয়ায় তারা হয়তো হারিয়ে গিয়েছে বা যাচ্ছে। বাংলায় উপযুক্ত কোনও বই নেই, এমন দায়সারা যুক্তি না দেখিয়ে তাঁরা চেষ্টা করতে পারেন অন্তত একটিও মাতৃভাষায় রচিত বই ব্যবহারের, অন্তত উল্লেখের। চটজলদি বাজারমুখী বইয়ের ছত্রছায়ায় থাকার সুবিধাবাদ শিক্ষকদের মানায় কি?

কিছু কাল আগেও বিভিন্ন বিষয়ের প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপকেরা প্রয়াস করেছেন মাতৃভাষায় বিষয়ভিত্তিক বই রচনার। বাংলা ভাষায় রচিত মিহির রক্ষিতের অর্থনীতির পাঠ্যবই বা সুভাষরঞ্জন চক্রবর্তীর ইতিহাসের বই পড়া হচ্ছে, হবেও। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে বিশ্ববরেণ্য বিকাশ সিংহ, পথিক গুহ প্রমুখের অবদান তো অগ্রাহ্য করার নয়। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধনের প্রসাদগুণে সমৃদ্ধ সুপাঠ্য গদ্যরচনাও একই দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে। এ একাধারে ভাষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের আলিঙ্গন, যা শুধু মাতৃভাষাতেই সম্ভব। বিশ্ব স্তরেও এর সমর্থন ও উদাহরণ কম নয়। মাতৃভাষায় শিক্ষার পক্ষে নোম চমস্কির মত সুবিদিত। একই মত ইউনেস্কোরও।

একুশে ফেব্রুয়ারি প্রতি বছর ফিরে ফিরে আসে, আর মনে করায়, শুধু সেই অমর শহিদদের জন্যই নয়, ইতিহাসের জন্যও নয়, ভবিষ্যতের জন্যও বাঁচিয়ে রাখতে হবে বাংলা ভাষার এই অক্ষর, এই কথন, এই ভাষ্য। অতীত ইতিহাসের, ভবিষ্যতেরও এইটুকু দাবি তো মেটাতেই পারি আমরা সবাই মিলে, এই একুশে ফেব্রুয়ারিই শুরু হোক না সেই শপথ!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement