কৃষকের আয় বাড়াতে হলে
agriculture

সর্বজনীন শিক্ষার সঙ্গে কৃষিক্ষেত্রে আয়ের সম্পর্ক কী?

পারিবারিক শ্রম দিয়ে চাষ করলে জোতের আকার খুব ছোট হলেও একর-প্রতি উৎপাদন তুলনামূলক ভাবে বেশি হয়, তাই সামগ্রিক উৎপাদনও বেশি।

Advertisement

অচিন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২১ ০৬:২০
Share:

জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থা সম্প্রতি কিছু পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে কৃষিজীবী পরিবারের অবস্থা নিয়ে। সমীক্ষাটি করা হয়েছিল ২০১৮-১৯ সালে। এই সমীক্ষার ফলাফলের সঙ্গে অন্য সূত্রে পাওয়া আরও খানিক পরিসংখ্যান মিশিয়ে দেখা যাক পশ্চিমবঙ্গের কৃষিক্ষেত্র তথা গ্রামাঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থাটা আপেক্ষিক ভাবে কেমন।

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গের একটি কৃষিজীবী পরিবারের গড়পড়তা আয় মাসে ৬০৮৪ টাকা, যেখানে সর্বভারতীয় গড় ১০,২১৮ টাকা— পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় অনেকটা বেশি। এই আয়ের পুরোটা যে কৃষি থেকেই আসছে, তা নয়। বস্তুত কৃষি থেকে আসছে অর্ধেকেরও কম, বাকিটা আসছে কৃষির বাইরে থেকে— মজুরি বা বেতন থেকে হতে পারে, বা নিজস্ব ব্যবসা থেকে। তা হলে, এই যে শুনি এ রাজ্য ধান উৎপাদনে প্রথম স্থানে, আনাজ উৎপাদনেও প্রথম, সেগুলি কি ভুল? না, ভুল নয়। ২০১৯-২০ সালে পশ্চিমবঙ্গে মোট ধান উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৫৭ লক্ষ টন, যা রাজ্যগুলির মধ্যে সর্বোচ্চ। এমনকি গত এক দশকে পশ্চিমবঙ্গে কৃষি উৎপাদনে বৃদ্ধির হার ভারতীয় গড় হারের থেকে অনেকটাই বেশি। গোটা দেশে যে হার ১.৬ শতাংশ, পশ্চিমবঙ্গে তা ৩.৩ শতাংশ।

আর ধাঁধাটা সেখানেই। ধানের মোট উৎপাদনে সব রাজ্যকে পিছনে ফেললেও, কৃষি উৎপাদনের বৃদ্ধির হার ভারতীয় গড়ের থেকে অনেকটা বেশি হলেও, কৃষকের আয়ের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাচ্ছে অনেক পিছনে। এটা কী করে হয়? এর সঙ্গে যদি গ্রামাঞ্চলে মাথাপিছু ভোগব্যয়ের বৃদ্ধির ছবিটা দেখি, তা হলে মকদ্দমাটা আরও জটিল হয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে ২০১১-১২ থেকে ২০১৭-১৮-র মধ্যে মাথাপিছু প্রকৃত (অর্থাৎ মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব বাদ দিয়ে) ভোগব্যয় বেড়েছে ৫ শতাংশ, গোটা গ্রামীণ ভারতে যা বেড়েছে ৩ শতাংশ। অতএব রাজ্যের গ্রামের মানুষ জীবনযাত্রার মানের দিক থেকে সমগ্র দেশের তুলনায় পিছিয়ে পড়ছেন, তা-ও বলা যাচ্ছে না।

Advertisement

এখানে বলে রাখি, কৃষিজীবী পরিবার কাকে বলব, তা জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থাই নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। যে সব পরিবারে বছরে অন্তত চার হাজার টাকা আসছে কৃষি থেকে, এবং পরিবারের অন্তত এক জন সদস্য পুরো বা আংশিক সময় নিজের জমিতে চাষে যুক্ত থাকেন, সেই পরিবারকেই বলা হবে কৃষিজীবী পরিবার। পশ্চিমবঙ্গে এমন পরিবারের সংখ্যা মোটামুটি ৬৭ লক্ষ, যা গ্রামীণ পরিবারগুলির মধ্যে ৪৪ শতাংশ।

সামগ্রিক উৎপাদন বেশি, কিন্তু অধিকাংশ কৃষকের আয় কম, এ রকম পরিস্থিতি সম্ভব, যদি জমির মালিকানা খুব অসম হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাটা সে রকম নয়। অন্য রাজ্যের তুলনায় এখানে জমির মালিকানায় অসাম্য কম। ব্যাখ্যাটা তাই খুঁজতে হবে অন্যত্র। দেখতে হবে একটি গড়পড়তা কৃষিজোতের আকারের দিকে। এটা অনেকেরই হয়তো জানা যে, পশ্চিমবঙ্গে জোতের আকার খুব ছোট। কৃষিজীবী পরিবারগুলির দুই-তৃতীয়াংশেরই জমির পরিমাণ এক একর বা তার কম। আর ৯৪ শতাংশের জমির পরিমাণ এক হেক্টর বা তার কম। এঁরা সবাই প্রান্তিক কৃষক। ভারতে প্রান্তিক কৃষকের অনুপাত মোট কৃষকের ৭১ শতাংশের মতো।

পারিবারিক শ্রম দিয়ে চাষ করলে জোতের আকার খুব ছোট হলেও একর-প্রতি উৎপাদন তুলনামূলক ভাবে বেশি হয়, তাই সামগ্রিক উৎপাদনও বেশি। কিন্তু পরিবার পিছু আয় হয় খুব কম, জমির পরিমাণ কম বলে। এ রকম অতি ক্ষুদ্র জোতে চাষবাসের ভবিষ্যৎ কেমন? উজ্জ্বল যে নয়, তা বোঝা যাচ্ছে। তবু কৃষকরা চাষবাস করে চলেছেন বিকল্প তেমন নেই বলে। আর দ্বিতীয়ত, ফসলের অনেকটা তাঁরা রেখে দেন নিজেরা খাবেন বলে। ফলে বাজার থেকে কিনে খেতে যতটা ব্যয় হত, তার থেকে কমে অন্নের সংস্থান হয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে উৎপন্ন মোট ধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বাজারে আসে না। এটাও অন্য রাজ্যের তুলনায় যথেষ্ট বেশি।

উৎপাদন কাঠামো এ রকম বলে সরকারি সংগ্রহ ব্যবস্থার সুফলও বেশি দূর যেতে পারে না। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে দেখছি যে, পশ্চিমবঙ্গে মোট ধান উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৫৭ লক্ষ টন। অথচ সরকারের সংগ্রহ হয়েছে ১৮ লক্ষ টন, অর্থাৎ সাড়ে এগারো শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হচ্ছে ৪০-৫০ লক্ষ টন, কিন্তু প্রকৃত সংগ্রহ তার ধারকাছে যাচ্ছে না। একে সরকারি সংগ্রহ ব্যবস্থার ব্যর্থতা বলে দিলেই মামলা মিটে যাচ্ছে না। সরকারের পক্ষে সম্ভবই নয় মাঠে মাঠে ঘুরে সরকার-নির্দিষ্ট সংগ্রহমূল্য দিয়ে অসংখ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কৃষকের থেকে কিনে বেড়ানো। অন্য দিকে, অধিকাংশ কৃষকেরও পোষাবে না দু’বস্তা ধান নিয়ে দূরবর্তী ধান সংগ্রহ কেন্দ্রে সশরীরে উপস্থিত হয়ে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে বিক্রি করা। তাই ফড়ে নামক পেশাটির সৃষ্টি ও স্থিতি। জোর করে এই মধ্যবর্তী সেবা প্রদানকারী পেশাটিকে বন্ধ করে দেওয়া যায় না। অতএব সরকারের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বাড়লেও তার লাভ পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা সামান্যই পাবেন।

একটি গতিশীল কৃষিব্যবস্থায় পারিবারিক শ্রম যে ভাবে কমে আসার কথা, পশ্চিমবঙ্গে তা হয়নি। তাই একর প্রতি উৎপাদন বেশি হলেও শ্রমের পরিমাণের তুলনায় উৎপাদন বেশি নয়। তাই উৎপাদক-পিছু আয়ও কম। বোঝা যাচ্ছে বিকল্প আয়ের সুযোগ এ রাজ্যে কম। না হলে বিকল্পের দিকেই যেতেন কৃষিজীবী পরিবারের অনেকে— ধান উৎপাদন কমে আসত; আর বাজারমূল্য বেশি, এমন কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ত, যা কেরলে হতে দেখা গিয়েছে। তাতে ধান উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান হয়তো নেমে যেত, কিন্তু কৃষকের আয় বাড়ত। এখানে খাদ্যসুরক্ষার যুক্তি আনবেন কেউ কেউ। ধান উৎপাদন কমে গেলে ভাতে টান পড়বে যে! কিন্তু কৃষককে দারিদ্রে রেখে রাজ্যবাসীর খাদ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করা, এ-ই বা কেমন কথা! অতএব কৃষিতে আয় বাড়তে হবে, সে বিষয়ে দ্বিমত থাকতে পারে না। কিন্তু কী ভাবে?

পশ্চিমবঙ্গের কৃষি অর্থনীতির এই যে বিশেষ কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য, তা অন্য রকম নীতিভাবনা দাবি করে। জাতীয় স্তরের নীতি থেকে তাকে আলাদা হতেই হবে। কৃষিকে লাভজনক করে তুলতে শুধু কৃষির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নজর দিলে হবে না। গতানুগতিক কৃষিনীতির ঝোঁকটা থাকে এই অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলির উপর— উচ্চফলনশীল বীজ থেকে শুরু করে সরকারি উদ্যোগে সেচ, ভর্তুকিতে সার, ঋণ, কৃষিপণ্যের বাজার সংস্কার ইত্যাদি। কিন্তু কৃষিক্ষেত্রের বাইরের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ছাড়া এরা কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। কৃষিতে উৎপাদক-পিছু উৎপাদন বাড়তে হলে কৃষিকাজে যুক্ত মানুষের সংখ্যা কমাতেই হবে, আর তা সম্ভব হবে যদি অ-কৃষিক্ষেত্রে শ্রমের চাহিদা জোগানের তুলনায় বাড়ে, আর তার ফলে মজুরি বাড়ে। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলের অ-কৃষিক্ষেত্রেও রোজগার তেমন ভাল নয়। দেখা যাচ্ছে, গ্রামাঞ্চলের অ-কৃষি পরিবারগুলির মধ্যে প্রায় অর্ধেকের প্রধান জীবিকা কৃষি বা অ-কৃষিক্ষেত্রে অস্থায়ী শ্রম। এ রাজ্যের অস্থায়ী শ্রমিকদের মজুরি অনেক রাজ্যের থেকেই নীচে।

বছর দুয়েক আগে ভুটানের প্রবেশদ্বার ফুন্টসোলিং-এ দেখেছিলাম প্রবেশ-ছাড়পত্রের অফিসে ভুটানে কর্মপ্রত্যাশী উত্তরবঙ্গের মানুষের ঢল। খোঁজ নিয়ে জানলাম যে, ভুটানে এই অদক্ষ শ্রমিকরা পান দৈনিক তিনশো টাকার আশপাশে। অতএব ধরে নেওয়া যায় যে, এই মজুরিতে কাজের সুযোগ সীমান্তের এ পারে নেই। এবং এই মজুরিতে কাজ করতে ভুটানিরা আগ্রহী নন। কেরলেও বাঙালি বিশেষ দক্ষতাহীন শ্রমিকরা যে মজুরিতে দলে দলে কাজ করতে ছুটছেন, বুঝতে হবে ওই রাজ্যবাসী ওই মজুরিতে ওই কাজে আগ্রহী নন। অর্থনীতিতে একে বলে ‘রিজ়ার্ভেশন ওয়েজ’— যে ন্যূনতম মজুরির নীচে মজুরি হলে শ্রমিক সে কাজ নেবেন না। কেরলে বা ভুটানে রিজ়ার্ভেশন ওয়েজ বেশি যে কারণগুচ্ছের জন্য, পশ্চিমবঙ্গে ঠিক সে সব কারণেই তা কম। বিদ্যালয় শিক্ষার সর্বজনীনতা বা তার অভাব একটি প্রধান কারণ, আর অন্য দিকে দারিদ্রের কারণে অপেক্ষায় অক্ষম। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার পরিসংখ্যানেই আবার দেখছি পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সিদের মধ্যে ন্যূনতম মাধ্যমিক উত্তীর্ণ এমন মানুষ মাত্র ২৫ শতাংশ, আর গোটা দেশে তা ৩২ শতাংশ!

ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement