দায়িত্ব: মিশরে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপুঞ্জের জলবায়ু সম্মেলন সিওপি ২৭-এর মঞ্চে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ১১ নভেম্বর, ২০২২। রয়টার্স
মিশরের শার্ম এল শেখ থেকে সুন্দরবনের শামসেরনগর কত দূর? অঙ্কের হিসাবে হয়তো প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার, কিন্তু জলবায়ু বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে আগামী দিনে বাদাবনের বাঘ আর মানুষ বাঁচানোর লড়াই ক্লিয়োপেট্রার দেশের শান্তির শহর থেকেই শুরু হবে; এমনটা ভাবলে জায়গা দু’টি যেন পাশের জানলার প্রতিবেশী। শার্ম এল শেখ-এ সদ্য শেষ হওয়া রাষ্ট্রপুঞ্জের ২৭তম জলবায়ু সম্মেলনের ঐকমত্য এমন আশায় জলসিঞ্চন করেছে। তবে রয়েছে আশঙ্কার দোলাচলও।
গত ৬ নভেম্বর, সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক শুরুর দিনেই, ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’-এর জন্য আর্থিক সাহায্যের বিষয়টি উন্নয়নশীল দেশগুলির বহু দিনের দাবি মেনে মূল আলোচনার অ্যাজেন্ডা বলে মেনে নেয় উন্নত দেশগুলি। গত এক দশকের উপর উন্নয়নশীল দেশ এবং জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন, যে সব দেশ ও অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বার বার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বা হচ্ছে, তাদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ-সহ অন্যান্য সাহায্যের ব্যবস্থা করতে হবে। যে-হেতু বিশ্ব জুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রধানত দায়ী শিল্পোন্নত দেশগুলি, তাই তাদেরই নিতে হবে সেই ক্ষতিপূরণের মূল দায়িত্ব। উন্নত বিশ্ব গোড়া থেকেই এর বিরোধী, তাদের আশঙ্কা যে, এক বার ক্ষতিপূরণ দেওয়া শুরু হলে দাবির বাঁধ ভেঙে পড়বে!
বস্তুত ২০২১ সালের গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনে এ সংক্রান্ত একটি আলাদা তহবিল গড়ার কথা থাকলেও উন্নত দেশগুলি চাপ দিয়ে বিষয়টিকে স্রেফ তাত্ত্বিক আলোচনায় পাল্টে দেয়। এ বার প্রবল উল্টো চাপের মুখে সম্মেলনের গোড়ায় এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় রাজি হলেও তারা জানিয়ে দেয়, পুরনো কোনও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বিপর্যয়ের ক্ষতিপূরণ নিয়ে কথা বলা যাবে না। সোজা কথায়, জলবায়ু পরিবর্তনে তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব সরিয়ে রেখে আর্থিক আলোচনা করতে হবে। এই দাবি যে অনৈতিক, এটা বুঝেও উন্নয়নশীল দেশগুলি তা মেনে নেয়। কারণ তারা জানত, এক বার আলোচনার স্রোত গড়ালে উন্নত দেশগুলিকে আজ নয়তো কাল আর্থিক সাহায্যের কথা মানতেই হবে।
অবশেষে উন্নয়নশীল দেশগুলির প্রবল চাপের মুখে সিওপি ২৭-এ লস অ্যান্ড ড্যামেজ, জলবায়ুর ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে সিলমোহর পড়েছে দিনরাত এক করে চলা দীর্ঘ দরাদরির পর, যা চলেছে নির্ধারিত সমাপ্তির আরও দেড় দিন পেরিয়ে। এ এক আশ্চর্য সমাপতন যে, ২০১২ সালে ফিলিপিন্সের এক বিধ্বংসী প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে কেন্দ্র করে দোহা জলবায়ু সম্মেলনে যে আলোচনার শুরু, তাতে শেষপর্যন্ত সাফল্যের স্ট্যাম্প পড়ল ২০২২-এর শার্ম এল শেখ সম্মেলনে; এবং এই সিদ্ধান্তে অনুঘটকের কাজ করল পাকিস্তানের আর এক ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয়! প্রথমে ‘না’, তার পর ‘এখন না, আলোচনা চলুক’, তার পর ‘মানতে পারি, কিন্তু চিন ও ভারতের মতো দেশকেও এই খাতে আর্থিক সাহায্য করতে হবে’— উন্নত দেশগুলির এমন অজস্র কুযুক্তি পেরিয়ে সর্বসম্মত শার্ম এল শেখ ইমপ্লিমেন্টেশন প্ল্যান-এ জায়গা পেয়েছে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড ফেসিলিটি’, যদিও এর প্রয়োগ সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় ঠিক করতে অন্তত বছরখানেক লাগবে বলে ধারণা। কাগজে-কলমে হলেও সত্যি কতটা সাহায্য পাওয়া যাবে, আশঙ্কা তা নিয়েও। গত কয়েক বছরে উন্নত দেশগুলিও বারে বারে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। তফাত একটাই— উন্নত দেশগুলি সঙ্কটে পড়লে তাদের বেরিয়ে আসার আর্থিক ক্ষমতা রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলির তা নেই।
আর এখানে উঠে আসছে সুন্দরবনের কথা। ভারত পৃথিবীর অন্যতম জলবায়ু বিপর্যয়-প্রবণ দেশ; আক্রান্ত, মৃত্যু, এমনকি আর্থিক ক্ষতির নিরিখেও। তার মধ্যে প্রথম সারিতে সুন্দরবন, যে অঞ্চলে তীব্র ঝড়ের প্রবণতা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি; যে অঞ্চলে সমুদ্রের জল বৃদ্ধির পরিমাণ দেশের মধ্যে এক নম্বর তো বটেই, আন্তর্জাতিক গড়ের প্রায় দ্বিগুণ। আয়লা থেকে আমপান বার বার আক্ষরিক অর্থেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে সুন্দরবনের উপর বা চলে গিয়েছে গা ছুঁয়ে। মানুষের জীবনহানি অনেকাংশে কমানো গেলেও জীবিকার সঙ্কট তীব্রতর হয়েছে, সঙ্কটে জীববৈচিত্রও। বাড়ির চাল বার বার উড়ে গেছে, জমি নদী খেয়ে ফেলায় কয়েক বছর অন্তর নতুন আস্তানা খুঁজতে হয়েছে, চাষের জমি বন্যার জলে লবণাক্ত হয়ে বা পানের বরজ ঝড়ে ধ্বংস হয়ে চরম সঙ্কটে পড়েছেন, এমন মানুষ সুন্দরবনে লক্ষ লক্ষ। পৃথিবী জুড়ে যদি জলবায়ু ক্ষতিপূরণের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের কোনও তালিকা বানানো হয়, তবে একেবারে উপরেই থাকার কথা সুন্দরবনের, ফলে এ সংক্রান্ত তহবিল হলে তার হকের দাবিদার সুন্দরবনের যে হওয়া উচিত, তাতে কোনও সন্দেহ নেই; বিশেষ করে এই প্রেক্ষিত মনে রাখলে যে, সুন্দরবনের মানুষ বার বার জলবায়ু বিপর্যয়ের ধাক্কায় পড়লেও সেই পরিস্থিতিসৃষ্টিতে তাঁদের দায়িত্ব সিন্ধুতে বিন্দু বললেও বেশি বলা হবে।
শুধু সুন্দরবন নয়, জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধাক্কা পড়ে দার্জিলিঙের পার্বত্য অঞ্চল থেকে শুরু করে বাঁকুড়া, বীরভূমের রাঢ় অঞ্চলে; বস্তুত কম বেশি গোটা রাজ্যেই, কেননা পশ্চিমবঙ্গের এক দিকে পাহাড়, অন্য দিকে সমুদ্র ও গোটা অঞ্চল জুড়ে অজস্র নদীনালা; জলবায়ু ক্ষতিপূরণ নিয়ে সবুজ সঙ্কেত এ সব অঞ্চলেও আশার সঙ্কেত। কলকাতাও এই তালিকার বাইরে নেই। কিন্তু সে ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের উচিত অবিলম্বে সুন্দরবন-সহ গোটা রাজ্যের জলবায়ু বিপন্ন অঞ্চলগুলির কোথায় কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সে হিসাব সম্পূর্ণ করা, যাতে প্রয়োজন হলেই সঠিক ভাবে এ সংক্রান্ত ন্যায্য দাবিদাওয়া আমরা কেন্দ্রীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে পেশ করতে পারি। মনে রাখতে হবে, সময় খুব বেশি নেই।
তবে, আশার পাশাপাশি আছে আশঙ্কাও। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন-সহ উন্নত দেশগুলির বহু নেতানেত্রী শার্ম-এর সম্মেলনে ঘুরে গেলেও প্রয়োজনের তুলনায় আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাব বেশ কম। অন্য দিকে, সাম্প্রতিক রিপোর্ট জানাচ্ছে যে, বিজ্ঞানীরা অবিলম্বে আবহাওয়ায় উষ্ণতা সৃষ্টিকারী দূষিত গ্যাস বহুলাংশে কমাতে বললেও তা বাড়ছে। বিশ্ব জুড়ে কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ করা নিয়েও রাজনীতির দড়ি টানাটানি চলছে। একের পর এক সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক রিপোর্ট জানিয়েছে, অবিলম্বে উন্নত দেশগুলি গ্রিনহাউস নির্গমন না কমালে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না, এবং সুন্দরবনের মতো সমুদ্র-তীরবর্তী অঞ্চলও সেই বিপর্যয়ের ভাগীদার হবে।
তাই বিশ্বের সঙ্গে সুন্দরবন-সহ গোটা রাজ্যের জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ক্ষতিগ্রস্তদের প্রার্থনা, শার্ম এল শেখে দু’সপ্তাহের আলোচনার শেষে আশার যে চারা রোপণ করা হয়েছে তা মহীরুহ হোক। দুধে-ভাতে থাক আগামী প্রজন্ম ।