মনমোহন সিংহ শেয়ার বাজারের দরজা খোলেন মধ্যবিত্তের জন্য
Share Market

আরও একটি সংস্কার

রমরমা ছিল জাল শেয়ারপত্র লেনদেনেরও। শেয়াল পণ্ডিতের কায়দায় একই শেয়ারের কাগজ দেখিয়ে কিছু দুষ্ট ব্রোকার বিনিয়োগকারীদের বিক্রি করতেন ভুয়ো কাগজ।

Advertisement

সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০২৫ ০৫:৩৭
Share:

মনমোহন সিংহের প্রয়াণের পর তাঁকে নিয়ে অনেক কথা হল— আর্থিক উদারীকরণ থেকে একশো দিনের কাজের প্রকল্প, তথ্যের অধিকার আইন। যা নিয়ে কখনও খুব বেশি কথা হয় না, তা নিয়ে এই সময়ও তেমন আলোচনা হল না— তাঁর নেতৃত্বে ভারতে ১৯৯০-এর দশকে ঘটে যাওয়া আর্থিক ও মূলধনি বাজারের প্রকার, পন্থা, প্রথা, পদ্ধতি ও প্রতিষ্ঠানের আমূল সংস্কারের কথা। ভাল-মন্দ মিশিয়ে যার প্রভাব আজও রয়ে গিয়েছে প্রবল ভাবে। আজকের শেয়ার বাজার-মুখী মধ্যবিত্তের জন্য সে বাজারকে উপযুক্ত করে তোলার পিছনে এই সংস্কার প্রক্রিয়ার গুরুত্ব অতুলনীয়।

Advertisement

এই সংস্কার প্রক্রিয়ার সূচনা নব্বইয়ের দশকের গোড়ায়, তৎকালীন বোম্বাই শহরের দালাল স্ট্রিট থেকে। শেয়ার বাজারে ব্রোকার বা দালালদের তঞ্চকতা ও প্রতারণায় ১১৫ বছর পার করা বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের সাধারণ লগ্নিকারীর প্রাণ তখন ওষ্ঠাগত। সেই সময় ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যস্থতাকারী এক্সচেঞ্জের ব্রোকাররা বিনিয়োগকারীদের টাকায় কোম্পানির শেয়ার দিনের ন্যূনতম দরে বাজার থেকে কিনে তাঁদেরই সেই কাগজ বিক্রি করতেন দিনের সর্বোচ্চ ঘোষিত দরে। বেচার সময় হত ঠিক এর উল্টো। তার কারণ, শেয়ারপত্রের দাম তখন নির্ধারিত হত সেই ব্রোকারদের গোপন ঘেরাটোপের মধ্যে। তার পরেও কাটা হত কমিশনের টাকা। পাশাপাশি রমরমা ছিল জাল শেয়ারপত্র লেনদেনেরও। শেয়াল পণ্ডিতের কায়দায় একই শেয়ারের কাগজ দেখিয়ে কিছু দুষ্ট ব্রোকার বিনিয়োগকারীদের বিক্রি করতেন ভুয়ো কাগজ।

এ সবই ছিল সেই সময়ের মাঝারি মাপের ব্রোকারদের রোজনামচা। তাঁদের উপরের সারিতে বিরাজ করতেন উচ্চ শ্রেণির ‘বৃষ’বৃন্দ (‘বৃষ’ শুনে আপত্তি করবেন না, ইংরেজিতে তাঁরা ‘বিগ বুল’ নামে খ্যাত, বলিউডের সিনেমা-ওয়েব সিরিজ়েও বিলক্ষণ এই নাম শুনেছেন)— যাঁদের শাহেনশা ছিলেন হর্ষদ মেহতা। ১৯৯২ সালে তিনি— সামান্য টাকা নয়— আস্ত দুটো ব্যাঙ্ক জালিয়াতি করে, সেখান থেকে ভুয়ো কাগজের সরকারি বন্ড অন্য ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রেখে, ঋণের এক হাজার কোটি টাকা নিয়োগ করলেন শেয়ার বাজারে। সোনার হরিণরূপী ঊর্ধ্বগামী শেয়ার বাজারের মায়ায় প্রবঞ্চিত অগণিত মানুষ, সূচকের অধঃপতনে সামগ্রিক ভাবে হারালেন সে দিনের মূল্যে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা।

Advertisement

শেয়ার বাজারের লগ্নির ঝুঁকি নিশ্চয়ই আছে, তবে তার উৎস ভবিষ্যতের অনিশ্চিত অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি থেকে, যা আগে থেকে সঠিক অনুমান করা অতি কঠিন। এই ক্ষেত্রে বাড়তি ঝুঁকির কারণ সেই অনিশ্চয়তা ছিল না, তা তৈরি হয়েছিল নকল শেয়ারের আদানপ্রদানের মাধ্যমে, যেটা সমূলে বিনাশ করা একটা শেয়ার বাজার কর্তৃপক্ষের ন্যূনতম দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। একাধিক তথ্যসমৃদ্ধ গবেষণা বলছে যে, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বাজারে অংশগ্রহণে অনীহার মূল কারণই হল এই সব প্রতিষ্ঠানের সততা ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির অভাব। মিলান বা ভ্যানকুভার শেয়ার বাজারের এক সময়ে অবনমনের জন্য দায়ী তাদের উপরে লগ্নিকারীদের নির্জলা অবিশ্বাস। তৎকালীন বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জে জালিয়াতির এই কারবারের অভ্যাস ছিল শতাব্দীপ্রাচীন— তার জন্মলগ্ন থেকেই এই অনিয়মের সূচনা। এই বেলাগাম উঞ্ছবৃত্তির মূল কারণ ছিল পদে পদে ভিন্ন অংশীদারের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত। কারণ মধ্যস্থতাকারী ব্রোকাররাই এক্সচেঞ্জের মালিক। তাঁদের হাতেই পরিচালনা, কর্তৃত্ব ও সিদ্ধান্ত। যত বেশি প্রবঞ্চনা ও বিনিয়োগকারীদের ভোগান্তি, আলালের ঘরের দালালদের লাভের গুড় ততই বেশি। সামান্যতম সংস্কার প্রচেষ্টাতেও তাঁরা তাই যূথবদ্ধ ভাবে রণং দেহি হয়ে উঠতেন।

এক্সচেঞ্জের কাছে সমস্ত সরকারি অনুরোধ বিফলে যাওয়ার পর, মনমোহন সিংহের অর্থ মন্ত্রক অভ্যন্তরীণ আলোচনা, কমিশন গঠন ও তার রিপোর্টের ভিত্তিতে নজিরবিহীন ভাবে ঘোষণা করল যে, লগ্নিকারীদের আস্থা অর্জনের একমাত্র রাস্তা হল অতি দ্রুত নতুন এক্সচেঞ্জ গড়ে তোলা। সূত্রপাত হল ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ বা এনএসই-র। প্রতিষ্ঠালগ্নে তার মূলমন্ত্র ছিল একটাই: প্রতিষ্ঠানিক আস্থা ও বিশ্বস্ততা স্থাপন করা কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দায় নয়— তা অর্জন করতে হবে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে, যার ভরকেন্দ্র থাকবে শক্ত দুই স্তম্ভের উপর। প্রথমটা হল আমূল প্রতিষ্ঠানিক সংস্কার, যেখানে নতুন এক্সচেঞ্জের মালিকানা, পরিচালনা, কর্তৃত্ব ও ব্যবসায়িক লেনদেনের ভার ন্যস্ত থাকবে আলাদা আলাদা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক অংশীদারের উপরে, যাঁরা কাজ করবেন একে অপরের পরিপূরক হিসাবে। দ্বিতীয়ত, সমস্ত লেনদেন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হবে উন্নততর প্রযুক্তি, যেটা থাকবে লগ্নিকারীদের আয়ত্তের মধ্যেই।

প্রথমেই ঠিক হল নতুন প্রতিষ্ঠানের মালিকানার থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত রাখা হবে তার দৈনন্দিন পরিচালনাকে। মালিকানা থাকবে সরকার পরিচালিত বিভিন্ন আর্থিক সংস্থার হাতে; পরিচালনার ভার বর্তাবে এক্সচেঞ্জ বহির্ভূত চাকুরে বিশেষজ্ঞ গোষ্ঠীর উপরে। ব্রোকার সম্প্রদায় শুধুই শেয়ার লেনদেন করবেন ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে। একই সঙ্গে, বিনিয়োগকারীদের কাগজের অ্যাকাউন্ট পাল্টে হয়ে গেল ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট— ডিম্যাট। এক কোপে ব্রোকার গোষ্ঠী হারাল তাদের জালিয়াতি করার মূল অস্ত্র। আগে বেচা-কেনায় মালিকানা হস্তান্তর হত কাগজের শেয়ারের মাধ্যমে, যার নকল প্রতিলিপি তৈরি করা ছিল বাঁ-হাতের খেলা। অন্য দিকে, কম্পিউটারে জালিয়াতি করার জ্ঞান তখনও পর্যন্ত অধরা, এবং তুলনায় কঠিনতর। উপরন্তু, ভুক্তভোগীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে চালু করা হল নকল শেয়ারের বিমা— পয়সা দিয়ে কিনে ভুয়ো শেয়ার হাতে এলে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিপূরণ পাবেন এক্সচেঞ্জের দায়িত্বে। ফলে, বিনিয়োগকারীরা ভরসা পেলেন।

আরও এক ধাপ এগিয়ে সমস্ত লেনদেনকে আনা হল এনএসই-র কম্পিউটার পর্দায়, যেখানে এক জন লগ্নিকারী সামান্য মূল্যের বিনিময়ে দেখতে পাবেন, হাজার হাজার বিনিয়োগকারী কোন শেয়ারের জন্য কত দাম দিতে ইচ্ছুক। সারা দেশে ৩০০টা শহর ও শহরতলিতে পৌঁছে দেওয়া হল কম্পিউটার টার্মিনাল— যেখানে এক্সচেঞ্জ বহির্ভূত এক জন লগ্নিকারী তথ্যের পূর্ণ অধিকারসমেত কেনা-বেচার সুযোগ পেতে পারেন। কয়েক দিন আগেও এটা অভাবনীয় ছিল। অল্প সময়ে দ্রুত বেগে প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা ও লেনদেন প্রযুক্তির খোলনলচে বদল হওয়ার ফলে এক ধাক্কায় বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের একচেটিয়া, গোপন বাজার ভেঙে দিয়ে এনএসই-তে চালু হল নিলাম, উন্মুক্ত ও প্রতিযোগিতার বাজার, যেখানে একচেটিয়া ব্রোকারদের কোনও প্রভাব নেই। লগ্নিকারীর ঝুঁকি তখনও আছে, তবে তা নকল শেয়ার কেনার ভয় থেকে নয়।

অচিরেই এনএসই-র দখলে চলে এল সর্বভারতীয় শেয়ার বাজারের প্রায় ৭০%। তার উপরে, অন্য শেয়ার বাজারের তুলনায় তার নিজস্ব বাজার অনেক বেশি গভীর ও ব্যাপ্ত। তখনও অনড় ও অনমনীয় বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ তার জৌলুস হারাল এক বছরের মধ্যেই, যখন নতুন ও পুরনো লগ্নিকারীরা পুরনো এক্সচেঞ্জের মায়া ছেড়ে যোগ দিলেন এনএসই-তে। এক বছর আগেও বিএসই-র ব্রোকারের আসন বিক্রি হত সেই সময়ের দরে ৪০ লক্ষ টাকায়। অচিরেই সেই দাম নেমে এল ১০ লাখের নীচে। পায়ের নীচে জমি সরতে দেখে কিছু সময়ের মধ্যেই বেঁচে থাকার তাগিদে বিএসই একই সংস্কারের পথ নিল। যদিও, অনেক দেরি হয়ে গেছে তখন। আজও বিএসই অনেক দূরত্বে পিছিয়ে থাকা দ্বিতীয়— এনএসই বিশ্বের প্রথম দশের একটা।

শুধু স্টক এক্সচেঞ্জ নয়, যে কোনও সম্পদ উৎপাদনকারী লাভজনক প্রতিষ্ঠানেই পরজীবী শ্রেণির উত্থান খুব অপ্রত্যাশিত বা আশ্চর্যের নয়। সংস্থার লাভের উপরে অনধিকার হস্তক্ষেপেই তাদের প্রাণ ও চালিকাশক্তি। এদের ক্রমাগত সমৃদ্ধি ও বৃদ্ধি স্বাভাবিক নিয়মেই এক সময়ের সচল প্রতিষ্ঠান নির্জীব হয়ে পড়ে। ক্ষেত্রবিশেষে পরজীবী শ্রেণির সৃষ্টি কখনও সংস্থার মালিকের তোষামোদপ্রিয়তা থেকে, আবার কোথাও তার বৃদ্ধি সংস্থার ট্রেড ইউনিয়নের অপরিণামদর্শিতায়। এদের সৃষ্ট দুর্নীতির পরিবেশ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়ে ওঠে সংশ্লিষ্ট সংস্থার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কৃতির আকর।

আলোচ্য ক্ষেত্রে যাঁরা মধ্যস্থতাকারী মহাজন, একই সঙ্গে তাঁরা ছিলেন ব্রোকার ও অংশীদার। এই পরগাছা সমূলে উৎপাটন করা দুঃসাধ্য, কারণ এর চক্র সুদূরপ্রসারী, পোক্ত এবং দুর্ভেদ্য। তাই প্রতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং উন্নততর প্রযুক্তির অস্ত্রের উপযুক্ত মিশ্রণে ব্রোকার দমনের এই পর্ব গোটা বিশ্বেই নজিরবিহীন, এবং মৌলিক চিন্তার পরিচায়ক। এর সময়কাল ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬, যখন মনমোহন সিংহ ছিলেন অর্থমন্ত্রী। অবশ্যই এ কাজ শুধু তাঁর একার নয়, যৌথ ভাবে অনেকেরই অবদান এই সাফল্যের পিছনে। কিন্তু নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন এই সংস্কারযজ্ঞের নেপথ্য চিন্তাশক্তি ও প্রয়োগের অন্যতম প্রধান কান্ডারি।

অর্থনীতি বিভাগ, নটিংহাম ইউনিভার্সিটি বিজ়নেস স্কুল

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement