গত ৩০ জুলাই ভোররাতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে ‘ভগবানের আপন দেশ’ কেরলের ওয়েনাড়ে যে শয়ে শয়ে মানুষ মারা গেলেন, সেই বিষয়ে সাধারণ মানুষের বিশেষ হেলদোল আছে কি? তাঁরা সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যত চর্চা করেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়ে তত চর্চা করেন কি? সুন্দরবনে বেআইনি ভাবে মুনাফা করতে চাওয়া কিছু মানুষের কারণে প্রকৃতির নির্মম অত্যাচার বেড়েই চলে। বারংবার শত সহস্র মা বোনের ভিটেমাটি, সংসার এবং ক্ষেত্রবিশেষে জীবনও ভেসে যায়। কিন্তু নাগরিক সমাজ প্রতিবাদে মোমবাতি হাতে পথে নামে কি?
গলদটা এখানেই। আমরা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও তার কারণে সাধারণ মানুষের মৃত্যুকে ‘এ সব তো হতেই পারে’ ধরে ভাবনার শেষ প্রান্তে পাঠিয়ে দিই। তাই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও প্রশাসনও ইচ্ছামতো পরিবেশের দফারফা করে এবং শেষ পর্যন্ত তার ফল ভুগতে হয় সাধারণ মানুষকেই। প্রশাসন, রাজনৈতিক দল এবং অন্যায় মুনাফাকারী ব্যবসায়ীদের যোগসাজশ স্পষ্ট ওয়েনাড়ের ক্ষেত্রে। এ বছরের জুলাইয়ের ৩০ তারিখ আকাশভাঙা বৃষ্টি ও তার সঙ্গে নামা ধসের কারণে ওয়েনাড় জেলার পুঞ্জিরীমাত্তম, মুন্ডাক্কাই, চূড়ালমালা, আত্মামালা ইত্যাদি গ্রাম সম্পূর্ণ ভেসে গিয়ে এখনও অবধি যে চার শতাধিক মৃত্যু ও আরও অনেকের ভেসে যাওয়ার (যাঁদের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি) খবর পাওয়া যাচ্ছে, তার কারণ লুকিয়ে আছে ১৩ বছর আগে যখন কেন্দ্রীয় সরকার নিজেরই তৈরি করা মাধব গ্যাডগিল কমিটির রিপোর্টকে ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। মাধব গ্যাডগিল ২০১১ সালের ৩১ অগস্ট জমা দেওয়া রিপোর্টে স্পষ্ট জানিয়েছিলেন যে, গোটা পশ্চিমঘাট পর্বতমালাই ‘পরিবেশগত ভাবে সংবেদনশীল’ এবং তার মধ্যে একটা বড় অংশে খনি থেকে শুরু করে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো যাবতীয় উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ করা প্রয়োজন, বন্ধ করা প্রয়োজন ওই অঞ্চলের কোনও নতুন বাঁধ বা জলাধার নির্মাণ। দেখা গেল রিপোর্ট মনমতো না হওয়ার কারণে তাকে আলমারিতে আটকে ‘পশ্চিমঘাট বাঁচাতে’ নতুন কস্তুরিরঙ্গন কমিটি গড়ল কেন্দ্রীয় সরকার। সেই কমিটির রিপোর্ট পছন্দমতো না হওয়াতে আসরে নামল তৎকালীন কেরল সরকার। তারাও রাজ্যস্তরে একটি কমিটি বানাল, যদিও সেটিকেও পরিবেশের নানান নিয়ম ভাঙার কথা মেনে নিতে হল।
মজার কথা, কেন্দ্র ও রাজ্য মিলে তিন-তিনটে রিপোর্ট তৈরি হলেও তাদের সুপারিশমতো পরিবেশের বিধিনিষেধগুলির বিশেষ প্রয়োগ করা হয়নি, বরং দেদার উন্নয়ন চলেছে। যার প্রত্যক্ষ ফল ৩০ জুলাইয়ের মৃত্যুমিছিল। মনে রাখতে হবে, এর আগে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কেরলে মারা গিয়েছিলেন প্রায় ৬০০ জন। বার বার মানুষের ইন্ধন দেওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অজস্র মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপন্নতা, যা নাকি বৃষ্টিপাতের তীব্রতাকে প্রায় ১০ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে। কেউ যদি কেন্দ্র এবং কেরলের রাজ্য সরকারকে অনিচ্ছাকৃত গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করেন; তা বোধ হয় অন্যায্য হবে না।
একই প্রবণতা পশ্চিমবঙ্গে। বঙ্গোপসাগর লাগোয়া সুন্দরবনে বিজ্ঞানীদের হিসাবেই প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ দুয়ারে বিপর্যয় নিয়ে অপেক্ষা করছেন। আমপান, ইয়াস হয়ে এই বছরের রেমাল— বিপর্যয়ের সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়ছে। কিন্তু প্রশাসন সেই বিপন্নতা কমানোর বদলে আরও বাড়ার ব্যবস্থা করছে ম্যানগ্রোভ কেটে একের পর এক নির্মাণ, বাঁধ ফুঁড়ে নোনা জল ঢুকিয়ে মাছচাষ, অথবা মৌসুনি, গোসাবার মতো অঞ্চলে চর দখল করে বেআইনি পর্যটনকে প্রশ্রয় দিয়ে। একই ছবি বায়ুদূষণ থেকে পূর্ব কলকাতা জলাভূমি অবধি। দশকের পর দশক জলা ভরাট চললেও একটা গার্ডেনরিচ ঘটার পর প্রশাসনের মনে পড়ে যে, অনেক বেশি জলা গেছে বহুতলে ভরে! পূর্ব কলকাতা জলাভূমি, যাকে কলকাতার কিডনি বলে চিহ্নিত করা হয়, হাই কোর্টের রায় ও রামসার অঞ্চল হওয়ার কারণে সেখানে আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও গড়ে উঠেছে একের পর এক বেআইনি নির্মাণ, তৈরি হয়েছে বহু বেআইনি বহুতল এবং বাণিজ্যিক উদ্যোগ। ফলত কমে যাচ্ছে বর্জ্য জল পরিশোধনের প্রাকৃতিক ক্ষমতা। কলকাতা আইসিইউ-তে ঢুকলে দায়িত্ব কার?
সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট-এর করা ২০২৪ সালের রিপোর্ট জানাচ্ছে যে, পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতের ২২টি রাজ্যে মারাত্মক রোগ সংক্রমণের পিছনে বায়ুদূষণই এক নম্বর খলনায়ক। কিন্তু এই পরিস্থিতি সামলাতে কোনও সামগ্রিক সরকারি উদ্যোগ এ রাজ্যে আছে বলে আধিকারিকরাও দাবি করবেন না। আদালতের চাপে খাতায় কলমে কিছু রিপোর্ট তৈরি হচ্ছে, কিছু বিধিনিষেধও। কিন্তু যেখানে মুনাফাকারী রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক স্বার্থ আর বেআইনি বাণিজ্যিক লাভ আমে-দুধে মিশে যায়, সেখানে সাধারণ মানুষের বিশেষ কিছু করার থাকে না।
মনে রাখা প্রয়োজন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এক দিন হঠাৎ ঘটে না। বহু কাল ধরে জমা হওয়া পরিবেশের বিরুদ্ধে অন্যায়ের প্রতিশোধ এক দিন ওয়েনাড়ের বন্যার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। কবে, কোথায়, কখন; সে উত্তর কেউ জানে না। গত কাল ওয়েনাড় ছিল; আগামী কাল পশ্চিমবঙ্গও হতে পারে।