কীর্তি: গুপ্তযুগের মন্দিরস্থাপত্যের নিদর্শন দশাবতার মন্দির। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস।
১৭৮৩ সালে শোভাবাজারের নবকৃষ্ণ দেবের হাতে আসে কালীঘাট থেকে পাওয়া একটি পুরনো মুদ্রাসম্ভার। ওয়ারেন হেস্টিংসের হাত ঘুরে তা পৌঁছয় ব্রিটেনে। সে সময় কেউই বোঝেননি এই মুদ্রাগুলির লিপি। ১৮৩৬-এ জেমস প্রিন্সেপ ব্রাহ্মীলিপির পাঠোদ্ধার করেন। পড়া যায় এলাহাবাদের একটি অশোকস্তম্ভের গায়ে অশোকের লেখর পাশেই খোদিত দীর্ঘ লেখটিও, যার লিপি কালীঘাটের মুদ্রাগুলির মতোই। এই লিপি ব্রাহ্মীরই এক বিবর্তিত রূপ। এই লেখ জানায় এক নতুন রাজার গৌরবগাথা। সেই সমুদ্রগুপ্তের মন্ত্রী হরিষেণই এর রচয়িতা। সামনে আসে বিস্মৃতপ্রায় গুপ্ত রাজবংশের ইতিহাস।
খ্রিস্টীয় চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতকে উত্তর ও মধ্য ভারতে ছিল গুপ্তদের আধিপত্য। দক্ষিণের বাকাটক ও কদম্বদের সঙ্গেও বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল তাঁদের। বিশাল মৌর্য সাম্রাজ্য খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের শুরুতেই ভেঙে পড়েছিল। পরের পাঁচ শতক একদা মৌর্য প্রশাসনের কর্মচারী (শুঙ্গ) বা মৌর্যদের অধীনতা কাটিয়ে ওঠা স্বাধীন শক্তিদের (যেমন মহারাষ্ট্রের সাতবাহন, কলিঙ্গের খারবেল) পাশাপাশি, উত্তর, পশ্চিম, ও উত্তর-পশ্চিমে ক্ষমতা বিস্তার করেছিল ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে থেকে আসা শক্তিরাও— যেমন ব্যাকট্রিয়ার গ্রিক, পারস্যের পহ্লব, মধ্য এশীয় শক ও কুষাণরা। চতুর্থ শতকে গুপ্তদের উত্থান পরাধীন ভারতের জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিতে ছিল মৌর্য-পরবর্তী যুগের ‘বিদেশি’ শক্তিদের সরিয়ে ‘ভারতীয়’ শক্তির পুনরুত্থান। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত শকদের পরাস্ত করেছিলেন। হুনদের আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন স্কন্দগুপ্ত। বহু জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদের কাছে প্রথম চন্দ্রগুপ্ত, সমুদ্রগুপ্ত, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত, কুমারগুপ্ত ও স্কন্দগুপ্ত, পাঁচ শক্তিশালী রাজার ধারাবাহিক স্থিতিশীল সুশাসন ছিল এক ‘সুবর্ণযুগ’, যার বৈশিষ্ট্য ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃত ভাষার ‘পুনরুত্থান’।
মৌর্য ও সাতবাহন লেখগুলির ভাষা মূলত প্রাকৃত। গুপ্তদের লেখমালার ভাষা সংস্কৃত। কালিদাস ও বিশাখদত্তের মতো সংস্কৃত সাহিত্যিক, শব্দকোষ রচয়িতা অমরসিংহ গুপ্ত রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত। কবি অমরু ও ভর্তৃহরি, পঞ্চতন্ত্র-রচয়িতা বিষ্ণুশর্মাও এই যুগের মানুষ। পাশাপাশি প্রাকৃত ভাষার ব্যাকরণ লিখেছেন বররুচি। বাকাটক রাজারা অনেকেই ছিলেন দক্ষ প্রাকৃত কবি। তামিল ভাষার দুই শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য শিলপ্পদিকারম ও মণিমেকলাই-এর রচনাও এ সময়। গণিতের জগতে ‘শূন্য’-র ব্যবহার এ যুগের যুগান্তকারী আবিষ্কার। বরাহমিহির বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সঙ্গে প্রচলিত ব্রাহ্মণ্য ধর্মবিশ্বাস, কুসংস্কার, ফলিত জ্যোতিষ মিশিয়ে ফেললেও, আর্যভট্ট যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রাহু-কেতুর কাল্পনিক ধারণা নাকচ করে গ্রহণের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিয়েছেন, অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিতের নানা শাখায়। সুশ্রুতের পদ্ধতিতে ঘটেছিল শল্যচিকিৎসার উন্নতি। ভারতের প্রাচীনতম মন্দিরস্থাপত্যের নিদর্শনগুলি গুপ্তযুগের। গুপ্তযুগের ভাস্কর্য ও অজন্তার চিত্রকৃতিগুলি বিশ্ববন্দিত। ইতিহাসবিদরা এখন ‘সুবর্ণযুগ’-এর মতো অতিরঞ্জিত বিশেষণ পরিত্যাগ করলেও, গুপ্তযুগে ধ্রুপদী সংস্কৃতির উন্নতি অনস্বীকার্য। রমেশচন্দ্র মজুমদারের ভাষায় তাই এই সময় ‘ধ্রুপদী যুগ’।
গুপ্তরাজারা ব্রাহ্মণ্যধর্মে বিশ্বাস করতেন। মৌর্য যুগে প্রতিবাদী ধর্মগুলির প্রাধান্যের পর ব্রাহ্মণ্যধর্মও চরিত্র বদলায়। প্রাচীন যজ্ঞকেন্দ্রিক বৈদিক ধর্মের ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ প্রভৃতি দেবতাদের বদলে জনপ্রিয় হতে থাকে বৈদিক ও লৌকিক উপাদানের মিশ্রণে সৃষ্ট ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, শক্তি প্রমুখের মূর্তিপূজা ও মন্দিরস্থাপন। যজ্ঞের মতো পূজাতেও পৌরোহিত্যের অধিকার থাকে ব্রাহ্মণেরই। কিন্তু তীর্থভ্রমণ, ব্রতপালনের মতো বিকল্প ধর্মাচরণের সুযোগ মেলে তথাকথিত নিম্নবর্ণ ও নারীদেরও। বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত ইত্যাদি নবগঠিত সম্প্রদায়গুলির কিংবদন্তি ও ধর্মতত্ত্ব সঙ্কলিত হয় পুরাণগুলিতে। প্রাচীনতম পুরাণগুলি গুপ্তযুগেই রচিত। গুপ্তরাজারা ছিলেন পৌরাণিক বৈষ্ণবধর্মের অনুগামী। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের ‘চক্রবিক্রম’ মুদ্রায় চক্রবর্তী সম্রাটের শক্তির উৎস বিষ্ণুর চক্রপুরুষ। তাঁর নির্মিত মধ্যপ্রদেশের উদয়গিরি গুহামন্দিরের ভূদেবীর রক্ষাকর্তা বরাহরূপী বিষ্ণু সম্রাটেরই প্রতিভূ। কালিদাসের রঘুবংশ-তে ফুটে ওঠে রাজৈশ্বর্য (শ্রীদেবী) আর রাজ্য (ভূদেবী)-র স্বামী ও রক্ষাকর্তা হিসাবে বিষ্ণু ও রাজার সাদৃশ্য। স্কন্দগুপ্তের এক মুদ্রায় রাজাই লক্ষ্মীস্বরূপা শ্রীদেবীর স্বামী। অবশ্য গুপ্তরাজারা পরধর্মবিদ্বেষী ছিলেন না। সিংহলরাজ মেঘবর্ণের অনুরোধে বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীদের জন্য বুদ্ধগয়ায় বিশ্রামাগার নির্মাণ করান সমুদ্রগুপ্ত। উদয়গিরি গুহামন্দিরের অদূরে সাঁচী স্তূপে দান করেন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সেনাপতি আম্রকার্দব। গুপ্তযুগেই নির্মাণ নালন্দা মহাবিহারের।
বিংশ শতাব্দী জুড়ে বিভিন্ন আবিষ্কার বদলে দিয়েছে ‘সুবর্ণযুগ’-এর স্থিতিশীলতার ধারণা— গুপ্ত সিংহাসনের জন্য প্রতি প্রজন্মেই ঘটেছিল রক্তাক্ত সংঘাত। আবিষ্কৃত হয়েছে সমুদ্রগুপ্তের বৈমাত্রেয় ভাই কাচের মুদ্রা। বৌদ্ধ গ্রন্থ মঞ্জুশ্রীমূলকল্প-এর ভিত্তিতে পরমেশ্বরীলাল গুপ্ত দেখিয়েছেন, কাচ অল্প সময় রাজত্ব করে যুদ্ধে নিহত হন। বিশাখদত্তের দেবীচন্দ্রগুপ্তম্ নাটকে দেখা যায়, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত তাঁর দাদা রামগুপ্তকে হত্যা করে রাজা হন, বিবাহ করেন রামগুপ্তের স্ত্রী ধ্রুবাদেবীকে। এই ঘটনার উল্লেখ মেলে বাণভট্ট, রাজশেখর, ভোজের রচনায়, রাষ্ট্রকূট রাজা অমোঘবর্ষের লেখতে। ধ্রুবাদেবী দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের স্ত্রী, কুমারগুপ্ত ও গোবিন্দগুপ্তের মা হিসাবে বিভিন্ন লেখতে উল্লিখিত। রামগুপ্তের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহের নিরসন ঘটায় রামগুপ্তের নামাঙ্কিত তাম্রমুদ্রা এবং তিনটি জৈন মূর্তির আবিষ্কার। হুন আক্রমণ প্রতিহত করা স্কন্দগুপ্তের নাম নেই তাঁর পরবর্তী গুপ্তরাজাদের বংশলতিকায়! কারণ, স্কন্দগুপ্ত ছিলেন না কোনও রানির সন্তান। কুমারগুপ্ত যখন মৃত্যুশয্যায়, পুষ্যমিত্র জনজাতির আক্রমণ ও কুমারগুপ্তের ভাই ঘটোৎকচগুপ্তের বিদ্রোহে সঙ্কটাপন্ন সাম্রাজ্যকে রক্ষা করে যোদ্ধা স্কন্দগুপ্ত বাবার সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তাঁর নিজের লেখতেও নাম নেই তাঁর মায়ের, যদিও পূর্ববর্তী রাজমাতাদের উল্লেখ আছে প্রথামাফিক। স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন কুমারগুপ্তের রানি অনন্তদেবীর সন্তান পুরুগুপ্তের উত্তরসূরিরা। তাঁদের বংশলতিকায় বাদ পড়েন স্কন্দগুপ্ত। এ সময় দুর্বল হচ্ছিল সাম্রাজ্যের আর্থিক ভিত্তিও। ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতন অবসান ঘটায় রোম-ভারত সমৃদ্ধ সমুদ্রবাণিজ্যের। স্কন্দগুপ্তের সময় থেকেই কমতে থাকে স্বর্ণমুদ্রার সংখ্যা ও মান। রামশরণ শর্মার মতো বামপন্থী ইতিহাসবিদদের মতে গুপ্তযুগে বাণিজ্য, মুদ্রাব্যবস্থা, নগরায়ণের অবক্ষয় এবং সাম্রাজ্যের বিকেন্দ্রীকরণের শুরু, যা ক্রমশ সামন্ততন্ত্রের রূপ নেয়।
পঞ্চম শতকের চিনা পরিব্রাজক ফাশিয়ান (আগেকার বানানে, ফা হিয়েন) অবশ্য এক সমৃদ্ধ দেশকেই দেখেছিলেন, যার প্রশাসন প্রজাকল্যাণকামী, উদার, সেনাবাহিনী ও কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন পান— সামন্ততান্ত্রিক অবক্ষয় নয়। তা কি ‘বিদেশি শাসন’-এর অবসানে ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃত ভাষার পুনরুত্থানের ফল? গুপ্তযুগের আর্থিক সমৃদ্ধির ভিত্তি কিন্তু মৌর্য-পরবর্তী যুগই, যখন চিন থেকে রোম পর্যন্ত বিস্তৃত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথের অন্যতম অংশ ছিল ভারতও। ভারতীয় পণ্যের জন্য রোমের বিপুল সোনা-রুপো এ দেশে চলে আসা প্রশ্ন তুলেছিল রোমান সেনেটেও। কুষাণ বিম কদফিসেসই ভারতে স্বর্ণমুদ্রার প্রবর্তন করেন। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের পরিমণ্ডলে ‘বহিরাগত’রাও অনেকেই আপন করে নেন ভারতীয় ধর্ম, সংস্কৃতিকে। হুনরা বহিরাগত আক্রমণকারী হলেও, যে শকদের সঙ্গে গুপ্তরা লড়েছিলেন তাঁরা বহু শতাব্দী ভারতীয় উপমহাদেশেরই অধিবাসী। সংস্কৃতে দীর্ঘ রাজপ্রশস্তি লেখানোর শুরুও শক রাজা রুদ্রদামার জুনাগড় লেখতে। কুষাণ পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত অশ্বঘোষ রচনা করেন বুদ্ধচরিত। সংস্কৃত শিল্পতত্ত্বের আকরগ্রন্থ নাট্যশাস্ত্র-রচয়িতা ভরত, প্রবাদপ্রতিম নাট্যকার ভাসও মৌর্য-পরবর্তী যুগের মানুষ। এ সময়েই রচিত হয়েছিল আয়ুর্বেদের আদি-সঙ্কলন চরক-সংহিতা। গুপ্তযুগকে সংস্কৃত ভাষার ‘পুনরুত্থানের যুগ’ বলা তাই কষ্টসাধ্য। সংস্কৃতচর্চার নতুন ধারার সৃষ্টি হয়েছিল মৌর্য-পরবর্তী যুগেই, গুপ্তযুগে তা শিখরে পৌঁছয়। গুপ্তযুগের শিল্পোন্নতির পিছনেও রয়েছে মৌর্য-পরবর্তী যুগের মথুরা, গান্ধার, অমরাবতীর ভাস্কর্যধারা এবং স্তূপ-বিহার-চৈত্যস্থাপত্যের ইতিহাস। পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিকাশের সূচনাও মৌর্য-পরবর্তীযুগেই। গ্রিক রাজা আগাথোক্লিসের মুদ্রায় কৃষ্ণ-বলরামের প্রতিকৃতি, গ্রিক দূত হেলিয়োডোরাসের বিদিশায় নির্মিত কৃষ্ণমন্দিরের টিকে থাকা গরুড়স্তম্ভ সেই সাক্ষ্যই দেয়। কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক যেমন ছিলেন মহাযান বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক, তেমনই মধ্য এশীয়, গ্রিক, পারসিক দেবতাদের পাশাপাশি উমা ও বিশাখ (কার্তিক)-এর মূর্তি স্থাপন করান তিনি। ব্রাহ্মণ্যপরম্পরার প্রধান ‘ধর্মশাস্ত্র’ মনুস্মৃতি-ও রচিত এ সময়। গুপ্তযুগের সংস্কৃতি তাই মৌর্য-পরবর্তী যুগের বিপরীত নয়, এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার ফল।
জাতীয়তাবাদী ‘সুবর্ণযুগ’ ও বামপন্থী ‘সামন্ততন্ত্র’— গুপ্তযুগের দু’টি ব্যাখ্যারই সীমাবদ্ধতা রয়েছে। রোমিলা থাপর তাই খেয়াল করিয়ে দেন ধ্রুপদী সংস্কৃতির বাইরেও গুপ্তযুগের বৃহত্তর ঐতিহাসিক তাৎপর্য। গুপ্তযুগ এক দিকে পূর্ববর্তী যুগের ধারাবাহিকতা বহন করে, অন্য দিকে জন্ম দেয় অনেক নতুন বৈশিষ্ট্যের, যেগুলি অনুসৃত হয় গুপ্ত-পরবর্তী যুগেও— যেমন, বিকেন্দ্রীকৃত রাজনীতি, রাজসভার সংস্কৃতি, নিয়মিত সংস্কৃত প্রশস্তিরচনা, মন্দির নির্মাণ, রাজাদের দীর্ঘ উপাধিগ্রহণ, পৌরাণিক ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা। গুপ্তযুগ তাই প্রাচীন ও আদিমধ্যযুগের ভারতের মধ্যে চৌকাঠের মতো এক যুগসন্ধিক্ষণ— ‘থ্রেশোল্ড টাইমস’।