শুধু চ্যাটজিপিটিই নয়, চলে এসেছে অজস্র ছোট-বড় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত ব্যবস্থা। প্রতীকী ছবি।
যন্ত্র কি তবে ‘মানুষ’ হয়ে উঠল? আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম মেধার মাধ্যমে তৈরি করা ছবি, গল্প, কবিতা নিয়ে চতুর্দিকে হইচই। তা নিয়ে কেউ উল্লসিত, কেউ শঙ্কিত। শুধু চ্যাটজিপিটিই নয়, চলে এসেছে অজস্র ছোট-বড় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত ব্যবস্থা।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই উত্থানকে বিল গেটস পূর্ববর্তী কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট বিপ্লবের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই মাপের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রভাব সাধারণত পরবর্তী কয়েক শতাব্দী অবধি লক্ষ করা যায়। সেই হিসাবে বলা ভাল যে, আমরা এখনও কম্পিউটার ও ইন্টারনেট বিপ্লবের সম্পূর্ণ প্রভাব দেখে উঠতে পারিনি। কাজেই আমরা যদি সত্যিই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জয়যাত্রার সুদূরপ্রসারী ফল খুঁজতে চাই, তা হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে আরও পিছনে, যখন শেষ এই মাপের পরিবর্তন দেখেছি।
আঠারো-উনিশ শতকের ইউরোপীয় শিল্প-বিপ্লবের হাত ধরে সামন্ততন্ত্রকে সরিয়ে মানবসভ্যতার মঞ্চে পদার্পণ করে ধনতন্ত্র। শিল্প-বিপ্লবের আগে খুব কম কাজ ছিল, যেগুলো পারিবারিক শিক্ষা দ্বারা অর্জিত দক্ষতা ছাড়া করা যেত। চাষবাস থেকে শুরু করে কুটিরশিল্প মায় পশুপালন, সবই ছিল দক্ষতাভিত্তিক শ্রম। কাজেই বংশানুক্রমে মানুষ তাদের পেশা, জমি এবং সামন্তপ্রভুদের আবর্তে বন্দি হয়ে থাকত। শিল্প-বিপ্লব এসে এই বন্ধন ছিন্ন করে। আগের অনেক দক্ষতামূলক কাজ পরিণত হয় যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়। তার তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ে অসংখ্য মানুষের উপরে, যাদের রুজিরোজগার এই সব কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু সুদূরপ্রসারী ফলস্বরূপ তাদের পরবর্তী প্রজন্ম ছড়িয়ে পড়ে নানাবিধ পেশায়। শুধু যন্ত্র চালাতে শিখে নিলেই হল— অনেক ধরনের কাজ এসে যায় নাগালের মধ্যে। এই যে এক বৃহৎ পরিসরের কাজ এক বৃহৎ সংখ্যক মানুষের আয়ত্তে চলে এল, তার ফলে মানুষ ছুটতে পারল জীবিকার সন্ধানে, বিশেষত নগরগুলিতে। শুরু হল উনিশ-বিশ শতকের মহান নাগরিক সভ্যতা।
এই প্রভাব কিন্তু সমান ভাবে সব ধরনের জীবিকার উপরে পড়েনি। কিছু কিছু বুদ্ধিবৃত্তির কাজ থেকে গিয়েছিল মহান শিল্প-বিপ্লবের চাকার পেষণের বাইরে— ডাক্তার, শিক্ষক, উকিল, প্রযুক্তিবিদ, স্থপতি, কবি, শিল্পী, দার্শনিক, রাজনীতিক। অর্থাৎ শিল্প-বিপ্লব তৈরি করল দুই ধরনের কাজ— দক্ষতাভিত্তিক ও শ্রমভিত্তিক। শ্রমভিত্তিক কাজের চাহিদা পড়ে গেলেও দক্ষতাভিত্তিক কাজ ও কাজিরা কিন্তু তাঁদের দাম ধরে রাখতে পারলেন। শ্রমিকশ্রেণির পক্ষে দক্ষতাভিত্তিক কাজের যোগ্যতা অর্জন করা অসম্ভব না হলেও অর্থনৈতিক ভাবে কঠিন হয়ে গেল। অন্য দিকে, দক্ষতাভিত্তিক কাজের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা তাঁদের আর্থিক অবস্থানের কারণে সহজে এক পেশা থেকে অন্য, আরও লাভজনক পেশায় চলে যেতে পারলেন। অর্থাৎ শিল্প-বিপ্লবের প্রতিশ্রুত পেশাগত সচলতা এল, কিন্তু সমাজের সব স্তরে সমান ভাবে নয়। প্রকট হল শ্রেণিবৈষম্য।
পরবর্তী সময়ের ইতিহাস দেখেছে শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একাধিক পরীক্ষানিরীক্ষা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ব্যর্থ হয়েছে। শ্রেণিহীন সমাজ তৈরি করতে গেলে অনেকখানি বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োজন হয়, যে বুদ্ধিবৃত্তি আবার স্বাভাবিক ভাবেই এক বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের জন্ম দেয়। অধিযন্ত্রবাদের নাগালের বাইরে থাকায় এই গোষ্ঠী শ্রমজীবী শ্রেণির থেকে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে। শ্রেণিবৈষম্য ঘোচাতে গিয়ে আরও বড় বৈষম্য সৃষ্টি হয়। মৌলিক ভাবে দুই ধরনের কাজের ব্যবধান যা সৃষ্টি হয়েছিল শিল্প-বিপ্লবের বিষম প্রভাবের ফলে, সেই ব্যবধান না ঘুচিয়ে দেখা যাচ্ছে আদর্শ, শ্রেণিহীন, শোষণহীন সমাজ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।
এখানেই বর্তমান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপ্লবের তাৎপর্য। এই প্রথম বার প্রকৃতার্থে বুদ্ধিজীবিকা অধিযন্ত্রবাদের দৃষ্টিবৃত্তের মধ্যে এসেছে। এই প্রথম সৃষ্টিশীল কাজের দিগন্তও যন্ত্রের কল্পনায় ধরা দিয়েছে। এই প্রবণতা যদি বজায় থাকে, তবে ভবিষ্যতে আমরা কল্পনা করতেই পারি যে, আজকের বুদ্ধিভিত্তিক কাজগুলিও একে একে শ্রমভিত্তিক কাজের এক্তিয়ারে ঢুকে আসবে। সহজ হয়ে যাবে এই ধরনের কাজে প্রবেশের পদ্ধতিও— সে ডাক্তারি হোক, বা শিল্পকর্ম, স্থাপত্য বা গবেষণা।
শিল্প-বিপ্লব অনেক প্রজন্মকে জমিভিত্তিক, শ্রমভিত্তিক কাজের বলয় থেকে মুক্ত করেছিল। বর্তমান প্রজন্মের যন্ত্রগুলি সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে যেখানে এক জন মানুষ তাঁর জীবদ্দশায় সহজেই পেশা পরিবর্তন করতে পারবেন, নতুন দক্ষতা অর্জন করতে পারবেন। হয়তো কারও চিরকালের ইচ্ছা ছিল যে তিনি লেখক হবেন, অথবা চিত্রকর, বা ফ্যাশন ডিজ়াইনার। তাঁর মাথায় হয়তো অনেক ভাল ভাল চিন্তার খোরাক আছে, অথচ তিনি জানেন না কী ভাবে শুরু করবেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হতে পারে তাঁর আদর্শ সহকারী, যে তাঁকে পথনির্দেশ করবে।
মানুষকে যদি পেশার পরিচয়ে আবদ্ধ না থাকতে হয়, তবেই নিশ্চিত ভাবে শ্রেণিবিভাজন ও বৈষম্যকে মুছে ফেলা সম্ভব। একই ভাবে এই নবীন প্রযুক্তি আমাদের নতুন করে ভাবাবে মেধাসম্পত্তি ও তজ্জনিত আইনি সংজ্ঞা নিয়েও। আমরা মেধাসম্পত্তি নিয়ে ভাবিত হই, কারণ তা বিরল এবং অনন্য। বাংলার মসলিন এক কালে মেধাসম্পত্তি হিসাবে গণ্য হত। ভবিষ্যতে যদি আজকের উদ্ভাবনী চিন্তা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাত ধরে পাইকারি হারে বাজারে ছেয়ে যায়, তবে সেই সম্পত্তির দখল নিয়ে মাথাব্যথার কারণ থাকবে কি?