—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
দিন দুয়েক আগে এক সহকর্মী কথা প্রসঙ্গে আমায় জানালেন যে, তিনি উত্তরপ্রদেশের ঐতিহ্যমণ্ডিত এক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আলোচনা সভায় অংশ নিতে যাওয়ার জন্য ট্রেনের টিকিট কেটেছেন। কিন্তু এখন তিনি কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। আমারই মতো ইসলাম ধর্মাবলম্বী সেই অধ্যাপককে কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি খানিক ক্ষণ নতমস্তকে নিশ্চুপ থেকে বললেন, “ভয় করে। দাগিয়ে রেখেছে, যদি নিকেশ করে দেয়?” তাঁর হাতের খবরের কাগজে জ্বলজ্বল করছে হরিয়ানার দাঙ্গায় বেছে বেছে মুসলিমদের বাড়ি ও দোকানে অগ্নিসঞ্চার এবং দূরপাল্লার ট্রেনে এক আরপিএফ জওয়ান কী ভাবে তিন মুসলিমকে হত্যা করেছে— সেই খবর দু’টি।
চার পাশ থেকে ভয় যেন ঘিরে ধরছে আমাকে, আমাদের। এমন নয় যে সংশয়, আশঙ্কা, নিরাপত্তাহীনতা আগে ছিল না। বাড়ি ভাড়া খুঁজতে গিয়ে নিজের মুসলিম পরিচয় দেওয়ার আগে কত বার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় পেয়েছি। বন্ধুকে শবে বরাতের দাওয়াত দিয়ে সংশয়দীর্ণ মনে অপেক্ষা করেছি। যদি তাকে তার পরিবার মুসলমান বাড়িতে খেতে আসতে না দেয়? শিশুসন্তান স্কুল থেকে ফিরলে জিজ্ঞাসা করেছি, তার বন্ধুরা সদ্যপালিত বকরি ইদ নিয়ে কিছু কটু কথা বলেছে কি না। প্যান্ডেলে বসে দুর্গাপুজোর ভোগ খাওয়ার সময় আড়চোখে তাকিয়েছি বন্ধুদের দিকে, কখন কে জিজ্ঞেস করে বসে ভোগ খেয়ে আমার জাত গেল কি না। ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের সময় পাকিস্তানকে তুমুল গালাগালি করেছি এই ভয়ে যাতে বন্ধুরা অন্য রকম কিছু না ভাবে। অন্তরের অন্দরে ভয়, অনিশ্চয়তা নিয়েই তো বেঁচে থাকা আমাদের। কিন্তু আজ যেন সেই ভয় অন্দর থেকে বেরিয়ে দানবীয় হাইড্রার অগুনতি শুঁড়ের মতো সব দিক থেকে ঘিরে ধরেছে। হিন্দু বান্ধবীদের সঙ্গে সামলে কথা বলি; কী জানি যদি কেউ হাসির ছলেও ‘লাভ জিহাদ’ বলে বসে। ট্রেনে-বাসে দেশের সব সমস্যার জন্য ‘মোল্লা’রা দায়ী শুনলে দেঁতো হাসি হেসে চুপ করে থাকি। দাড়ি-টুপি পরা বৃদ্ধ নমাজিকে নিয়ে টিটকিরি কাটা হচ্ছে শুনলে ভয়ে ভয়ে তাঁকে রাস্তাটুকু পার করে দিই। ভিনরাজ্যের বন্ধুর কাছে শুনি তারা মাংস কিনে চুপি চুপি বাড়ি ফেরেন, কারণ যে কেউ যে কোনও সময় এসে কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করতে পারে তিনি গো-মাংস কিনেছেন কি না। বাবরি মসজিদ-এর জায়গায় রামমন্দির হুড়মুড়িয়ে মাথা তুললে হাসি হাসি মুখে বন্ধুদের সঙ্গে অযোধ্যার অর্থনৈতিক উন্নতির কথা আলোচনা করি। এনআরসি-র ভয়ে আঁতিপাতি করে দলিল-দস্তাবেজ উল্টাই, নয়তো আমার দেশেই আমি বিদেশি বলে চিহ্নিত হব। কোভিড অতিমারির শুরুতে তঘলিবি জামাতের সমাবেশের সমালোচনা হলে মুখ লুকোই; এত দিন দাঙ্গাকারী, অপরাধী, সন্ত্রাসবাদী, তালিবান, এই সব উপাধি আমাদের গলার মালা হয়ে থেকেছে। এ বার কি অতিমারি বহনকারীর খেতাব গলায় ঝুলবে আলবাট্রসের মতো? হে আমার দেশ, আর কত ভয়, আর কত রকমের আশঙ্কা আমায় তুমি উপহার দেবে? স্বাধীনতার অমৃত-পর্ব চলছে। হে আমার প্রিয় জন্মভূমি, আমাদের জন্য কি তবে শুধু গরলটুকুই বরাদ্দ রইল?
অথচ, এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। কত শত দোল-দুর্গোৎসব এক সঙ্গে কেটে গেল আনন্দ ভাগ করে, কত শত বছর ইদের সিমুই ভাগ করে খেলাম। লালন ফকিরের গানে গলা মিলিয়ে কেটেছে কত দিন, সন্ত কবীরের দোঁহা পড়ে নিশ্চুপ হয়েছি কত বার। খাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগায় প্রার্থনা করেছি এক সঙ্গে। পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা এবং উস্তাদ জ়াকির হুসেন-এর যুগলবন্দির মুর্ছনায় মুগ্ধ হয়েছি কত সন্ধে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছি ইংরেজদের সঙ্গে। এক জন গান্ধী থাকলে, সঙ্গে থেকেছেন এক জন সীমান্ত গান্ধী। এক জন সুভাষচন্দ্র বসু থাকলে সঙ্গে থেকেছেন এক জন শাহনওয়াজ খান। এই তো সে দিন কার্গিল-এর লড়াইয়ে ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা শহিদ হলেন, প্রাণ দিলেন ক্যাপ্টেন হানিফুদ্দিনও— এই ভূখণ্ডটুকুকেই ভালবেসে। সুখ-দুঃখ, জয়-পরাজয় ভাগ করে কেটে গেছে হাজার বছর। এই জুড়ে জুড়ে থাকা, এই বেঁধে বেঁধে থাকা যাপন রীতি, যা কিনা এক যুক্ত সাধনার মতোই আমরা প্রাণে ধারণ করেছি এত কাল— সে সবই কি আজ মুছে গেল? সহাবস্থানের এই ঐতিহ্য যেমন রয়েছে আমাদের ইতিহাসের প্রতি পরতে, সবই কি আমরা ভুলে যেতে বসেছি?
ভুলিয়ে দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন দেশের আজকের শাসক। প্রধানমন্ত্রী বিদেশের মাটিতে সদর্পে ঘোষণা করেছেন যে, ভারতবর্ষ ১০০০ বছরের বৈদেশিক শাসনের হাত থেকে পাওয়া স্বাধীনতা পালন করছে। তাঁর হিসেবে ভারতবর্ষের মুসলিম মাত্রেই বিদেশি। অনায়াসে কলমের আঁচড়ে শহর জনপদের নাম বদলে দেওয়া হচ্ছে, মুছে ফেলা হচ্ছে মুসলিম অনুষঙ্গ। মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের ‘ঘর ওয়াপসি’ ঘটানো হচ্ছে, অর্থাৎ তাঁদের ধর্মান্তরিত করে হিন্দুত্বের পথে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। ইতিহাস নতুন করে লেখা হচ্ছে। মুছে ফেলা হচ্ছে ভারতবর্ষের ইতিহাসের মুসলিম পর্বটি। সম্রাট আকবরের দীন-ই-ইলাহি, তাঁর সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রচেষ্টা গুরুত্ব হারাচ্ছে নতুন ইতিহাসে। কয়েকটি রাজ্যের স্কুল পাঠ্য গ্রন্থে সম্রাট আকবর তো সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নয়া ইতিহাসে মুসলিম অবদান আজ উধাও।
সদ্যপ্রয়াত চেক লেখক মিলান কুন্দেরা তাঁর একটি গ্রন্থে লিখেছিলেন, একটি দেশের মানুষকে মেরে ফেলার সহজতম পথ হল তার স্মৃতি কেড়ে নেওয়া, মুছে ফেলা তার অতীত। তাদের বই, সংস্কৃতি এবং ইতিহাস ধ্বংস করে অন্য বই, অন্য সংস্কৃতি, অন্য ইতিহাস এগিয়ে দেওয়া। দেশের মানুষের পক্ষে সংগঠিত স্মৃতি বিভ্রমের এই মরুভূমি অতিক্রম করে টিকে থাকা অসম্ভব। ভারতের শাসক আজ সেই মরুভূমি সৃষ্টি করেছে সফল ভাবে। মানুষ ভুলেছে সহাবস্থানের ইতিহাস, ভালবাসার সংস্কৃতি। শাসক এগিয়ে দিয়েছে শত্রুতার ইতিহাস, ঘৃণার সংস্কৃতি।
আমরা ভয় পাই। প্রাণের ভয়, সামান্য অবশিষ্ট আত্মসম্মানটুকু হারাবার ভয়। কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভয় পাই প্রাণপ্রিয় এই দেশের জন্য। ভয় পাই যে, ভারতবর্ষ নামক ভূখণ্ডটি রয়ে যাবে, হারিয়ে যাবে ভারতবর্ষ নামক ধারণাটি।