Air pollution

যে বায়ুতে শ্বাস নেওয়াও কঠিন

এমনই দুঃসময়ে আমরা দীপাবলি পালন করি। এক রাতে সারা দেশের বাতাসে বাজির নানা রাসায়নিক মিশে যায়, সেই বিষ দেহে প্রবেশ করে স্থায়ী বাসা বাঁধে রক্ত, ফুসফুস এমনকি মস্তিষ্কে।

Advertisement

কল্যাণ রুদ্র

শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০২৩ ০৪:৩৩
Share:

প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

আমাদের শৈশবে শীতকাল ছিল আনন্দের; বার্ষিক পরীক্ষা শেষে ছুটিতে চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, ভিক্টোরিয়া ঘুরে আসা ছিল, ছিল শীতের রোদ গায়ে মেখে ক্রিকেট। কিন্তু শীতকাল এখন উদ্বেগের। শীতে ভারতের বড় শহরগুলিতে বাতাসের গুণগত মানের অবনতি হয়। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ বাতাসে ভাসমান যে ১২টি দূষক চিহ্নিত করেছে তার মধ্যে দু’টি, পিএম ১০ ও পিএম ২.৫ শীতকালে জনস্বাস্থ্যের পক্ষে নিরাপদ মাত্রা অতিক্রম করে। পারটিকুলেট ম্যাটার বা পিএম হল বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা, যার মধ্যে ব্ল্যাক কার্বন ও অন্যান্য দূষক মিশে থাকে। দৈনিক প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পিএম ১০ ও পিএম ২.৫-এর পরিমাণ যথাক্রমে ১০০ ও ৬০ মাইক্রোগ্রাম অতিক্রম করলে তা জনস্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর; এই সীমার বার্ষিক সহনশীল মাত্রা যথাক্রমে ৬০ ও ৪০ মাইক্রোগ্রাম। জনস্বাস্থ্যে ভাসমান দূষকের ক্ষতি করার ক্ষমতার নিরিখে ‘এয়ার কোয়ালিটি ইন্ডেক্স’ (একিউআই) হিসাব করা হয়। অতিসূক্ষ্ম বলেই পিএম ২.৫ নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমাদের দেহে প্রবেশ করলে ফুসফুস, হার্ট ও মস্তিষ্কে ছড়িয়ে যায়। ২০২২-এ প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্টে জানা গেছে, প্রতি বছর পৃথিবীতে পিএম ২.৫-এর প্রভাবে ৪২ লক্ষ মানুষ মারা যান।

Advertisement

কলকাতার বাতাসে বছরে ১২৪৮০ মেট্রিক টন পিএম ১০ এবং ৪০৫৪ মেট্রিক টন পিএম ২.৫ ভাসমান থাকে। এই দূষণের প্রধান উৎস রাস্তার ধুলো, কয়লা-কাঠ ইত্যাদি পোড়ানো ধোঁয়া, নানা ধরনের কণা, যানবাহন বা শিল্পকেন্দ্র থেকে নির্গত কার্বন ও উত্তর-পশ্চিম বাতাসের টানে প্রতিবেশী রাজ্য থেকে বয়ে আসা দূষণ, যার পরিমাণ ৩০-৫০%। এই দূষণ প্রতিরোধের জন্য ঝাড়খণ্ডের সীমান্ত বরাবর ৮০০ কিমি দীর্ঘ এক গাছের প্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এক কোটি পরিবার রান্নার জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করার ফলে বছরে ১.৩২ কোটি টন কার্বন বাতাসে মেশে। এই কোটি পরিবারকে উন্নত মানের উনুন দিয়ে দূষণ নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা রূপায়ণ শুরু হয়েছে। ভাসমান দূষণের পরিমাণ সারা বছর সমান থাকে না। দূষকগুলি ভূপৃষ্ঠ থেকে দুই কিমি উচ্চতার মধ্যে ভাসমান থাকে; বিজ্ঞানীরা ওই ঊর্ধ্বসীমার নাম দিয়েছেন ‘প্ল্যানেটারি বাউন্ডারি লেয়ার’ বা পিবিএল। অক্টোবর থেকে বৃষ্টি কমে গেলে উত্তাপ কমতে শুরু করে, তখন পিবিএল ভূপৃষ্ঠ থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে নেমে আসে, বাতাসের গতিও কমে যায়। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রতি ঘনমিটার বাতাসে দূষণের ঘনত্ব বেড়ে সহনশীল মাত্রা অতিক্রম করে। শীতকালে বাতাসের ক্রমহ্রাসমান গতিবেগ যদি প্রতি সেকেন্ডে ২ মিটারের কম হয়, তখন ভাসমান দূষক সাগরের দিকে বয়ে নিতে পারে না; আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে।

এমনই দুঃসময়ে আমরা দীপাবলি পালন করি। এক রাতে সারা দেশের বাতাসে বাজির নানা রাসায়নিক মিশে যায়, সেই বিষ দেহে প্রবেশ করে স্থায়ী বাসা বাঁধে রক্ত, ফুসফুস এমনকি মস্তিষ্কে। দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় সবুজ বাজির শব্দসীমা ১২৫ ডেসিবেলে বেঁধে রাত আটটা থেকে দশটা পর্যন্ত তা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। আদালতের নির্দেশ অনুসারে সবুজ বাজি পরীক্ষা করে তাকে ছাড়পত্র দেওয়ার দায়িত্ব ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল এঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট (নিরি)-এর, এবং উপাদানগুলি অনুমোদনের দায় পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড এক্সপ্লোসিভস সেফটি অর্গানাইজ়েশন-এর। এ সব পরীক্ষার জন্য রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ হলদিয়াতে পূর্ব ভারতের প্রথম বাজি পরীক্ষার গবেষণাগার তৈরি করেছে। কিন্তু, শব্দ নিয়ে নানা তর্কের মাঝে আমরা ভুলে যাই, আলোর বাজি আরও বিপজ্জনক— আলোর রোশনাইয়ের জন্য যে সব রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় এই বাজিতে, তার প্রায় সবই স্বাস্থ্যের পক্ষে ভয়ানক রকম ক্ষতিকর। আকাশে নানা আলোর রোশনাই দৃষ্টিনন্দন হলেও, বৃষ্টি না হলে শত চেষ্টাতেও এই বিষ থেকে আমাদের মুক্তি নেই। সংবাদে প্রকাশ, দিল্লির পরিস্থিতি এতই খারাপ যে, মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়াল কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের পথে হাঁটার কথা ভাবছেন।

Advertisement

সম্প্রতি এক সুইস গবেষণা সংস্থা জানিয়েছে, পৃথিবীর দূষিত শহরগুলির তালিকায় কলকাতার স্থান তৃতীয়, লাহোর আর দিল্লির পরে। মাঝে-মাঝে এমনও শোনা যায়, কলকাতার বাতাস দিল্লির থেকেও দূষিত। এই বিদেশি গবেষণা মূলত উপগ্রহচিত্র-নির্ভর। ২০২২-এ বিশ্ব ব্যাঙ্ক এক রিপোর্টে জানিয়েছে, উপগ্রহনির্ভর এ ধরনের তথ্য বাস্তব অবস্থা থেকে ৩৭-৬০% অতিরঞ্জিত হতে পারে। কলকাতায় ২০টি স্থানে বায়ূদূষণ পরিমাপ করা হয়; যে কোনও নাগরিক দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ওয়েবসাইটে সে তথ্য দেখতে পারেন। গত তিন বছরে ভারতের চারটি মেট্রোপলিটন শহরে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখছি, কলকাতার বাতাস দিল্লি বা মুম্বইয়ের তুলনায় অনেকটা ভাল। সমুদ্রতীরবর্তী বলে চেন্নাই ও মুম্বইয়ে দিনে রাতে সমুদ্রবায়ু ও স্থলবায়ু প্রবাহিত হয়ে বায়ুদূষণ অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে; নানা ব্যবস্থা গ্রহণের পর কলকাতার বাতাস কিছুটা উন্নত হয়েছে। তবে এখনও অনেক পথ বাকি। ভূ-উষ্ণায়ন নিয়ে সারা পৃথিবী উদ্বিগ্ন, দীপাবলির একটি রাতের আনন্দ যেন বাতাসকে আরও বিষিয়ে না দেয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement