২০১৮-তে ফরাসি দলে অভিবাসী খেলোয়াড়ের সংখ্যা ২৩-এর মধ্যে ১৭। ফাইল চিত্র।
২০১৮ সালে ফ্রান্স ফুটবলের বিশ্বকাপ জেতায় আমেরিকান কৌতুক অভিনেতা ট্রেভর নোয়া জনপ্রিয় টিভি প্রোগ্রাম দ্য ডেলি শো-তে দাবি করেন: “আফ্রিকা বিশ্বকাপ জিতেছে! আফ্রিকা বিশ্বকাপ জিতেছে!” ১৯৯৮-এর বিশ্বকাপ বিজয়ী ফরাসি ফুটবল দলের ন’জন খেলোয়াড় ছিলেন অভিবাসী, বা অভিবাসী-সন্তান। দু’দশক পর ২০১৮-তে ফরাসি দলে এমন খেলোয়াড়ের সংখ্যা ২৩-এর মধ্যে ১৭, দু’জন ছাড়া যাঁদের বাকিরা আফ্রিকান বংশোদ্ভূত।
চার বছর বাদে আবার টিভিতে বিশ্বকাপের খেলা দেখতে গিয়ে উপলব্ধি করি, ফুটবল বদলেছে। বদলেছে খেলা-সম্পর্কিত প্রযুক্তি, বদলেছে ক্রীড়া-দক্ষতার ভৌগোলিক বিন্যাস। সেই সঙ্গে কী ভীষণ ভাবে বদলাচ্ছে ইউরোপের সামাজিক-রাজনৈতিক চালচিত্রও। এ বারের বিশ্বকাপে ইউরোপের অন্তত দশটি দলে রয়েছেন মোট অর্ধশতাধিক কৃষ্ণাঙ্গ, মূলত আফ্রিকান বংশোদ্ভূত খেলোয়াড়।
এ সবই কয়েক শতাব্দীব্যাপী ঔপনিবেশিকতার পাল্টা ফল। আগামী কয়েক শতক ধরে এই শ্বেতাঙ্গ এবং খ্রিস্টান-প্রধান দেশগুলোর সমাজ-জীবনে অন্যতম প্রধান কুশীলব হবেন প্রাক্তন উপনিবেশের নাড়ি ছিঁড়ে আসা বাদামি, কালো এবং প্রধানত ভিন্ন ধর্মবিশ্বাসের মানুষ। পাল্টাবে ইউরোপের জনবিন্যাস, গাত্রবর্ণ, ধর্মীয় বিন্যাস, খাদ্যাভ্যাস, কথ্য ভাষা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সবই।
ঔপনিবেশিকতার উত্তরাধিকারের সঙ্গে অবশ্য রয়েছে বিশ্ব জুড়ে অগণিত ছিন্নমূল শরণার্থী ও অনুপ্রবেশকারীর স্রোতও। ইউরোপের অবাধ সীমান্ত দিয়ে যা ছড়িয়ে পড়ছে গোটা মহাদেশ জুড়ে।
কিন্তু এ সব আফ্রিকান বা এশীয় শিকড়ের মানুষ কতটা সম্পৃক্ত হতে পারছেন শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় সমাজে? ইউরোপিয়ান সোশিয়োলজিক্যাল রিভিউ-তে ২০১৩ সালের এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে যে, জাতীয় ফুটবল দলকে প্রায়শই ‘জার্মানিতে অভিবাসীদের সফল সংহতকরণের রোল মডেল’ হিসাবে দেখা হয়েছে, যদিও সে ক্ষেত্রেও রয়ে গিয়েছে ‘গ্রহণযোগ্যতার সমস্যা’।
১৯৯৮ সালে ফ্রান্স বিশ্বকাপ জেতার পর প্যারিসের আর্ক দ’ত্রিয়োঁফ-এ আলোকিত করা হয় অভিবাসী-সন্তান জ়িদানের মুখ। প্রশ্ন তবু থাকে। ২০১০ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপের সময়, ফ্রান্সের কয়েক জন আফ্রিকান বংশোদ্ভূত খেলোয়াড়, বিশেষ করে দলের অধিনায়ক প্যাট্রিস এভরা এবং নিকোলাস অ্যানেলকা অভিযুক্ত হয়েছিলেন খেলা শুরুর আগে ফরাসি জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে গলা না মেলাবার জন্য। ২০১৪-র বিশ্বকাপের ঠিক আগে ফরাসি তারকা করিম বেনজেমা বলেন, “গোল করতে পারলে আমি ফরাসি... গোল না করলে আমি এক জন আরব।” এমন কথা শোনা গিয়েছে রোমেলু লুকাকু-র কণ্ঠেও। ২০২১ সালে সকার অ্যান্ড সোসাইটি জার্নালে ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস-এর অধ্যাপক ওয়াইক্লিফ এনজোরোরাই সিমিউ ইউরোপের জাতীয় দলে এই সব আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ফুটবলারদের বর্ণনা করেছেন দু’মুখো তরোয়াল হিসেবে। এ যেন ইউরোপের বহুমুখী সংস্কৃতিকে স্বীকার করার এক সুযোগ, বিশেষত যখন তারা জিতবে। তবে খেলায় হারলে রয়েছে এর অপব্যবহারের ঝুঁকিও। গত বছর ইউরো কাপে ইটালির বিরুদ্ধে ফাইনালে পেনাল্টি মিস করায় প্রবল জাতিবিদ্বেষের মুখে পড়েন ইংল্যান্ডের তিন কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়। তবে শুধুমাত্র গায়ের রংটাই তো নির্ণায়ক নয়। ব্রেক্সিট গণভোটে যে সব ব্রিটিশ ইউরোপের নাড়ি ছিন্ন করে বেরোতে চেয়েছেন, তাঁদের অনেকেই রুখতে চেয়েছেন পূর্ব ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীদেরও। আমার এক ইটালীয় বন্ধু বলেছিলেন, ইটালিতে স্রোতের মতো আসা পূর্ব ইউরোপীয়রা তাঁদের সমাজে মিশে যেতে পারবেন না পঞ্চাশ বছরেও।
ফুটবল এবং ফুটবলের মহাতারকারা কি সত্যিই সীমানা ভুলিয়ে দিতে পারে? না কি, আরও প্রকট হয়ে ওঠে এক বৃহত্তর সামাজিক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপট? তৈরি হয় এক সামাজিক প্রতিরোধ? ইউরোপ জুড়ে সম্প্রতি অতি-দক্ষিণপন্থীদের রমরমার পিছনে এই বদলে যাওয়া সামাজিক প্রেক্ষিত তো ভীষণ ভাবে দায়ী। হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, স্পেন, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম— অতি-দক্ষিণপন্থা সর্বত্র আরও শক্তিশালী হচ্ছে। সুইডেনে প্রবল শক্তি বিস্তার করেছে অভিবাসন-বিরোধী সুইডেন ডেমোক্র্যাট দল। বাড়ছে ‘ইসলামোফোবিয়া’। ফ্রান্সে গত কয়েক বছরে উল্কার মতো উত্থান ঘটেছে মারিন লু’পেন-এর। আর ইটালিতে মুসোলিনির পরে এই প্রথম ক্ষমতা দখল করেছে কোনও অতি-দক্ষিণপন্থী দল, প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন জর্জিয়া মেলোনি।
তবু, এই ফরাসি ফুটবল দলের মিডফিল্ডার এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গা-র গল্পটা ভাবা যাক। তাঁর জন্ম অ্যাঙ্গোলার এক উদ্বাস্তু শিবিরে। গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তার পরিবার পালিয়ে আসে ফ্রান্সে, উদ্বাস্তু হয়েই। এদুয়ার্দোর বয়স তখন দুই। আঠারো বছর পরে, ইতিমধ্যেই রিয়েল মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ বিজয়ী কামাভিঙ্গা যখন কাতার বিশ্বকাপে ফ্রান্সের হয়ে খেলতে নামেন, রূপকথাই কি নেমে আসে না বাস্তবের মাটিতে?
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা