সেই সময় মণিপুর ও বাকি ভারতে ছিল মৈত্রী ও একতার যোগ
Manipur

এক অন্য মণিপুরের কাহিনি

আজ়াদ হিন্দ ফৌজ মণিপুরের মেইতেই, কুকি, মুসলমান সকল সম্প্রদায়ের কাছে নিয়ে এসেছিল মুক্তির বাণী ও আশা।

Advertisement

সুমন্ত্র বসু

শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০২৩ ০৪:৫৫
Share:

ইতিহাস: আজ়াদ হিন্দ ফৌজ-এর মণিপুরি সৈন্যদের সঙ্গে শিশির বসু ও কৃষ্ণা বসু। ইম্ফল, ১৯৭২। নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো।

অধুনা রক্তাক্ত, দাঙ্গা-কবলিত মণিপুরের এক অন্য ইতিহাস অনেকেরই অজানা। ১৯৪৪ সালে মণিপুর ছিল আজ়াদ হিন্দ ফৌজের প্রধান রণাঙ্গন। ১৮ মার্চ ১৯৪৪ তারিখে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সৈনিকরা ভারতের মাটিতে প্রবেশ করেন এই মণিপুর দিয়েই। জুলাই মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত মণিপুরের প্রায় দশ-বারো হাজার বর্গ কিলোমিটার ছিল আজ়াদ হিন্দ সরকারের অধীনে মুক্তাঞ্চল। আইএনএ-র গান্ধী ব্রিগেড কর্নেল এনায়েত কিয়ানির নেতৃত্বে অসীম বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছিল ইম্ফল উপত্যকার ঠিক পূর্বে পাহাড়ি পালেল টেঙ্গুনপল এলাকায়। ইম্ফলের উত্তর-পূর্বে উখরুল পাহাড়ি এলাকায় ছিল শাহ নওয়াজ় খানের নেতৃত্বে সুভাষ ব্রিগেড। আর ইম্ফল উপত্যকার মৈরাঙে ইম্ফল শহরের পঁচিশ মাইল দক্ষিণে ঘাঁটি গেড়েছিল আইএনএ-র ‘বাহাদুর গ্রুপ’-এর স্পেশাল ফোর্সেস, কর্নেল শওকত মালিকের নেতৃত্বে। সবার মাথার উপরে আইএনএ-র ফার্স্ট ডিভিশনের কমান্ডার মহম্মদ জ়ামান কিয়ানি। তাঁর হেড কোয়ার্টার বর্মা সীমান্তের কাছে চামোল নামক একটি পার্বত্য গ্রামে।

Advertisement

এই ইতিহাস অনেকেই জানেন। কিন্তু অনেকেই জানেন না যে, আজ়াদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রামে মণিপুরের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে শামিল হয়েছিলেন, উজাড় করে দিয়েছিলেন তাঁদের সমর্থন। সেই কাহিনি লিখে গেছেন কৃষ্ণা বসু। ১৯৭২ সালের অক্টোবরে কৃষ্ণা ও শিশির বসু দেশ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লেখেন: ‘কেউ ভোলে না কেউ ভোলে’। পরে কৃষ্ণা বসুর প্রসঙ্গ সুভাষচন্দ্র গ্রন্থে প্রবন্ধটি স্থান পায়। অতি সম্প্রতি, ২০২২ সালে প্রবন্ধটি ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হয়েছে কৃষ্ণা বসুর নেতাজি: সুভাষচন্দ্র বোসেস লাইফ, পলিটিক্স অব স্ট্রাগল গ্রন্থে।

১৪ এপ্রিল ১৯৪৪ ছিল মণিপুরি মেইতেইদের নববর্ষ। সেই দিন বাহাদুর গ্রুপের সৈনিকরা এবং মৈরাঙের কয়েকশো নাগরিক সমবেত হন। শওকত মালিক ত্রিবর্ণরঞ্জিত চরকা-সম্বলিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন। তার পর দিলেন এক উদাত্ত ভাষণ। সেই হিন্দুস্থানি বক্তৃতা স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ করে শোনালেন এক যুবক। নাম এম কৈরাং সিংহ। পরবর্তী কালে মণিপুরের প্রথম নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী, ‘মৈরাং কৈরাং’ নামে পরিচিত। সেই থেকে জুলাই পর্যন্ত বাহাদুর গ্রুপের প্রধান অবলম্বন স্থানীয় মানুষের সমর্থন। তাঁরা প্রতি দিন আজ়াদি সৈনিকদের চাল, আনাজ এবং লোকতাক লেকের মাছ জোগাতেন। ১৯৭২-এ শিশির ও কৃষ্ণা বসুর প্রধান সফরসঙ্গী ছিলেন এইচ নীলমণি সিংহ, যিনি তখন মণিপুরের শিক্ষামন্ত্রী ও মৈরাঙের বিধায়ক। ১৯৪৪ সালে নীলমণির পরিবার তাঁদের নিজেদের বসতবাড়ি শওকত মালিককে ছেড়ে দেন। সেখানেই বাহাদুর গ্রুপের হেড কোয়ার্টার স্থাপিত হয়।

Advertisement

জুলাই মাসে সামরিক বিপর্যয়ের মধ্যে মণিপুর থেকে আইএনএ-র রিট্রিট শুরু হয়। নীলমণি ও কৈরাং-সহ মোট সতেরো জন মণিপুরি তরুণ-তরুণী সেই রিট্রিটে শামিল হলেন। সকলেই নিখিল মণিপুরি মহাসভার সদস্য। সতেরো জনের মধ্যে দু’জন মহিলা: কৈন্যা দেবী ও রান্ধোনী দেবী। প্রায় দু’মাস লেগেছিল পাহাড় আর ঘন জঙ্গল অতিক্রম করে রেঙ্গুনে পৌঁছতে। দিনেরবেলা বোমারু বিমানের উপদ্রব, তাই রাতে পথ চলা। সেপ্টেম্বরে রেঙ্গুনে পৌঁছে সতেরো জনের দেখা হল নেতাজির সঙ্গে। নীলমণি নেতাজির হাতে তুলে দিলেন তিন হাজার টাকা, তাঁর বাবার সারা জীবনের সঞ্চয়। বাবা নীলমণিকে টাকাটা দিয়ে বলেছিলেন, দেখা হলে নেতাজিকে এটা দিয়ো।

ইংরেজরা মে, ১৯৪৫-এ রেঙ্গুন দখল করার পর সতেরো জনের স্থান হল রেঙ্গুন সেন্ট্রাল জেলে। সাত মাস পরে বন্দিদশায় নিয়ে আসা হল কলকাতায়। মে, ১৯৪৬-এ মুক্তি ও মণিপুরে প্রত্যাবর্তন। তত দিনে তাঁরা বিখ্যাত। লোকের মুখে মুখে তাঁদের নাম।

মণিপুরের মেইতেইরা বৈষ্ণব। কিন্তু মণিপুরের প্রায় দশ শতাংশ মানুষ মুসলমান। সেই সম্প্রদায়ের এক জন, নাম নাকী মহম্মদ, ছিলেন বাহাদুর গ্রুপের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। নাকী মহম্মদ ব্রিটিশ ফৌজে সিপাই ছিলেন। সিঙ্গাপুরে আত্মসমর্পণের পর আজ়াদ হিন্দ ফৌজে যোগ দেন। মৈরাঙে প্রবেশ করার আগে শওকত মালিক তাঁর এই বিশ্বস্ত সৈনিকটিকে স্কাউট হিসাবে পাঠান স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে পথ প্রশস্ত করতে। তা করতে গিয়ে তিনি ধরা পড়ে যান। নিয়ে যাওয়া হয় দিল্লির লাল কেল্লায়। পরে পঞ্জাবের মুলতান জেলে।

নীলমণি-কৈরাংরা শিশির ও কৃষ্ণা বসুকে বলেন, আইএনএ-র রিট্রিট শুরু হওয়ার ঠিক আগে নেতাজি মণিপুরে এসেছিলেন। কিন্তু এখানে অর্থাৎ ইম্ফল উপত্যকায় নয়, কিছুটা দক্ষিণে চূড়াচাঁদপুর বলে একটা জায়গায়।

ছোট ছিমছাম পার্বত্য শহর চূড়াচাঁদপুরে খোঁজ করতেই স্থানীয় বাসিন্দারা বললেন, হ্যাঁ, সোজা চলে যান সাইকট গ্রামে। এখান থেকে চার মাইল। সাইকটের বৃদ্ধ রাজা এখনও জীবিত, উনি সব জানেন। ‘রাজা’ শুনে ওঁরা ভেবেছিলেন, সাইকটে প্রাসাদ আছে। গ্রামে পৌঁছে দেখলেন, রাজা থাকেন এক জীর্ণ কুটিরে। তবু তিনি রাজা-ই। কুকি-জ়ো সম্প্রদায়ের মানুষ গ্রামের মোড়লকে রাজা বলে সম্বোধন করেন।

রাজার নাম কলবেল। পরনে পুরনো ধাঁচের সুট। বয়স পঁচাত্তর পেরিয়েছে, কিন্তু বেশ শক্তসমর্থ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কিছু দিন ফ্রান্সে ছিলেন। অজস্র কুকি পুরুষদের মতো ইংরেজরা তাঁকেও নিয়ে গিয়েছিল ইউরোপের রণাঙ্গনে কুলি হিসাবে ট্রেঞ্চ কাটতে। কলবেল জানালেন, দিনটা ছিল ২ জুলাই ১৯৪৪। পাহাড়-ঘেরা গ্রাম। সেই পাহাড়ের উপর আইএনএ-র একটি বড়সড় ক্যাম্প। নেতাজি সেই ক্যাম্পে এসেছিলেন। তার পর গোধূলি লগ্নে গ্রামে গেলেন। কলবেলের কুটিরের বাগানে একটা গাছের তলায় একটু বিশ্রাম নিতে বসলেন। এই সেই গাছ, কলবেল দেখালেন। আমরা এটির পরিচর্যা করি।

কলবেল বললেন, সে এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। চাঁদের আলোয় গ্রাম ভেসে যাচ্ছে। দেখছেন তো, বাগানটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে ওই নদী পর্যন্ত। ওই ঢালুতে এসে বসলেন কয়েকশো সৈনিক। নেতাজি একটা সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন। পরনে খাকি ইউনিফর্ম, কোমরবন্ধে পিস্তল। গ্রামবাসীরা সমবেত সৈনিকদের গরম চা খাওয়ালেন। কলবেল নেতাজিকে এক গেলাস দুধ দিলেন। নেতাজি একটু অবাক হয়ে বললেন, বাকি সকলের জন্য চা, আমার দুধ কেন? কলবেল বললেন, বিশিষ্ট অতিথিকে দুধ দেওয়াই ওঁদের সামাজিক প্রথা। নেতাজি বললেন, আচ্ছা তা হলে ঠিক আছে, কিন্তু সাধারণত আমার সৈনিকরা যা খেতে পায় তা ছাড়া আমি কিছু খাই না।

চলে যাওয়ার সময় হলে নেতাজি কলবেলকে বললেন, আমি জানি আপনারা ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষেরা খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করে আমার সৈনিকদের বাঁচিয়ে রেখেছেন। নিশ্চিন্ত থাকুন। স্বাধীন ভারতবর্ষে আপনাদের এই সাহয্যের কথা আমি ভুলব না। তার পর একটা চিরকুটে সই করে কলবেলের হাতে দিয়ে বললেন, এটা রাখতে পারেন, কিন্তু সাবধানে রাখবেন। ইংরেজদের হাতে পড়ে গেলে আপনার অসুবিধা হতে পারে। কলবেল চিরকুটটি আরও কিছু জিনিসের সঙ্গে একটা বাক্সে মাটির তলায় পুঁতে রাখেন, জল ঢুকে সেটি নষ্ট হয়ে যায়।

আজ়াদ হিন্দ ফৌজ মণিপুরের মেইতেই, কুকি, মুসলমান সকল সম্প্রদায়ের কাছে নিয়ে এসেছিল মুক্তির বাণী ও আশা। মেইতেইরা মনে রেখেছিলেন, ইংরেজরা কী ভাবে ১৮৯১ সালে বীর টিকেন্দ্রজিৎ ও তাঁর সেনাপতিকে ফাঁসি দিয়েছিল। কুকিরা মনে রেখেছিলেন ১৯১৭ থেকে ১৯১৯ ইংরেজরা তাঁদের উপর কী নৃশংস অত্যাচার করেছিল, যাকে এখন ‘অ্যাংলো-কুকি ওয়ার’ বলা হয়। আর মণিপুরের আর এক বৃহৎ জনগোষ্ঠী নাগাদের কথাই বা বাদ যায় কেন? অঙ্গমি জ়াপু ফিজ়ো ১৯৪৪ সালে আজ়াদ হিন্দ ফৌজে যোগ দেন। সতীর্থদের নিয়ে মার্চ করে চলে যান রেঙ্গুনে, ঠিক মেইতেই সম্প্রদায়ের যুবক-যুবতীদের মতো।

স্বাধীন ভারতে একতা ও মৈত্রীর এই ঐতিহ্য কোথায় যেন হারিয়ে গেল, মণিপুর-সহ
উত্তর-পূর্ব ভারত হয়ে উঠল অশান্ত, অগ্নিগর্ভ। ১৯৮৫-র অক্টোবরে শিশির ও কৃষ্ণা বসু আবার মণিপুর গিয়েছিলেন। সফরসঙ্গী ছিলেন আজ়াদ হিন্দ ফৌজের কর্নেল প্রেম সহগল। মণিপুরের মানুষ তখন থেকেই ভারতের রাষ্ট্রশক্তিকে এবং
তার সামরিক বাহিনীকে অবিশ্বাস এমনকি ঘৃণার চোখে দেখেন।

দুর্ভাগ্য মণিপুরের, দুর্ভাগ্য ভারতবর্ষের।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement