জনসংখ্যাতাত্ত্বিক গবেষণা-বিষয়ক একটি বিখ্যাত জার্নাল আমার অফিস-টেবিলের উপর ছুড়ে দিয়ে অধ্যাপক-বন্ধু আহিল উত্তেজিত ভাবে বলল, “খুব যে বলো, আমাদের দেশে মেয়েদের অবস্থা নাকি আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে! আরও বেশি নাকি তাঁরা গার্হস্থ হিংসার শিকার হচ্ছেন! জার্নালটা খুলে প্রথম প্রবন্ধটা দেখো। হাইপারগ্যামি ইজ় ফলিং!”
সমাজতত্ত্বে ‘হাইপারগ্যামি’ বলতে বোঝায় এক জন মহিলা তাঁর নিজের চেয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতা বা আয়ের নিরিখে উচ্চতর সামাজিক মর্যাদার পুরুষকে বিবাহ করার প্রথাকে। জার্নালটা হাতে তুলে নিয়ে প্রথম প্রবন্ধটায় চোখ বোলালাম। গত তিন দশকের তথ্যের ভিত্তিতে গবেষক দেখিয়েছেন যে, ভারতে বৈবাহিক সম্পর্কের মোট সংখ্যার অনুপাতে, হাইপারগ্যামাস বৈবাহিক সম্পর্কের (অর্থাৎ, এমন বৈবাহিক সম্পর্ক যেখানে হাইপারগ্যামি প্রথা মান্যতা পেয়েছে) সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে।
আহিল বলল, “এর পরও বলবে মেয়েরা পিছিয়ে পড়ছেন সমাজে? গার্হস্থ হিংসা বাড়ছে? আমার তো বরং উল্টোটাই মনে হয়। চারিদিকে নারী শক্তির জয়জয়কার!”
জিজ্ঞেস করলাম, “কী ভাবে সেটা প্রমাণ হল?”
আহিল অবাক, “সে কী! বুঝতে পারছ না, হাইপারগ্যামি হ্রাস পাওয়া মানে সমাজে এমন বৈবাহিক সম্পর্কের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া, যে সম্পর্কে শিক্ষা বা আয়ের নিরিখে মেয়েরা তাঁদের স্বামীদের সমান অথবা এগিয়ে? তার মানে তো বৈবাহিক সম্পর্কে মেয়েদের ক্ষমতায়ন! এর ফলে তো গার্হস্থ হিংসা কমার কথা সমাজে! ভুল বলছি?”
হেসে বললাম, “একদম ভুল। ভারতীয় সমাজে হাইপারগ্যামি হ্রাস পাচ্ছে, সেটা আমিও গবেষণা করে পেয়েছি। কিন্তু তার ফলে আমাদের দেশে গার্হস্থ হিংসা কমেনি, বরং বৃদ্ধি পেয়েছে চোখে পড়ার মতো! বস্তুত, আমাদের দেশে যে সব কারণে গার্হস্থ হিংসা বৃদ্ধি পায়, হাইপারগ্যামি হ্রাস পাওয়াটা তার অন্যতম। অন্তত আমার গবেষণা সেই দিকেই ইঙ্গিত করছে। মিনিট দশেক সময় আছে? তা হলে আমার গবেষণায় কী দেখতে পাচ্ছি, বলি।”
আহিল মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল।
বললাম, “ভারতের ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে ২০১৫-১৬’র তথ্যের ভিত্তিতে আমার গবেষণায় দেখতে পাচ্ছি যে, স্বামী-স্ত্রীর শিক্ষাগত যোগ্যতা বা আয়ের নিরিখে, যে সমস্ত বৈবাহিক সম্পর্কে হাইপারগ্যামি প্রথা মান্যতা পেয়েছে, তার তুলনায় যে সমস্ত বৈবাহিক সম্পর্কে হাইপারগ্যামি প্রথা মান্যতা পায়নি, সেই সমস্ত বৈবাহিক সম্পর্কে মেয়েদের সমস্ত রকমের গার্হস্থ হিংসার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বেশি। যে সব বৈবাহিক সম্পর্কে হাইপারগ্যামি মান্যতা পেয়েছে, অর্থাৎ যে সমস্ত ক্ষেত্রে বিয়ের সময় মেয়ের চেয়ে ছেলের শিক্ষাগত যোগ্যতা বা আয় বেশি ছিল, তার তুলনায় যে সমস্ত বৈবাহিক সম্পর্কে হাইপারগ্যামি মান্যতা পায়নি, তেমন বৈবাহিক সম্পর্কে মেয়েদের গুরুতর শারীরিক গার্হস্থ হিংসার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা অন্তত ৬% বেশি। কম-গুরুতর শারীরিক গার্হস্থ হিংসার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি অন্তত ১৪%। যৌন গার্হস্থ হিংসার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি অন্তত ৫%, এবং মানসিক গার্হস্থ হিংসার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা অন্তত ৬% বেশি।”
একটু থেমে বললাম, “সুতরাং বুঝতেই পারছ, ভারতে ‘হাইপারগ্যামি’ কমছে বলে মেয়েরা গার্হস্থ হিংসার শিকার বেশি বই কম হচ্ছে না।”
আহিল বলল, “কিন্তু কেন এমনটা হবে? ধ্রুপদী অর্থনীতির তত্ত্ব তো বলে…”
ওকে শেষ করতে না দিয়েই বললাম, “ধ্রুপদী অর্থনীতির তত্ত্ব যেটা বলে, তুমিও সেটাই বললে একটু আগে। অর্থাৎ, যে সমস্ত বৈবাহিক সম্পর্কে হাইপারগ্যামি মান্যতা পেয়েছে, তার তুলনায় যে সমস্ত বৈবাহিক সম্পর্কে হাইপারগ্যামি মান্যতা পায়নি, সেই সমস্ত বৈবাহিক সম্পর্কে মেয়েরা অর্থনৈতিক ভাবে বেশি শক্তিশালী হন। তাঁদের গার্হস্থ হিংসার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা কমে।”
আহিল মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল।
বললাম, “কিন্তু স্যর, দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেভেন দ্যান ধ্রুপদী অর্থনীতি! এটা ঠিকই যে, হাইপারগ্যামি মেনে না চলা বৈবাহিক সম্পর্কে মেয়েরা— ধ্রুপদী অর্থনীতির তত্ত্ব মেনে— অর্থনৈতিক ভাবে বেশি শক্তিশালী হন, ফলে তাঁদের গার্হস্থ হিংসার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা তুলনায় কম হওয়ার কথা। কিন্তু তার সঙ্গে এটাও ঠিক যে, মেয়েরা যখন সামাজিক মর্যাদার নিরিখে তাঁদের স্বামীর তুলনায় উচ্চতর কিংবা সমান স্তরে অবস্থান করেন— হাইপারগ্যামি মেনে না চলা বৈবাহিক সম্পর্কে যেটা হওয়ার কথা— তখন তাঁরা লিঙ্গের ভূমিকা সম্পর্কে পুরুষতান্ত্রিক বিশ্বাস এবং পুরুষত্বের প্রভাবশালী ধারণাগুলির মূলে আঘাত করেন। স্ত্রীর তুলনায় পুরুষের বেশি উপার্জন করা উচিত, অথবা পরিবার চলা উচিত প্রাথমিক ভাবে পুরুষের রোজগারে— এমন সব বিশ্বাসে ধাক্কা লাগার ফলে বৈবাহিক সম্পর্কে মারাত্মক দ্বন্দ্ব ও হিংস্রতা তৈরি হতে পারে— সমাজতত্ত্বের ভাষায় যাকে বলে ‘মেল ব্যাকল্যাশ এফেক্ট’।”
আহিল বলল, “বুঝলাম। সম্ভবত ‘মেল ব্যাকল্যাশ’-এর তত্ত্বটা খুব একটা আলোচিত হয় না বলেই আমরা ধরে নিই যে, বৈবাহিক সম্পর্কে মেয়েরা পুরুষদের থেকে সামাজিক মর্যাদার নিরিখে উচ্চতর আসনে অবস্থান করলেই তাঁরা গার্হস্থ হিংসার শিকার কম হবেন। ধারণাটার গোড়াতেই যে গলদ, সেটা খেয়াল করি না।”
বললাম, “ঠিক তাই। এখানে আরও একটা কথা বলে রাখি তোমাকে— সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের তথ্যের ভিত্তিতে হওয়া গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যে সমস্ত বৈবাহিক সম্পর্কে মেয়েরা পুরুষদের থেকে সামাজিক মর্যাদার নিরিখে উচ্চতর আসনে অবস্থান করছেন, সেই সমস্ত বৈবাহিক সম্পর্কের অন্তর্গত মেয়েদের অবসাদে ভোগার প্রবণতা বেশি, দাম্পত্যে সুখী হওয়ার প্রবণতা কম এবং তাঁদের পুত্র সন্তানদের মধ্যে লিঙ্গ-বৈষম্যমূলক মনোভাব সৃষ্টি হওয়ার প্রবণতা বেশি। সুতরাং বুঝতেই পারছ, হাইপারগ্যামি মেনে হওয়া বিয়ের তুলনায় যে সমস্ত বৈবাহিক সম্পর্কে হাইপারগ্যামি মান্যতা পায়নি, সেই সমস্ত বৈবাহিক সম্পর্কে মেয়েদের একাধিক সামাজিক সূচকের নিরিখে আরও প্রতিকূল অবস্থায় থাকার সম্ভাবনা বেশি।”
আহিল এক মুহূর্ত কী যেন ভাবল। তার পর বলল, “আমরা যে কেবল বলি, সমাজে মেয়েদের অবস্থার উন্নতির জন্য এমন প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত, যা লিঙ্গবৈষম্য কমাতে সাহায্য করবে— কিন্তু তোমার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে যে, এই রকম প্রকল্পগুলি উল্টো ফলাফল দিতে পারে। যাকে বলে, ‘পলিসি ব্যাকফায়ার’ ঘটতে পারে! মানে এত যে মেয়েদের শিক্ষিত করার, মেয়েদের শ্রম-বাজার রোজগার বাড়ানোর প্রকল্প রাজ্যে এবং দেশে— এর দরুন যদি সমাজে হাইপারগ্যামি মেনে হওয়া বিয়ের সংখ্যা কমে যায়, বৈবাহিক সম্পর্কে সামাজিক মর্যাদার নিরিখে মেয়েরা তাঁদের স্বামীদের সমান হয়ে ওঠেন বা উচ্চতর জায়গায় পৌঁছে যান, তা হলে তো এই প্রকল্পগুলি গার্হস্থ হিংসা বৃদ্ধি করতে সহায়ক হয়ে উঠতে পারে! তার মানে কি এই ধরনের প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া উচিত?”
বললাম, “একেবারেই না। যে প্রকল্পগুলি সত্যিই সমাজে লিঙ্গবৈষম্য কমাতে সাহায্য করে, সেগুলিকে বন্ধ করার কথা কেউ সুস্থ মস্তিষ্কে বলতে পারে না। কিন্তু যে হেতু এই ধরনের প্রকল্পগুলির কিছু উদ্বেগজনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে— বিশেষ করে গার্হস্থ হিংসার নিরিখে আমাদের মতো পুরুষতান্ত্রিক দেশে— তাই নীতিনির্ধারকদের উচিত এই ধরনের প্রকল্পগুলির সঙ্গে কিছু পরিপূরক নীতি গ্রহণ করা, যেগুলি সমাজে বস্তাপচা পুরুষতান্ত্রিক ধারণাগুলিকে বদলাতে সাহায্য করবে, মেয়েদের বিবাহবিচ্ছেদ চাওয়ার জন্য সহজতর পরিবেশ তৈরি করবে এবং পুরুষদের শেখাবে মেয়েদের ‘দুর্বল’ না ভেবে নিজেদের সমকক্ষ হিসাবে দেখতে।”
আহিল বলল, “তা হলেই হয়তো স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে আমাদের দেশের মেয়েরা স্বাধীনতার সঠিক মানেটা বুঝতে পারবেন। তাই না?”
হেসে বললাম, “ঠিক তাই!”
অর্থনীতি বিভাগ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়