প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
দেশের প্রায় সমস্ত রাজ্যে, স্কুলশিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলি নিজ নিজ পরিধির মধ্যে আবদ্ধ থেকে কাজ করছে। অথচ, এই দুই স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে কাজের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেলে তা থেকে উভয়ই উপকৃত হতে পারে। আইআইটি, এনআইটি, এমস, আইআইএম, বা রাজ্যের অন্যান্য প্রথম সারির প্রযুক্তি-প্রতিষ্ঠান স্কুলের বহু ছাত্র-ছাত্রীর কাছে ভবিষ্যতের স্বপ্ন। স্কুলে পড়তে পড়তেই সেই প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে তাদের একটা যোগসূত্র গড়ে উঠবে, বিশ্বের শিক্ষা-মানচিত্রে যে প্রতিষ্ঠানগুলি জায়গা পেয়েছে, নিজের দেশের স্কুল-কলেজগুলির উন্নয়নে তাদের পথপ্রদর্শকের ভূমিকা থাকবে, এটাই বাঞ্ছনীয়।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিদ্যালয়গুলির মধ্যে সমন্বয়ের একটি উপায় হতে পারে নানা ধরনের প্রকল্প। কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে গিয়ে পড়াতে পারে, আবার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতেও বিভিন্ন কর্মশালায় আসতে পারে স্কুলের ছেলেমেয়েরা। গ্রীষ্ম ও শীতের ছুটিতে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কথা বিশেষ ভাবে মাথায় রেখে কিছু শিবির (সামার স্কুল বা উইন্টার স্কুল)-এর আয়োজন করতে পারে। পঠনপাঠনের বিষয়গুলিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে, ছাত্র-ছাত্রীদের গতানুগতিক চিন্তাকে প্রসারিত করতে, অথবা স্কুলের পাঠ্য থেকে উঠে আসা নানা প্রশ্নের সমাধান অনুসন্ধানে সহযোগিতা করতে সেগুলি বিশেষ কার্যকর হবে। বিভিন্ন প্রোজেক্টের মাধ্যমে হাতে-কলমে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষাদান করলে তা কিশোর-কিশোরীদের মনে গভীর রেখাপাত করে। তারা বিজ্ঞানের নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে উৎসুক হয়। প্রোজেক্টগুলি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, বা সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্র থেকে হতে পারে। আসল লক্ষ্য হল, প্রোজেক্টে রূপায়ণের প্রণালীকে এমন ভাবে সাজানো, যাতে সব স্তরের ছাত্র-ছাত্রীরা এক সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে কাজ করতে পারে, প্রয়োজনে শিক্ষকেরাও সঙ্গী হবেন।
এই ধরনের যৌথ প্রোজেক্টগুলি পরিকল্পনার সময়ে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের থেকে প্রত্যাশিত জ্ঞান ও দক্ষতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে হবে অবশ্যই। যেমন, থ্রি-ডি প্রিন্টিং-এর মতো একটি সহজ প্রযুক্তির প্রয়োগে একটি সাধারণ বস্তু নির্মাণ করার একটি প্রোজেক্ট ভাবা যায়। এখানে প্রিন্টারটি তৈরির কাজ, বা ইমেজ স্লাইসিং ও ক্যাড-এর কাজগুলির দায়িত্ব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা নিতে পারে, আর প্রিন্টিং-এর কাজ, যেটি তুলনায় সহজ, সেটি বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা অনায়াসে করতে পারে। অথবা, মাটির গুণগত মান নির্ধারণের জন্য ছোট একটি যন্ত্র নির্মাণ করার প্রোজেক্ট নেওয়া যায়, যা চাষের মাটির ক্ষারত্ব, আর্দ্রতা ও রাসায়নিক ঘনত্ব নির্ধারণ করার কাজে ব্যবহৃত হবে। এই ধরনের যন্ত্রের ডিজ়াইন এবং ক্যালিব্রেশন-এ প্রচুর ‘ফিল্ড ডেটা’-র প্রয়োজন হয়। তথ্য সংগ্রহের কাজটি নবম বা একাদশ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীরা করতে পারে, আবার যন্ত্রের প্রযুক্তিগত বাকি খুঁটিনাটি দিকগুলির দায়িত্ব দাদা-দিদিরা নিতে পারে। এই ধরনের বিভিন্ন পরীক্ষামূলক উদ্যোগ, পথপ্রদর্শন বা ‘মেন্টরিং’-এর উদ্যোগ, কর্মশালা, আলোচনা সভা, ইত্যাদি একযোগে করলে শেখার আনন্দ ও শিক্ষার মান, দুই-ই বাড়বে। তবে এর আগ্রহ প্রধানত আসা দরকার গবেষণা প্রতিষ্ঠান, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিদ্যালয়গুলির শিক্ষকদের থেকে।
অবশ্য এই ধরনের প্রচেষ্টা যে একেবারেই বিরল তা নয়। ন্যাশনাল সার্ভিস স্কিম (NSS)-এর মাধ্যমে এই দুই স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের এক সঙ্গে কাজ করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। সম্প্রতি ‘প্রাইম মিনিস্টার রিসার্চ ফেলো’দের বিদ্যালয় ও কলেজগুলিতে গিয়ে পড়ানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটা সত্যিই খুব ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে প্রয়োজনের তুলনায়, এদের সংখ্যা সীমিত। বিভিন্ন বিদ্যালয় পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি যে পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু ইত্যাদি রাজ্যে বিদ্যালয়ের কম্পিউটার ল্যাবগুলিতে উপযুক্ত শিক্ষক এবং সদিচ্ছার অভাবে কম্পিউটারগুলি বেশির ভাগ সময় ধূলিমলিন অবস্থায় পড়ে থাকে।
এ ভাবে একত্রে কাজ করার সুবাদে জ্ঞান, দক্ষতার বৃদ্ধি ছাড়াও যোগাযোগের যে নেটওয়ার্ক তৈরি হয়, সেটিকে সযত্নে বহন করলে ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বা চাকরির ক্ষেত্রে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হবে। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও বিভিন্ন ভাবে লাভবান হতে পারেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, এ থেকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের পাওয়ার তেমন কিছুই থাকে না। তা ঠিক নয়। তাদের জন্যে এ ধরনের শিবির একটা সুযোগ, নিজেদের অর্জিত জ্ঞান বা দক্ষতাকে বাস্তবে প্রয়োগ করে দেখার। যে কোনও একটি বিষয়কে স্কুলপড়ুয়াদের বোঝাতে গিয়ে সেই বিষয়টি অনেক বেশি পরিষ্কার হয়, চিন্তা ও জ্ঞানের স্বচ্ছতা বাড়ে। এ ছাড়া কর্মশালার আয়োজন, প্রোজেক্ট-এর কাজ করার ফলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সাংগঠনিক দক্ষতা বাড়ে। গবেষণার কাজে, এমনকি ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রেও তা বিশেষ ভাবে সহায়তা করে। সর্বোপরি, তাদের সামাজিক সংযুক্তি বৃদ্ধি পায়, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশেষ ভাবে প্রয়োজন। উদ্যোগ, সদিচ্ছা, পরিশ্রম আর ইতিবাচক মনোভাব দিয়েই আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের এই সমন্বয়ের স্বাদ এবং উপকারিতা দেওয়া যায়।