—প্রতীকী ছবি।
গত আট দশক ধরে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে জনগণের রাজনৈতিক এবং নাগরিক স্বাধীনতার কিছু পরিমাপ প্রকাশ করে চলেছে ফ্রিডম হাউস নামক সংগঠনটি। যে কোনও সূচকের ক্ষেত্রেই যে কথাগুলি প্রযোজ্য, ফ্রিডম হাউসের প্রকাশ করা সূচক নিয়েও সেই আপত্তিগুলো আছে— সূচকের সঙ্কলন এবং সংখ্যাতাত্ত্বিক পরিমাপ একশো শতাংশ নির্ভুল এবং অকাট্য, তেমন দাবি কেউ করে না। তবে দেশে গণতন্ত্রের হালহকিকত সম্বন্ধে একটা গ্রহণযোগ্য ধারণা তৈরি করার ক্ষেত্রে এদের সূচকের উপযোগিতা স্বীকার না করে উপায় নেই। ভারতের ক্ষেত্রে ফ্রিডম হাউসের সূচক দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাচ্ছে যে, রাজনৈতিক অধিকারের উপাদানগুলোর ক্ষেত্রে— যেমন নির্বাচন প্রক্রিয়া, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অধিকার, ভোট দেওয়ার সমান অধিকার ইত্যাদি— ভারত সম্ভাব্য ৪০ পয়েন্ট-এর মধ্যে সব মিলিয়ে ৩৩ পাবে। অন্য দিকে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা, বাক্স্বাধীনতা, শিক্ষাক্ষেত্রের স্বাধীনতা, এমনকি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রাপ্ত নম্বর যোগ করলে ৬০-এ মাত্র ৩৩ পাবে। ফলে ২০২৩-এর সূচক অনুযায়ী, ভারত ‘আংশিক মুক্ত’ দেশ বলে বিবেচিত হয়েছে।
অনেকের কাছেই গণতন্ত্রের উৎকর্ষ নিয়ে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের দেওয়া তকমা আপত্তিকর মনে হতে পারে, কিন্তু ভারতীয়মাত্রেই বোঝেন যে, এই সূচক যে হিসাব দিচ্ছে, নাগরিক স্বাধীনতার বিচারে তা খুব বিভ্রান্তিকর নয়। অথচ মনে হয় যে, যত ক্ষণ না জরুরি অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে, তত ক্ষণ অবধি নাগরিক স্বাধীনতার বিষয়টি, এমনকি শাসকের রাজনৈতিক অবস্থানও, দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে গুরুত্বহীন এবং সচরাচর কাউকে আন্দোলিত করে না। ভারতে গণতান্ত্রিক পরিবেশের অবক্ষয় হচ্ছে এবং অচিরেই আনুষঙ্গিক রাজনৈতিক শর্ত আরোপিত হতে পারে, তার সম্ভাবনাও এই মুহূর্তে অনেকের কাছে কষ্টকল্পনা বলে মনে হবে। রাশিয়া, চিন বা উত্তর কোরিয়ার রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে যাঁরা আলোচনা করেন, তাঁরা ভারতের বিপুল জনসংখ্যার কত শতাংশ?
আসলে, আন্তর্জাতিক যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধ ছাড়া প্রচলিত ব্যবস্থার ভিত নাড়িয়ে দেওয়ার মতো রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটতে পারে, এমন আশঙ্কা মানুষ করেন না। পঞ্চায়েত, গ্রামসভা, সমবায় সমিতি ইত্যাদি জায়গায় যদি প্রাতিষ্ঠানিক ভোটব্যবস্থা মোটামুটি কার্যকর থাকে, তা হলে বৃহত্তর দেশের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি নিয়ে বেশি মানুষ উদ্বেল হবেন না। ফলে, যে প্রশ্নটি মনে দানা বাঁধে, তা হল— দেশে যদি গণতন্ত্র হ্রাস পায়, আর জরুরি অবস্থার সৃষ্টি না করেও একনায়কতন্ত্র খুব ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তা কি অর্থনীতির পক্ষেও খারাপ? রোটি-কাপড়া-মকানই যদি রাজনৈতিক বিচারের শেষ হাতিয়ার হয়, তা হলে একতন্ত্রী শাসকের হাতে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কী হতে পারে, তার কিছু বৈশিষ্ট্য সামনে এলে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক অবস্থানের বাইরেও তা অনেক মানুষের বিবেচনাকে প্রভাবিত করতে পারে। এবং, আর্থিক ক্ষেত্রে স্বৈরাচারের জুজু পশ্চাৎপদ শ্রেণির মানুষকেও ভাবায় কি না, তার একটা ধারণা প্রয়োজন।
একতন্ত্রী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমর্থনে ইউরোপের স্বৈরাচারী নেতা ভিক্টর অরবান-এর মতো ব্যক্তিরা বলে থাকেন যে, গণতন্ত্রের বিশৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে দ্রুত ও প্রবল আর্থিক বিকাশের জন্যে প্রয়োজন এক জন দূরদর্শী, শক্তিমান নেতা, আর কিছু ‘তৃষিত বলিষ্ঠ বালক’। স্বৈরাচারী শাসকরা দেশকে বলে থাকেন ‘উন্নয়নমূলক রাষ্ট্র’, যেখানে ‘সম্পত্তির অধিকার’ এবং ‘আইনের শাসন’-এর পরিবর্তে শক্তিশালী, কর্তৃত্ববাদী আমলাতন্ত্র স্থির করে দেশের লোকের কী প্রয়োজন। একতন্ত্রী শাসন ‘সবে মিলে করি কাজ’ মার্কা আবেগকে মোটেই পাত্তা দেয় না, কারণ উদারপন্থী গণতন্ত্রের তর্ক-বিতর্কে আর্থিক বৃদ্ধি হোঁচট খায়। রাজা-রানি জাতীয় অভিজাত একনায়কদের তুলনায় ইদানীং নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে উঠে আসা, কিন্তু মনে-প্রাণে স্বৈরাচারী নেতাদের ক্ষমতা অনেক বেশি। তাঁরা দেশের যাবতীয় পুঞ্জীভূত
ক্ষোভ খুব সহজেই সংখ্যালঘুর উপরে, দেশের ভাল-মন্দ নিয়ে নজরদারি করা মানুষের উপরে, কিংবা বিদেশি শক্তি এবং ‘মিথ্যাবাদী’ সংবাদমাধ্যমের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারেন। অধিকাংশ মানুষ সব সময়েই নিজের অবস্থার জন্যে দোষারোপ করার মতো কাউকে খোঁজেন। কূটবুদ্ধি একনায়ক দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতাকে তাঁদের হাতে তুলে দেন।
তথ্য বলছে যে, ক্ষমতা প্রতিষ্ঠায় পারদর্শী হলেও একতন্ত্রী সরকারের অর্থনৈতিক কৃতিত্ব কিন্তু চোখধাঁধানো নয়। সিঙ্গাপুর আর রুয়ান্ডার মতো দু’একটি দেশ বাদ দিলে বাকি সব জায়গায় গণতন্ত্রের অধীনেই জাতীয় আয় বেড়েছে বেশি হারে। কম উন্নত দেশে একনায়কতন্ত্রের তুলনায় গণতন্ত্রে জাতীয় আয় অনেক বেশি সুস্থির বা তার উত্থান-পতনের অনিশ্চয়তা অনেক কম। তুলনায় উন্নত চিনের দেশজ শিল্পের অভ্যুত্থানের কথাও এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিছু তথ্যের সাহায্যে প্রমাণিত হয়েছে যে, কঠিন সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকা চিনের জাতীয় সংস্থাগুলোকে খুব সফল মনে করার যথার্থ কারণ নেই। সব ক’টি সংস্থাকে জাতীয় ব্যাঙ্ক মারফত সস্তায় ঋণ পাইয়ে দেওয়া হয়েছে, অনেক ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে, কর ছাড় দেওয়া হয়েছে ইত্যাদি। বেজিং-এর যে গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই তথ্য বিশ্লেষণ করেছিল, তাদের অবশ্য অচিরেই বন্ধ করে দিয়েছে সরকার।
একই ধরনের সুযোগ সুবিধা এই মুহূর্তে ভারতে বেশ কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পেয়ে থাকে, তবে পিছনের দরজা দিয়ে। যেমন জাতীয় বিমান সংস্থার (পূর্বতন) খুব ব্যস্ত রুটটি যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাতে বেসরকারি সংস্থার লাভ। সরকারি টেলিকম যদি মানুষ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন অত্যন্ত খারাপ পরিষেবার কারণে, তাতেও বেসরকারি টেলি ব্যবসার প্রভূত উন্নতি হয় ইত্যাদি। তবে ব্যবসায় এই জাতীয় সুবিধা পেলেও মুক্ত চিন্তার সুযোগ না দিলে কিন্তু দেশের মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি কমতে থাকে। দেশে বিপুল পুঁজিনিবেশ কোনও ভাবেই উদ্ভাবনী শক্তির বিকল্প নয়। এর আগেও দেখা গিয়েছে যে, শুধু পুঁজির সাহায্যে বৃদ্ধির হার লক্ষণীয় রকম বাড়ে না— নয়তো অতি গরিব দেশে কিছুটা পুঁজি জোগাড় হলেই তারা দ্রুত হারে উন্নত দেশকে ছুঁয়ে ফেলতে পারত। কোথাও তা হয়নি, কারণ মানবসম্পদ এবং উদ্ভাবনী শক্তির অভাব, যা বিদেশ থেকে প্রযুক্তি আমদানি করে আর ধার করা দক্ষতা দিয়ে পূরণ হয় না। একতন্ত্রী শাসনে উদ্ভাবনী ক্ষমতার কদর নেই তা নয়, কিন্তু তা দেশের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থে বেশি ব্যবহৃত হয়। আর স্বৈরাচারের আমলে বিজ্ঞানী বা গবেষকের কী মূল্যায়ন হয়, তার প্রমাণ আইনস্টাইনের জার্মানি থেকে হীরক রাজার দেশ পর্যন্ত বিস্তৃত।
মানুষ এও বলতে পারেন যে, অনেক ভাল রাজার কথা তো ইতিহাসে শোনা যায়। হিতৈষী একনায়কও কি হতে পারে না? রাশিবিজ্ঞানের সম্ভাবনার দিক থেকে দেখলে বলতে হবে যে, নিশ্চয়ই হতে পারে— তবে যে কোনও দেশের কাছে সেটা একেবারেই লটারি পাওয়ার মতো ব্যাপার হয়। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের অভাবে সে রকম দেশেও সর্বজনীন পণ্যের বণ্টন আশানুরূপ হয় না। দেশের গরিব মানুষ এই বণ্টনের ভরসাতেই থাকেন। পৃথিবীর অনেক দেশে পারস্পরিক বিশ্বাস খুব গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি ব্যবসায়িক চুক্তির ক্ষেত্রেও। হিতৈষী একতন্ত্রী দেশেও এগুলো নিশ্চিত করার কোনও প্রাতিষ্ঠানিক উপায় নেই। অসাম্য বা আর্থিক বঞ্চনার অভিযোগ উপরতলা পর্যন্ত পৌঁছনো চাই তো! বাগদাদের হারুন-অল-রশিদের মতো গরিব-দরদি সুলতানের উদাহরণ বেশি নেই। সে ভরসায় থাকা সমীচীন হবে কি?