উল্লাস: ডার্বি জয়ের পর এটিকে মোহনবাগান দলের খেলোয়াড়রা। যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন, ২৯ অক্টোবর। ছবি: সুমন বল্লভ।
গত কয়েক বছর ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলায় ইস্টবেঙ্গল ক্রমাগতই হেরে চলেছে এবং প্রায় প্রতিটা ডার্বিই একপেশে চেহারা নিচ্ছে। বলা বাহুল্য যে, মোহনবাগান এখন এটিকে মোহনবাগান এবং, “আমরা তো ক্লাবের নাম বেচিনি”, এটাই হতভাগ্য ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের একমাত্র সান্ত্বনা। যদি ইস্টবেঙ্গল ডার্বি জিতত তা হলে তাঁদের কেউই ‘এটিকে’ হেরেছে বলে নিস্পৃহ থাকতেন না বরং মোহনবাগানকে হারানো গেছে বলে উল্লাস করতেন। তাই ডার্বি জিতে মোহনবাগানিরা আনন্দ করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের এই পরাজয়ের অন্যতম একটি কারণ যে এটিকে-মোহনবাগানের চেয়ে তাঁদের দলের বাজেট কম, সেটাও মানতে হবে। অতএব, তলিয়ে দেখলে, পরাজয় এক চির-প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে অন্যের নয়, পরাজয় বৃহৎ পুঁজির কাছে অল্প পুঁজির। খণ্ডিত বাংলায় মোহনবাগানের সাপোর্ট-বেস ইস্টবেঙ্গলের চাইতে বেশি। তাই পুঁজির নিরিখে দল তৈরি হলে আগামী দিনগুলোয় সব সময়ই মোহনবাগান এগিয়ে থাকবে ইস্টবেঙ্গলের চেয়ে।
হয়তো অতীতে একটু আলো ফেলা দরকার। রাখাল ভট্টাচার্যের কলকাতার ফুটবল বইতে পাই, “ক্লাবের পৃষ্ঠপোষক দুর্গাদাস লাহা এবং কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান হ্যারি লী-র প্রভাবে শ্যামপুকুর-এর মাঠের দখল পেয়ে গেল মোহনবাগান”। ওই একই বইতে কিছু দিন পরে ইস্টবেঙ্গলের মাঠ পাওয়ার প্রসঙ্গে পড়ি, “প্রথম বিভাগে উঠেই ইস্টবেঙ্গল যখন তার কাছে ময়দানে একটা ভালো মাঠ চাইলে, টেগার্ট সাহেব মোহনবাগানকে বাধ্য করলে ইস্টবেঙ্গলকে অংশীদার করে নেবার জন্য।… দুই সিংহকে একই খাঁচায় থাকবার ব্যবস্থা করে টেগার্ট সাহেবই, বর্তমানে দুই ক্লাবের সমর্থকদের মধ্যে যে তীব্র বিদ্বেষ, তার জন্য ক্ষেত্র তৈরি করে তাতে বীজ পর্যন্ত বপন করে দিয়ে গিয়েছে।” তার মানে, খেলার মাঠের জন্য মোহনবাগানকে যেমন হ্যারি লি সাহেবের সাহায্য নিতে হয়েছে, ইস্টবেঙ্গলকেও হতে হয়েছে টেগার্টের শরণাপন্ন। স্বাধীনতা সংগ্রামী গোপীনাথ সাহাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়ার পর যে টেগার্টের প্রতি চরম ঘৃণা ছড়িয়ে পড়েছিল, তাঁর কাছে খেলার মাঠ চাইতে যাওয়ার সময় নিশ্চয়ই বুক ফেটে গিয়েছিল অনেকের। কিন্তু যে যখন ক্ষমতায় থাকে ন্যায্য দাবি নিয়ে তার কাছে যাওয়ার বিকল্প কী?
প্রশ্ন অন্যত্র। মহমেডান স্পোর্টিং বা ইস্টবেঙ্গল যে ভাবে একটি জনগোষ্ঠী বা অঞ্চলের ক্লাব হিসেবে পরিচয় লাভ করেছে, মোহনবাগানের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তো তা নয়। বিংশ শতাব্দীর শুরু, অর্থাৎ সেই ট্রেডস কাপ বা কোচবিহার কাপ জেতার সময় থেকেই মোহনবাগান জাতীয় ক্লাব। রাখাল ভট্টাচার্যের বইতেই পাই, মহমেডানের সমর্থকরাও বলছেন… “মোহনবাগানসে… পুরানি পেয়ার” কিংবা ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের নতুন ক্লাবের প্রতি প্রেম, মোহনবাগানকে ভালবাসার ভিতেই গড়ে উঠেছিল। মোহনবাগান ব্রিটিশদের হারিয়ে শিল্ড জেতার পর এক বৃদ্ধ ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে আঙুল উঁচিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে ভারতের পতাকা কবে উঠবে? ঠিক এমন ঘটনা ভারতের আর কোনও ফুটবল ক্লাবের ভাগ্যে ঘটেনি। আজও মোহনবাগানের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায়ের কথা উল্লেখ করতে হলে অধিকাংশই বলবেন, ১৯১১ সালের সেই সূর্যোদয়। তখনই তো এক নিমেষে, বর্তমানের ‘মোহনবাগান রো’র, ‘মোহনবাগান ভিলা’য়, ভূপেন্দ্রনাথ বসুর সভাপতিত্বে তৈরি ক্লাব হয়ে উঠেছিল সারা দেশের মুক্তিদূত! সেই মুক্তিযুদ্ধের এগারো জন খেলোয়াড়ের মধ্যে শিবদাস ভাদুড়ি, বিজয়দাস ভাদুড়ি, অভিলাষ ঘোষ, কানু রায়, রাজেন সেনগুপ্ত, সুধীর চট্টোপাধ্যায়ের মতো পূর্ববঙ্গীয় খেলোয়াড়দের উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল। শিল্ড ফাইনালে যে দু’জনের গোলে মোহনবাগান ইস্ট-ইয়র্ককে হারায়, সেই শিবদাস ভাদুড়ি এবং অভিলাষ ঘোষ দু’জনই তো বাঙাল। ইস্টবেঙ্গলিদের বাদ দিয়ে মোহনবাগানের কোন উৎসব হতে পারে তবে? পরবর্তী কালেও গোষ্ঠ পাল কিংবা চুনী গোস্বামীর মতো মোহনবাগান মুকুটদের আঁতুড়ঘর সেই পদ্মাপার। ঢাকার অদূরে ভাগ্যকূলের গোষ্ঠকে আবিষ্কার করেছিলেন রাজেন সেন। গোষ্ঠ পাল ছাড়া মোহনবাগানকে কল্পনা করা যায়? তার পরও কোনও-কোনও শীর্ষকর্তা “বাঙালরা সবাই বিদেশি, ওদের হারাব”র মতো অর্বাচীন উক্তি করতেন কী করে, দেবা ন জানন্তি!
বার্নার্ড মালামাডের একটা লেখায় পড়েছিলাম, হিটলারের জার্মানিতে ইহুদিদের চর্বি গলিয়ে সাবান বানানোর হুমকি দেওয়া হত বলে ‘সাবান’ শব্দটা খুব ‘সেনসিটিভ’ কোনও কোনও ইহুদির কাছে। ‘কাঁটাতার’, ‘ডোল’, ‘ক্যাম্প’, ‘কলোনি’ ইত্যাদি শব্দ কিংবা “পালানোয় নেই পাপ/ পালিয়েছিল তোর বাপ”-এর মতো কুৎসিত ইয়ার্কি, এক বিপুল জনসমুদ্রের কাছে কতটা ‘বেদনাদায়ক তা সংস্কৃতির রাজধানী কলকাতা বোঝে না?
প্যারাডক্স বলে মনে হলেও আসলে ব্যাপারটা বোধ হয় একটু অন্য রকম। উত্তর কলকাতার একটি গলিতে জন্ম নেওয়া মোহনবাগানের পূর্ববঙ্গীয় সমান্তরাল যদি কেউ থেকে থাকে তা হল ঢাকার উয়াড়ি ক্লাব! উয়াড়িতে খেলে আসা গোলকিপার নগেন কালী, ফরওয়ার্ড মোনা দত্ত কিংবা সেন্টার-হাফ বাঘা সোম মোহনবাগানের কৃষ্ণচূড়াতেও অনেক ফুল ফুটিয়েছেন। কিন্তু উয়াড়ি স্থানীয় ক্লাবই থেকে গেছে, জাতীয় ক্লাব হয়নি। আর দেশভাগের পর মোহনবাগান আচমকা কোনও এক চিচিং-বন্ধ’এর দৌলতে ‘গণমানুষের স্বপ্নপূরণের হাতিয়ার’ থেকে কলকাতা চব্বিশ পরগনা হাওড়া হুগলির রুদ্ধদল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু যে পূর্ববঙ্গীয় উদ্বাস্তুদের ছোটবেলার ‘এলডোরাডো’ ছিল মোহনবাগান? যাদের প্রায় প্রতিটি পাড়া থেকে কেউ না কেউ জেলে গিয়েছিল ব্রিটিশ তাড়াতে গিয়ে? স্বাধীনতা যাদের কাছে স্বস্তি নয় সর্বনাশ হয়ে আবির্ভূত হয়েছিল? প্রাণ আর মান বাঁচানোর তাগিদে এমনকি শিয়ালদহ স্টেশনে আশ্রয় নিয়েছিল যারা? তারা বুঝতে পারছিল, পরিস্থিতি কতটা পালটে গেছে, তারা শুনতে পাচ্ছিল, দেশভাগের আগে পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের দেওয়া সমস্ত প্রতিশ্রুতি বিস্মৃত হয়ে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের পুনর্বাসন মন্ত্রী মোহনলাল সাক্সেনা কলকাতায় এসে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করছেন, “উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন দেওয়া হবে না। সাময়িক ভাবে তারা ত্রাণশিবিরে আশ্রয় পাবে।” তাদের অনেকে বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিল, যার মধ্যে কুপার্স ক্যাম্পও একটি। সেই কুপার্স ক্যাম্পে, “৭০ হাজার মানুষের জন্য আশিটির মতো অস্থায়ী পায়খানা ছিল। ...ব্যবহারযোগ্য টিউবওয়েল ছিল মাত্র বিশটি। ...রাত কাটত যুদ্ধের সময় মার্কিন সৈন্যবাহিনীর প্রয়োজনে তৈরি গুদামের মতো ‘নিসেন হাটে’ যাতে কোনো জানলা ছিল না। ...রাত্রিতে দরজা খোলা রাখা যেত না। ...কারণ কিছু শিশুকে হায়েনারা তুলে নিয়েও গিয়েছিল।” (প্রফুল্লকুমার চক্রবর্তী)। তার পরও কুপার্স ক্যাম্পের রিফিউজিদের সঙ্গে শান্তিপুরের ভূমিপুত্রদের ফুটবল ম্যাচ অমীমাংসিত ভাবে শেষ হয়েছিল। কিন্তু যেখানে খেলার ফলাফল নির্ভর করে কে কত কোটি খরচ করে কোন বিদেশি নিয়ে আসতে পারছে তার উপরে, সেখানে সত্তর বছর ধরে মাঠে আর বর্তমানে মিমে অসংখ্য ভিটেমাটি হারানো মানুষকে নিয়ে তামাশা করাটা যদি অম্লমধুর রসিকতা হয়, তবে সেই রসিকতা বন্ধের জন্য ফিফার ব্যবস্থা করা উচিত। কারণ, এ রকম রসিকতা কোনও প্যালেস্তিনীয়কে নিয়ে আরব দুনিয়ার কেউ করে না, শ্রীলঙ্কার তামিলকে নিয়ে মাদুরাইয়ের তামিল করে না, ইহুদিকে নিয়ে ইহুদিরা তো করেই না।
অধ্যাপক থেকে রিকশাচালককে ‘বাঙাল’ বলে ডাকার যে অপসংস্কৃতি দেশভাগের পর জাঁকিয়ে বসল, তা একটি প্রাথমিক সত্য ভুলিয়ে দিতে পারল যে, বাস্তুহারার সঙ্গে বাস্তু যার আছে তার লড়াই হতে পারে না। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান লড়াই যদি হয়ে থাকে, তবে তা দেশভাগের পর পরই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু হয়নি বলেই, শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, “খিদে পেলেই ঘুমিয়ে পড়ি সবাই ডাকে বাঙাল”।
এই প্রতিবেদক এমন একটি পাড়ায় শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছে যেখানে চারশো আট ঘর বাঙালের মধ্যে তার মা ছিল একমাত্র ঘটি। সে ওই কারণেই স্বাদেগন্ধে অতুলনীয় সব রান্না খেতে পেয়েছে ছোট থেকে, “অর মায়ে এইসব রানতে পারে না”র সস্নেহ প্রশ্রয়ের সঙ্গে; কেউ তো তাকে কখনও তার পরিচয়ের কারণে টিটকিরি দেয়নি, মোহনবাগান হারলেও নয়।
আজ যখন মোহনবাগান পর পর জিতছে তখন সেই জয় কেবল একটি দলের নয়, ইতিহাসের, ঐতিহ্যের জয়। ভাঙা বুকের পাঁজর দিয়ে নতুন জীবন গড়ে তোলা স্বজনদের অবমাননায় সেই জয়ের চাঁদে কলঙ্ক এসে লাগে, আমরা যেন ভুলে না যাই।