নানা কারণেই দূরদেশের সঙ্গে যোগ ছিল প্রাচীন ভারতের
Ancient India

কবে আমি বাহির হলেম

সাতপুরুষের ভিটে-মাটি ফেলে ভাগ্য ফেরাতে নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে সুদূর কাশীযাত্রায় হরিহরকে আটকানোর কম চেষ্টা গ্রামবৃদ্ধরা করেননি।

Advertisement

রণবীর চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০২৩ ০৬:১৯
Share:

ব্যস্ত: ১৫৭২ সালের কালিকট বন্দর, জর্জ ব্রাউন ও ফ্রান্‌জ় হোগেনবার্গ-এর অ্যাটলাসে। উইকিমিডিয়া কমনস

অসংখ্য গ্রাম, আর গ্রামগুলি নিশ্চল, বিবর্তনবিহীন। গ্রামের প্রয়োজনীয় তৈজস যে-হেতু গ্রামেই পাওয়া যায়, তাই গ্রামগুলি স্বয়ংসম্পূর্ণ; সুতরাং আবদ্ধ ও জড়বৎ: প্রাক্-আধুনিক ভারতীয় উপমহাদেশ সম্বন্ধে এমন ধারণা অনেক দিনের। হেনরি মেন-এর এই উনিশ শতকীয় সাধারণ সূত্র নাড়া খেয়ে গিয়েছিল সমাজতাত্ত্বিক শ্রীনিবাসের এক জরুরি প্রশ্নে: জীবনযাপনের দু’টি অত্যাবশ্যক উপাদান নুন এবং লোহা কি সব গ্রামেই সুলভ, না কি এই অপরিহার্য দুই বস্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেশান্তর থেকে জোগাড় হলে তবেই গ্রামীণ সমাজে পৌঁছত? সাতপুরুষের ভিটে-মাটি ফেলে ভাগ্য ফেরাতে নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে সুদূর কাশীযাত্রায় হরিহরকে আটকানোর কম চেষ্টা গ্রামবৃদ্ধরা করেননি। এই চলাচলের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। সেই প্রাচীন যাত্রিকতার কাহিনি।

Advertisement

কাঁসা বা ব্রোঞ্জের বিবিধ উপকরণ যেমন হরপ্পা-সভ্যতায় উপস্থিত, তেমনই আকর্ষক ঢাকার লাগোয়া মৌর্যকালীন প্রত্নক্ষেত্র ওয়ারি-বটেশ্বর থেকে পাওয়া একটি ব্রোঞ্জ অশ্বমূর্তি। আর আদি-মধ্যযুগীয় দক্ষিণ ভারতের ব্রোঞ্জ নটরাজ মূর্তির সমাদর তো জগৎজোড়া। ব্রোঞ্জের মতো একটি সঙ্কর ধাতুতে থাকে তামা ও টিন। তামা উপমহাদেশে পাওয়া গেলেও টিন বহির্ভারতীয় কোনও অঞ্চল— বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আনতেই হবে। কারা এই দীর্ঘমেয়াদি ধাতব লেনদেনে লিপ্ত ছিলেন, তার হদিস না পাওয়া গেলেও দূরপাল্লার যোগাযোগ অনুমান করতে সমস্যা নেই। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ থেকে ১০০ পর্যন্ত উত্তর ভারতের বৃহদংশে— পরে দক্ষিণাত্যেও— যে অতি উন্নতমানের কৃষ্ণ চিক্কন মৃৎপাত্র বহু প্রত্নস্থলে হাজির, তার উৎপাদন-এলাকা বিহার ও উত্তরপ্রদেশের পূর্ব ভাগে। বাণিজ্যিক পণ্য হিসাবে এই কৌলাল যখন বিশাল ভূখণ্ডে ছড়িয়ে পড়ছে, তা অবশ্যই নিয়মিত চলাচলের ইঙ্গিতবাহী।

বণিকদের ভ্রামণিক চরিত্র নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু বাণিজ্য ছাড়াও ক্রমান্বয়ে চলার তাগিদ কারও জীবনে থাকতেই পারে। ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’-এর (খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতক) বিখ্যাত চরৈবেতি উচ্চারণ বিশ্বপ্রকৃতিকে অনুধাবনের জন্যে সেই শাশ্বত আহ্বানই জানায়। প্রায় সমকালীন ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’ অনুযায়ী মাঠব নামে এক ব্রাহ্মণ ব্রহ্মর্ষিদেশ (বর্তমান হরিয়ানা) থেকে পবিত্র অগ্নিকে সঙ্গে নিয়ে ক্রমাগত পুব দিকে চলতে চলতে শেষে বিদেহ (মিথিলা অঞ্চল) দেশে থামলেন; কারণ বিদেহ-র আরও পূর্বের ভূখণ্ড জলাজমি মাত্র— তা তখনও অগ্নিস্পৃষ্ট নয়। এই কাহিনির নেপথ্যে বোধ হয় গাঙ্গেয় উপত্যকার বন পুড়িয়ে বৈদিক নিবেশনের পূর্বমুখী বিস্তারের আভাস রয়ে গিয়েছে।

Advertisement

বৈদিক তথা ব্রাহ্মণ্য আদর্শে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থায় মোক্ষের গুরুত্ব সত্ত্বেও গার্হস্থ আশ্রমই সমাজের ভিত্তি ও চালক। এই মতাদর্শের বিপ্রতীপে বৌদ্ধ, জৈন আজীবিক প্রমুখ শ্রমণ গোষ্ঠীর অবস্থান, যাঁরা প্রব্রজ্যাপন্থী ও অগেহ ভিক্ষু-ভিক্ষুণী। একমাত্র বর্ষাকালেই তাঁদের নিরন্তর যাত্রিকতার সাময়িক বিরতি (বসসাবাস) ঘটে, তাই বুদ্ধ, মহাবীর, মংখলিপুত্ত গোসালকে পরিব্রাজক হিসাবে শ্রমণ ধ্যান-ধারণায় দর্শানো নিতান্ত স্বাভাবিক। রাজগৃহ থেকে পাটলিগাম হয়ে গঙ্গা পেরিয়ে বৈশালী অতিক্রম করে অশীতিপর বুদ্ধদেব কুশীনগরে থামলেন, আর সেখানেই ঘটল তাঁর মহাপরিনিব্বান; সেই শেষ পাড়িতেও তাঁকে পেরোতে হল অনেকটা পথ। বুদ্ধ এবং মহাবীরের দুই অভিধা যথাক্রমে দীপঙ্কর এবং তীর্থঙ্কর— দুই অভিধাতেই রয়েছে পারাপারের কান্ডারির ব্যঞ্জনা, যাঁরা ক্লেশকীর্ণ পার্থিব অস্তিত্ব থেকে নির্বাণ বা কৈবল্যের পথ দেখাবেন মানুষকে। একই ভাবে যাত্রাকালে অষ্টমহাভয় থেকে পরিত্রাণ দেন বলে আদি-মধ্য কালে বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বর এবং তারার উপাসনায় জোয়ার এসেছিল (উত্তরণ করিয়ে দেওয়ার দেবী-ই তো তারা)। আধিদৈবিক পবিত্র স্থানে পুণ্যার্জনের তাগিদেই তীর্থযাত্রা। পুরাণে তীর্থযাত্রার যে বিপুল মহিমা, তার সম্ভাব্য পূর্বসূরি বৌদ্ধ পরিমণ্ডলে, বুদ্ধদেবের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলি দর্শনের আকাঙ্ক্ষায়। সাঁচি স্তূপে পৃষ্ঠপোষকতার স্মারক রয়েছে ৬৩৩টি লেখতে, যার মধ্যে মাত্র তিনটিতে রাজকীয় দানের নজির আছে। দাতারা তাঁদের পরিচয় দেওয়ার সময় তাঁদের পেশা এবং কোন এলাকা থেকে তাঁদের আগমন, এই দুই তথ্যই দেন। সাঁচির সন্নিহিত এলাকা ও বহু দূরের জায়গা থেকে তাঁরা এসেছিলেন সাঁচিতে। মানচিত্রে তাঁদের মূল এলাকাগুলি চিহ্নিত করলে এক বহুপ্রসারী যোগাযোগ ব্যবস্থার আভাস পাওয়া যায়।

সমুদ্রযাত্রায় ভীতি, অনিশ্চয়তা এবং ঝুঁকি অবশ্যই থাকে। তবে বর্ণ-জাতি ব্যবস্থার কঠোর অনুশাসন লঙ্ঘিত হওয়ার আশঙ্কায় মনু-সহ গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মশাস্ত্রকার-রা সাগর-সফরের বিরুদ্ধে যে তর্জনী তুললেন, তা নিতান্ত একপেশে বক্তব্য। সেই তর্জনীকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে এডেন উপসাগরের সোকত্রা দ্বীপে প্রথম পাঁচ খ্রিস্টীয় শতাব্দী ধরে নিয়মিত সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছেন উপমহাদেশীয় যাত্রিবৃন্দ; ওই দ্বীপে আরও আসছেন ইথিয়োপীয়, গ্রিক ও পালমিরীয় ব্যক্তিবর্গ। এই সাগরিক মানুষগুলির সক্রিয় ভূমিকার লেখমালানির্ভর সাক্ষ্য উদ্ধার করেছিলেন ইংগো স্ট্রাউখ ও তাঁর সহযোগীরা সোকত্রা দ্বীপ থেকে, যার সিংহভাগ লেখ সংস্কৃত ভাষায় ও ব্রাহ্মী লিপিতে খোদিত। গুজরাতের দুই বন্দর, ভৃগুকচ্ছ ও হস্তকবপ্র, থেকে যে সোকত্রাতে যাত্রীরা ও নৌকর্মীরা যেতেন, লেখগুলি তার অকাট্য প্রমাণ দেবে। তাইল্যান্ডের ক্রা যোজক থেকে বেরেনিসে বেল্লিনা উদ্ধার করেছিলেন একটি সিলমোহর, তাতে প্রথম/দ্বিতীয় শতকের লিপিতে উৎকীর্ণ আছে সিলমোহরের মালিকের নাম: বৃহস্পতি শর্মা। শর্মা অন্ত্যনামটি নিঃসন্দেহে ব্রাহ্মণের। এক ব্রাহ্মণ নাবিক যে সমুদ্র পেরিয়ে (সম্ভবত অন্ধ্র উপকূল থেকে) তাইল্যান্ড উপকূল অবধি গেলেন, তাতে মনুসংহিতার বিধিনিষেধের মান্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। মিশরের উপকূলবর্তী এলাকায় উৎখনন থেকে পাওয়া গিয়েছে মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষ, তাতে দুই তামিলভাষী ব্যক্তির লোহিতসাগরে যাত্রার অবিসংবাদিত প্রমাণ। কোঙ্কণের প্রাচীন বন্দর শূর্পরক থেকে (মুম্বইয়ের উত্তর শহরতলি সোপারা ) সমুদ্রযাত্রায় অভিলাষী এক ব্যক্তিকে (খ্রি. অষ্টম শতক) নিরস্ত করতে উদ্যত ও উদ্বিগ্ন পিতা বলেছিলেন যে সুদূর বিদেশ-বিভুঁয়ে সজ্জন মানুষ বিরল, দুর্জনরাই সংখ্যায় বেশি (বিরলা সজ্জনা, বহুএ দুজ্জনা)। কিন্তু পুত্র কোনও কথাই মানলেন না। অতঃপর সাজিয়ে নিয়ে জাহাজখানি সাগর পেরোবার প্রস্তুতি, বিবিধ মাঙ্গলিক আচারের আয়োজন। প্রাচীন বন্দরটিতে ব্যস্ত জীবনের চমৎকার এক আলেখ্য।

খ্রি. দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম শতাব্দী অবধি অন্ধ্র ও বাংলার উপকূলে মহানাবিকদের কথা রয়েছে লেখমালায়। রক্তমৃত্তিকার (মুর্শিদাবাদ জেলায়) বাসিন্দা মহানাবিক বুদ্ধগুপ্ত বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে গিয়েছিলেন মালয় উপদ্বীপে। নবম শতকের আর একটি লেখতে অন্ধ্র উপকূলের একটি বন্দরে বেশ কয়েক জন মহানাবিককে মহাসার্থবাহদের সঙ্গে হাজির থাকার কথা সম্প্রতি জানিয়েছেন কে ভি রমেশ, সুচন্দ্রা ঘোষ ও সাবর্ণী নায়ক। দক্ষিণ ভারতে সমুদ্রবিহারী বণিক ও নাবিকদের ভূমিকা অতি উজ্জ্বল হয়ে আছে ইহুদি বণিকদের চিঠিপত্রে (১২ ও ১৩ শতাব্দী) এবং তামিল লেখমালায় যার অনেকগুলির অবস্থান শ্রীলঙ্কায়, দ্বীপময় ও স্থলভাগের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, এমনকি চিনের পূর্ব উপকূলেও (৯ থেকে ১৩ শতাব্দী)। আরবি ও পারসিক ভূগোল গ্রন্থে ও ভ্রমণ বিবরণেও দূরপাল্লার যোগাযোগে সম্পৃক্ত ও সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থান দেখা যায়। এই বৃত্তান্তে যেমন আছেন পণ্ডিতপ্রবর আল-বিরুনি, তেমনই আছেন মরক্কোর কাজি ইবনে বতুতা এবং সমরকন্দের আব্দুর রাজ্জাক। এর সঙ্গে অবশ্যই যুক্ত হবে ১৪০৪ থেকে থেকে ১৪৩৩ পর্যন্ত ভারত মহাসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকায় চিনের জেং হে-র নেতৃত্বে মিং জাহাজগুলির উজ্জ্বল উপস্থিতি। বিশেষ উল্লেখযোগ্য, মিং জাহাজগুলি আট বার এসেছিল কালিকটে আর অন্তত চার বার চট্টগ্রামে। তাই, ভাস্কো ডা গামা-র নৌবহর উত্তমাশা অন্তরীপ প্রদক্ষিণ করে কালিকটে আসায় ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ এশিয়ায় দেখা দিল আবিষ্কারের অধ্যায়, এই ধারণার কোনও ভিত্তি নেই।

একটা বড় বদল অবশ্য ঘটল: ১৬ শতক থেকে দক্ষিণ এশিয়া লাগাতার জুড়ে গেল অতলান্তিকের উত্তরাংশের জলভাগের সঙ্গে। তার অভিঘাতে প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়া থেকে পাশ্চাত্যে যাতায়াতের জন্যে ভূমধ্যসাগরের যে ব্যাপক গুরুত্ব ছিল, সেই যাত্রা-সম্পর্ক কালক্রমে প্রান্তিকতায় পর্যবসিত। ষোলো শতক থেকে পরবর্তী প্রায় চারশো বছর উপমহাদেশে ও ভারতসাগরে ইউরোপীয় বণিক ও শক্তিগুলির সাফল্য যে অনেকটাই প্রহারেণ ধনঞ্জয়ঃ নীতিতে নিহিত, তাতে বিশেষ মতদ্বৈধ নেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement