টোপের নাম ‘মুসলমান’, বঁড়শি হল ‘এনআরসি’, আর মাছ হল ‘গরিব মানুষ’! কী, কথা বুঝা আসছে?’’— বক্তার নাম আব্বাস সিদ্দিকি। বাম-কংগ্রেস নির্বাচনী জোটে যাঁর ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে মিডিয়া সরগরম। ধর্মীয় জলসায় করা তাঁর বক্তব্যের কিছু ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছে। দুটো বিশেষ ভয়ঙ্কর: একটা স্যামুয়েল প্যাটির হত্যাকারীর সমর্থনে, অন্যটা অভিনেত্রী সাংসদ নুসরত জাহানকে গাছে বেঁধে পেটানোর হুঙ্কার। যাঁরা এই মন্তব্যগুলোর সমালোচনায় মুখর, আমি তাঁদের সঙ্গে একমত। কিন্তু তাঁর ওয়াজ শোনা মানুষদের ‘মৌলবাদী’ বলে দাগিয়ে আলোচনার দরজাটা বন্ধ করে দেব? ‘জয় শ্রীরাম’ হুঙ্কার দেওয়া আমজনতাকে ‘চাড্ডি’ বলে গাল দেব, কিন্তু তাঁদের রাজনৈতিক সমর্থন জেতার চেষ্টা করব না?
২৬ জানুয়ারি লালকেল্লার ঘটনার পর যখন প্রচারযন্ত্র ঝাঁপিয়ে পড়েছে আন্দোলনরত চাষিদের ‘দেশদ্রোহী’ প্রমাণ করতে, তখন রাকেশ টিকায়েতের কান্না লক্ষ লক্ষ জাঠ কৃষককে ঐক্যবদ্ধ করে। মুজফ্ফরনগর দাঙ্গায় রাকেশ-নরেশ ভ্রাতৃদ্বয়ের ন্যক্কারজনক ভূমিকা ছিল। আজ রাকেশ টিকায়েত ফ্যাসিবাদী সরকারের শিরঃপীড়ার কারণ, কৃষক আন্দোলনের সর্বজনস্বীকৃত আইকন হয়ে উঠেছেন। তা বলে কি আমরা তাঁর অতীত, বা খাপ পঞ্চায়েতের পশ্চাৎমুখী সংস্কৃতির সমালোচনা করব না? অবশ্যই করব। সতর্কও থাকব, যাতে আন্দোলনের রাশ প্রগতিশীল কৃষক অংশের হাতে থাকে। কিন্তু ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জোটগঠনের প্রক্রিয়ায় তাঁকে বাদ দেব না। একই কথা আব্বাস সিদ্দিকির ক্ষেত্রেও।
খেটে খাওয়া মানুষ নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির দ্বারা চালিত সমাজে অসাম্যের সঙ্গে লড়তে লড়তে ক্লান্ত। মোদী সরকারের আমলে ভারতীয় মুসলমানের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে, প্রতিনিয়ত দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে দিতে তারা আজ নিজেদের আত্মপরিচিতিকে সজোরে ঘোষণা করতে চাইছে। তাদের এই অসহায়তার সুযোগ নিয়েই রমরমা হচ্ছে ‘সংখ্যালঘু সত্তার রাজনীতি’। মহারাষ্ট্র ও বিহার বিধানসভা ভোটে উগ্র সাম্প্রদায়িক তাস খেলে বিজেপির জয়ের পথ সুগম করেছে আশরাফ মুসলমান আসাদুদ্দিন ওয়েইসির নেতৃত্বাধীন মিম। আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে তাঁর বৈঠক চিন্তার ভাঁজ ফেলেছিল সমস্ত প্রগতিশীল মানুষের কপালে। এই অবস্থায় দুটো পথ খোলা ছিল। এক, নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক অবস্থান জাহির করে খেটে খাওয়া বাঙালি মুসলমান সমাজের নতুন আইকন আব্বাস সিদ্দিকি এবং বৃহৎ পুঁজি তথা অভিজাত শ্রেণির স্বার্থরক্ষায় ব্যস্ত ওয়েইসির জোট হতে দেওয়া। এতে বিজেপির পক্ষে নিখাদ সাম্প্রদায়িক লাইনে আড়াআড়ি ভোট ভাগের কাজ সহজতর হত। দুই, আব্বাস সিদ্দিকির মধ্যে শ্রেণি-উচ্চারণের যে প্রবণতা রয়েছে, তাকে স্বীকৃতি দিয়ে বাঙালি মুসলমান সমাজের সঙ্গে একটা আলোচনার পরিসর তৈরি করা। বামফ্রন্ট দ্বিতীয় পথটি বেছে নিয়েছে। সিপিআইএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, “পশ্চিমবঙ্গে সংযুক্ত মোর্চার কাজ কেবল নির্বাচনী সংগ্রামের মধ্যে সীমিত থাকবে না, তা সুদূরপ্রসারী হবে। শ্রেণি ও সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে।” বক্তব্যে ভুল নেই। প্রশ্ন হল সূর্যবাবুদের সদিচ্ছা নিয়ে। তাঁরা যদি ঠিক লড়াইগুলো সত্যিই করে যেতেন, তা হলে সমাজের নিপীড়িত মানুষগুলি তাঁদের থেকে এত বিচ্ছিন্ন হতেন না।
রাজ্যের ৪৬টা বিধানসভা আসনে সংখ্যালঘু ভোট অর্ধেকের বেশি। সব মিলিয়ে ১২৫টা আসনে মুসলিম ভোট নির্ণায়ক। প্রকৃত বিকল্প না থাকার দরুন ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে ঢেলে ভোট দিতে এক প্রকার বাধ্য হন বাংলার ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটার। ফলে তৃণমূল ১২টা আসন খোয়ানো সত্ত্বেও ৪৩ শতাংশ ভোট পায়।
মুসলিম ভোটের এই চেনা অঙ্ক অনেকটা বদলে গিয়েছে লকডাউনের সময় অভিবাসী শ্রমিকদের দুর্দশায়। অতিমারির মধ্যে না রাজ্য, না কেন্দ্র, কেউই এই মানুষগুলোর যন্ত্রণার কথা ভাবেনি। শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশা বহুগুণ বাড়িয়ে দিল আমপান ঝড়। অসহায় মানুষের চরম দুর্দিনে শাসক দলের নির্লজ্জ দুর্নীতিতে মানুষের ক্ষোভ চরমে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে আব্বাস সিদ্দিকি তাঁর মেঠো বক্তৃতায় মূলত কৃষিজীবী বাঙালি মুসলিম সমাজে বিপুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। দলিত-মুসলমান-আদিবাসী শ্রমজীবী মানুষের জীবনসংগ্রামের কথা ও বিধানসভায় তাঁদের সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের কথা উঠে এসেছে তাঁর বিভিন্ন রাজনৈতিক বক্তৃতায়। তাঁর রাজনৈতিক উত্থান এবং দলিত ও আদিবাসীদের নিয়ে রাজনৈতিক ফ্রন্ট গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট যে, বাংলার মেহনতি মানুষ ধর্মপরিচয়ের কারণে নিপীড়ন মেনে নিয়ে কেবল ভোটব্যাঙ্ক হয়ে থাকতে আর রাজি নন। আব্বাস যখন ভরা ব্রিগেডে পোড় খাওয়া নেতাদের সামনে বলেন, “ভিক্ষা নয়, হক বুঝে নিতে এসেছি”, জনতা উদ্বেল হয়ে ওঠে।
যে প্রান্তিক মুসলমান চাষি আব্বাস সিদ্দিকির টানে ব্রিগেড ভরালেন, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে সিপিএম তাঁর আস্থা হারিয়েছিল। রাজনীতিতে শূন্যস্থান পড়ে থাকে না, ফলে জায়গাটা ভরাট করেছে তৃণমূল। এখন দুধ দিতে দিতে গাইটির বাঁট শুকিয়ে গিয়েছে, তাই সে কখনও আব্বাস, কখনও ত্বহা, কখনও ওয়েইসির কাছে মুক্তির পথ খুঁজছে।
বামপন্থীরা কি এই ক্রান্তিকালে তাঁদের বিকল্প রাজনৈতিক মডেল দিতে পারবেন? পারবেন দেশব্যাপী চলমান কৃষি আন্দোলনের সঙ্গে বাংলার শোষিত নিপীড়িত ক্ষুদ্র ও জমিহীন কৃষককে এক তারে বাঁধতে? প্রান্তিক মানুষের মধ্যে আব্বাসের জনপ্রিয়তাকে হাতিয়ার করে খেতমজুর, ভাগচাষির কাছে পৌঁছতে হবে, তাঁদের মধ্যে শ্রেণি রাজনীতির বীজ বপন করতে হবে। সবার আগে প্রয়োজন পশ্চিমবঙ্গের মতো উচ্চ জনঘনত্বের রাজ্য, যেখানে অগণিত অদক্ষ শ্রমিক কাজের সুযোগ থেকে বঞ্চিত, সেখানে পুঁজিনিবিড় বৃহৎ শিল্পভিত্তিক উন্নয়নের নীতি যে ভুল ছিল, এ-কথা নতমস্তকে স্বীকার করা। আশার কথা, কাজের দাবিতে বামপন্থী ছাত্র-যুবরা পথে নেমেছেন। আমার আপনার সন্তানের চাকরির দাবিতে মইদুল মিদ্যা নামক তরতাজা যুবকটি ‘লাশ’ হয়ে গেলেন। এই পরিস্থিতিতে ব্রিগেডে প্রান্তিক মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ তৃণমূল-বিজেপি বাইনারিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তৃতীয় শক্তির জোরদার উপস্থিতি ঘোষণা করেছে। এক অন্য ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারবেন কি শ্রমজীবী মানুষ?
অর্থনীতি বিভাগ, ওয়েস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিক্যাল সায়েন্সেস