দিল্লিতে যে সব সাংবাদিক সিপিএম ‘কভার’ করেন, তাঁরা সকলেই একটি নিয়ম মেনে চলেন। তা হল, পলিটবুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের পরে জারি হওয়া দু’-চার পৃষ্ঠার বিবৃতি হাতে পেলে প্রথমেই পাতা উল্টে শেষ অনুচ্ছেদে চলে যাওয়া। কারণ, প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা জুড়ে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় রাজনীতির নানা বিষয়ে সিপিএমের সুচিন্তিত মতামত থাকে। শেষ অনুচ্ছেদে থাকে পার্টির নিজস্ব খবর। যেমন, সিপিএম এ বারের ভোটে কার সঙ্গে জোট বাঁধবে, পার্টি কংগ্রেস কবে ডাকা হচ্ছে ইত্যাদি।
গত ৩১ অক্টোবর কেন্দ্রীয় কমিটির এমনই বিবৃতিতে শেষ পৃষ্ঠার অনুচ্ছেদে লেখা ছিল, ‘পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম এবং বামফ্রন্ট কংগ্রেস-সহ সেই সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ (সেকুলার) দলের সঙ্গে নির্বাচনী বোঝাপড়া করবে, যারা বিজেপি এবং তৃণমূলকে হারাতে চায়।’
ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের তখনও জন্মই হয়নি। সিপিএম নেতারা তখনও জানতেন না যে, কংগ্রেসের পাশাপাশি তাঁদের প্রধান সহযোগী হয়ে উঠবেন আব্বাস সিদ্দিকির ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট। এবং অভিযোগ উঠবে, এই ফ্রন্ট আদতে সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ নয়। তা জেনেও বিধানসভায় আসন ও ভোটের হার বাড়িয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মরিয়া চেষ্টায় বামেরা এই ‘সাম্প্রদায়িক শক্তি’-র সঙ্গে আপস করেছেন।
কালের নিয়মে তা-ই হয়েছে। ধর্ম নিয়ে ফের ধর্মসঙ্কটে পড়েছে ভারতের মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি। প্রশ্ন উঠেছে, তাঁরা শুধু জিরাফে থাকেন, না কি ধর্মেও? আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতাদের এখন ব্যাখ্যা করতে হচ্ছে, সিপিএম মানেই নাস্তিক নয়, পুজো-আচ্চা, নমাজ বা গির্জায় প্রার্থনাতে সিপিএম বাধা দেয় না। বোঝাতে হচ্ছে, স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরোধী হলে ধর্মাচরণে অভ্যস্ত বা ধর্মগুরুদের সঙ্গে পা মেলাতে তাঁদের অসুবিধা নেই।
মাসখানেক আগেই কেরলে সিপিএম অভিযোগ তুলেছিল যে, সে রাজ্যে কংগ্রেস তার শরিক ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করে ফেলেছে। কেরলে বাম জোটের আহ্বায়ক এ বিজয়রাঘবন বলেছিলেন, কংগ্রেস মুসলিম লিগকে কাজে লাগাচ্ছে। জামাত-ই-ইসলামির হাত ধরতে চাইছে। কংগ্রেস-মুসলিম লিগ নেতারা জবাবে বলেছিলেন, পিনারাই বিজয়ন সরকার শবরীমালায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মহিলাদের প্রবেশাধিকার দিতে গিয়ে হিন্দু ভোট হারিয়েছে। এখন তাই হিন্দু মন জিততে চাইছে। কিন্তু বিজয়রাঘবনের যুক্তি ছিল, বিজেপি-আরএসএসের সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতার জবাব সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতা হতে পারে না। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতা কি আরও তীব্র নয়?
পশ্চিমবঙ্গে সূর্যকান্ত মিশ্র-বিমান বসুরা এখন ঠিক এই প্রশ্নেরই মুখোমুখি। অভিযোগ, তাঁরা সিদ্দিকির সঙ্গে হাত মিলিয়ে, তৃণমূলের মুসলিম ভোটব্যাঙ্কে ভাগ বসিয়ে বিজেপির সুবিধা করে দিচ্ছেন। এর আগে আসাদুদ্দিন ওয়েইসির এমআইএম-এর বিরুদ্ধে একই অভিযোগ উঠেছে। ওয়েইসি একটাই যুক্তি দেন, মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক তাঁর ঝুলিতে এলে বিজেপির লাভ হল, না কংগ্রেসের লোকসান, তা দেখার দায়িত্ব তাঁর নয়। দাঁড়িপাল্লায় বিজেপি, তৃণমূলকে সমান চোখে দেখা সিপিএম নেতারাও একই সুরে কথা বলছেন।
সিপিএমের আর একটি যুক্তি, আব্বাসের দল মোটেই মুসলিম পার্টি নয়। দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু মানুষের মঞ্চ। এতেও সংখ্যালঘুর পাশাপাশি তৃণমূলের দলিত, আদিবাসী ভোটব্যাঙ্কে ভাঙন ধরে বিজেপির সুবিধা হতে পারে। ঠিক যেমন ওয়েইসি বিহার, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশে দলিত, ওবিসি পার্টির সঙ্গে জোট বাঁধেন। শুধু মুসলিম নয়, বিজেপি-বিরোধী জোটের দলিত-আদিবাসী ভোটব্যাঙ্কে ভাঙন ধরান। সিপিএম নেতারা বলছেন, এই সংখ্যালঘু-দলিত-আদিবাসী মঞ্চেরও লক্ষ্য ‘বিজেপি ঠেকাও, তৃণমূল হটাও’। তাই তাঁরা আইএসএফ-কে কাছে টেনেছেন।
একটা প্রশ্নের অবশ্য জবাব নেই। তা হল, ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর সিপিএম-কে সংখ্যালঘু-দলিত-আদিবাসীদের কাছে টানতে ৩৪ বছর বয়সি আব্বাস সিদ্দিকির হাত ধরতে হয় কেন? সর্বহারার পার্টি সিপিএম নিজের জোরে তাঁদের দলে টানতে পারে না কেন?
২০১৯-এর লোকসভায় বামেরা ৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। সে সময় বাংলায় সিপিএমের সদস্য সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৬৮ হাজারের কিছু বেশি। পার্টির পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০-তে সদস্য সংখ্যা আরও কমে ১ লক্ষ ৬০ হাজারের ঘরে নেমে এসেছে। ২০১১-য় মহাকরণ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সময় পার্টির সদস্য সংখ্যা ছিল ৩ লক্ষের বেশি। ২০২০-তে ১,৬০,৪৮৫ জন। এর মধ্যে মুসলিম মাত্র ২৬,০৩২ জন। ২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের হার প্রায় ২৭ শতাংশ। কিন্তু সিপিএমের সদস্যদের মধ্যে মুসলিম মাত্র ১৬.৪৭ শতাংশ। সিপিএমের সদস্যদের মধ্যে তফসিলি জাতির মানুষের সংখ্যা ২২.০৭ শতাংশ। আদিবাসী মাত্র ৫.৩ শতাংশ। মেহনতি, খেটে খাওয়া মানুষের পার্টির শ্রেণিচরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, শ্রমিক, খেতমজুর ও গরিব কৃষকদের মিলিত ভাবে পার্টিতে সংখ্যা মাত্র ৬০.৪৪ শতাংশ। দলের নথিতেও তা-ই মেনে নেওয়া হয়েছে, পার্টি সদস্যপদের ক্ষেত্রে শ্রেণি বিন্যাসের বিষয়টি আরও গুরুত্ব দাবি করে।
ব্রিগেডের জমায়েতে আব্বাসের ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সি সমর্থকদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ‘টুম্পা’ গান বাজিয়ে, জেএনইউ ক্যাম্পাস থেকে ঐশী ঘোষ, দীপ্সিতা ধরদের ব্রিগেডের মঞ্চে নিয়ে গিয়ে সিপিএম দেখাতে চেয়েছে, তাদেরও তরুণ মুখ রয়েছে। কিন্তু তথ্য বলে, সিপিএমে ৩০ বছরের কম বয়সিদের সংখ্যা মাত্র ৭.৬৮ শতাংশ। ২০১৯-এও তা ১০ শতাংশ ছুঁইছুঁই ছিল।
মায়াকোভস্কি লস্ট ইন কনফারেন্স-এ লিখেছিলেন, ‘ওয়ান মোর কনফারেন্স, ওয়ান লাস্ট কনফারেন্স, ওয়ান টু লিক্যুইডেট অল কনফারেন্সেস!’ বাংলায় ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে গত দশ বছরে সিপিএম একের পর এক দলীয় সম্মেলনে আগে নিজের জনভিত্তি বাড়ানোর শপথ করেছে। তার পর ভোট আসতেই সে সব ভুলে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক ডেকে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বার যেমন ভোটের হার বাড়াতে সিদ্দিকির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।
সত্যিই কি এতে সিপিএমের ভোট বাড়বে?
২০১৬-য় কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধেও আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা দাবি করেছিলেন, এতে বামফ্রন্টের ভোটের হার বাড়বে। বাস্তবে দেখা যায়, ২০১৪-র তুলনায় ২০১৬-তে বামেদের ভোটের হার আরও ৩ শতাংশ কমে যায়। অর্থ একটাই। ২০১৪-য় বামেদের যে ভোট বিজেপির ঝুলিতে গিয়েছিল, ২০১৬-তেও তা ফেরত আসেনি। এ বার বামফ্রন্টের নেতারা ৭ শতাংশ থেকে ভোটের ভাগ বাড়ানোর আশা করছেন। কিন্তু ‘ভাইজান’-কে দেখে, তাঁর পুরনো ভিডিয়ো দেখে সিপিএমের হিন্দু ভোটও বিজেপি বা তৃণমূলের দিকে চলে যাবে না তো? আর আব্বাস সিদ্দিকি যে ২০২১-এর পরে বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে থাকবেন না, সে তো নিজেই বলেছেন। তা হলে লাভটা কী হবে?
আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে হাত মেলানোটা যদি সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপস না-ও হয়, সেটা যে সিপিএমের বিনা পরিশ্রমে চটজলদি নির্বাচনে ভাল ফলের সুযোগ খোঁজা, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর সিপিএমের বিরুদ্ধে ‘সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িক শক্তি’-র সঙ্গে হাত মেলানোর অভিযোগও নতুন নয়। সিপিএম ষাটের দশকের শেষে কেরলে মুসলিম লিগের সঙ্গে স্থায়ী বন্ধুত্ব গড়ে জোট সরকার গড়েছিল। আশির দশকে মুসলিম লিগের সঙ্গত্যাগ করে। ২০০০ সালে ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগের সঙ্গে ফের জোটের চেষ্টা হয়। প্রবীণ ভি এস অচ্যুতানন্দন এর ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন। ২০১১-য় বাংলার পাশাপাশি সিপিএম কেরলেও ক্ষমতাচ্যুত হয়। পার্টি কংগ্রেসে তার ময়না-তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গিয়েছিল, ২০০৯-এর লোকসভা ভোটে কেরলে আব্দুল নাসের মাদানির পিডিপি-র হাত ধরতে গিয়ে পার্টিকে খেসারত দিতে হয়েছিল। ২০১১-র বিধানসভায় জামাত-ই-ইসলামির মতো ‘মৌলবাদী’ বলে পরিচিত সংগঠনের সঙ্গে সমঝোতা করার মাসুল গুনতে হয়।
এ বারের বিধানসভা ভোটের পরে হয়তো আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে সমঝোতার লাভ-লোকসান নিয়ে দিল্লির এ কে গোপালন ভবনে চুলচেরা বিচার শুরু হবে। না কি, বাংলায় ত্রিশঙ্কু বিধানসভা হলে সিপিএমকে ফের পলিটবুরো-কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক ডেকে বিচার করতে হবে, বিজেপি না তৃণমূল, কে বড় শত্রু?