পৃথক: গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সমর্থকদের অবস্থান বিক্ষোভ। ৩০ জানুয়ারি, ২০১৩, নয়াদিল্লি
পশ্চিমবঙ্গকে একাধিক রাজ্যে, অন্তত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে, বিভক্ত করার দাবি বেশ কিছু দিন ধরেই উঠছে। বাঙালি আবেগের ভোটের কথা বিবেচনা করে রাজ্যের কোনও প্রধান রাজনৈতিক দল এই দাবিগুলিকে এখনও প্রকাশ্যে সমর্থন জানায়নি। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের নেপালি অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে গোর্খাল্যান্ড রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠনের দাবি সেই স্বাধীনতার সময় থেকেই ছিল, যার অন্যতম প্রবক্তা ছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। এর সঙ্গে মাঝে মাঝে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অংশ নিয়ে কামতাপুরি, কোচ রাজ্য ইত্যাদি দাবিও উঠে আসে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কিছু প্রতিনিধির এ ধরনের দাবি দীর্ঘ দিনের, কাজেই স্থানীয় স্তরে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা এর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেন না। কিন্তু এ বার দাবি উঠেছে পুরো উত্তরবঙ্গকেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করার, এবং এই দাবির প্রচার করছেন সর্বভারতীয় বৃহত্তম হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলের কিছু নেতা-কর্মী, ও তার সহযোগী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এই ধারার কোনও কোনও নেতা দাবি তুলেছেন বীরভূম বাঁকুড়া নিয়ে রাঢ়বঙ্গের, কেউ জঙ্গলমহলের। এই নতুন দাবিগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলি কোনও বিশেষ জনগোষ্ঠীর দাবি নয়— দাবিগুলি এসেছে একটি বিশেষ চিন্তাধারা থেকে, যা মনে করে যে, ভাষা নয়, বরং উন্নয়ন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার জন্য ভারতকে প্রশাসনিক ছোট ছোট রাজ্যে ভাগ করা উচিত।
১৯২৭ সাল থেকেই কংগ্রেসের গৃহীত সিদ্ধান্ত ছিল ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের, ১৯৪৬-এর নির্বাচনী ইস্তাহারেও তা বহাল ছিল। স্বাধীনতার পর রাজ্য পুনর্গঠনের সময় কংগ্রেস নেতৃত্বের মনোভাব কিছুটা পাল্টায়। ১৯৪৮-এ প্রথম ভাষাভিত্তিক রাজ্যের কমিশন এবং ১৯৪৯-এ নেহরু, পটেল ও পট্টভি সীতারামাইয়াকে নিয়ে দ্বিতীয় কমিশনও জাতীয় স্বার্থে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের বিরোধিতা করে। নেহরু কখনও ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠন সমর্থন করেননি। এই সময়েই আম্বেডকর কিন্তু ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনকে সমর্থন করেন, তবে বলেন যে, অন্য ভাষাভাষীদের স্বার্থে প্রতিটি রাজ্যের সরকারি ভাষা কেন্দ্রীয় সরকারি ভাষাও হতে হবে। এর পর কিছু দিনের মধ্যেই তেলুগুভাষী অঞ্চল নিয়ে অন্ধ্রপ্রদেশ গঠনের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে, এবং এই দাবিতে গান্ধীবাদী পট্টি শ্রীরামালুর ৫৯ দিনের অনশনে মৃত্যুর পর ১ অক্টোবর ১৯৫৩-তে স্বাধীন ভারতে প্রথম ভাষাভিত্তিক রাজ্যের সৃষ্টি হয়।
এর ফলে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন তৈরি হয়, ও রাজ্য পুনর্গঠন আইন ১৯৫৬ পাশ হয়। এই কমিশনের মূল কথা ছিল ভাষা ও সংস্কৃতির সমরূপতা বজায় রেখে রাজ্য গঠন। এর পরেই অনেকগুলি ভাষাভিত্তিক রাজ্য তৈরি হয়। তার পরে যে সব নতুন রাজ্য গঠিত হয়, সেখানে ভাষা গুরুত্ব পায়নি। বিহার ও মধ্যপ্রদেশ রাজ্যগুলির মূল যোগাযোগের ভাষা হিন্দি। বিহার ভেঙে হয়েছে ঝাড়খণ্ড, এবং মধ্যপ্রদেশ ভেঙে হয়েছে ছত্তীসগঢ়। এই রাজ্যগুলির গঠনের প্রধান যুক্তি আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ ও উন্নয়ন। মনে রাখতে হবে, আদিবাসী উন্নয়নের নামে গঠিত এই দু’টি রাজ্যেই আদিবাসীরা আদৌ সংখ্যাগরিষ্ঠ নন— ছত্তীসগঢ়ে ২৬ শতাংশ এবং ঝাড়খণ্ডে ৩০ শতাংশ। অনেকেই মনে করেন, এই রাজ্যগুলি গঠিত হয়েছে স্থানীয় রাজনীতির টানাপড়েনে এবং ক্ষমতালিপ্সু নেতাদের স্বার্থে। উত্তর-পূর্ব ভারতে মণিপুর ও ত্রিপুরা বাদ দিলে বাকি রাজ্যগুলির কোনও উন্নত ভাষা এখনও গঠিত হয়ে ওঠেনি, সব কাজই চলে ইংরেজিতে। সেখানেও রাজ্যগুলি মূলত গঠিত হয়েছে বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর দাবি মেটাতে।
ইতিহাসের পরিহাস, ভাষাভিত্তিক রাজ্যের স্রষ্টা অন্ধ্রপ্রদেশ বিভক্ত হয়ে তেলঙ্গানা রাজ্য গঠিত হল। অন্ধ্রপ্রদেশ গঠিত হওয়ার একটি প্রধান তাৎক্ষণিক কারণ ছিল পট্টি শ্রীরামালুর মৃত্যু। তার এক সপ্তাহ পরই নেহরু অন্ধ্র রাজ্য গঠনের সবুজ সঙ্কেত দেন। ইতিহাসের দ্বিতীয় পরিহাস, সেই অন্ধ্রপ্রদেশ বিভক্ত করতে তেলঙ্গানা আন্দোলনের নেতা, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখরও আমৃত্যু অনশনে বসেন এবং ১১ দিন অনশন চলাকালীন কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার তেলঙ্গানা প্রদেশ গঠনে সম্মতি জানায়।
এই সব রাজ্য পুনর্গঠনে হিন্দুত্ববাদীদের মতামত কী ধরনের? ভারতীয় জনতা পার্টি সব সময়েই ভারতকে ছোট ছোট প্রশাসনিক রাজ্যে ভাগের সমর্থক। বিজেপি প্রথম থেকেই তেলঙ্গানা গঠনে সমর্থন জানিয়ে এসেছিল। আরএসএস মনে করে ভারত একটি একক রাষ্ট্র, যাকে সুশাসনের প্রয়োজনে বিভিন্ন সুবিধাজনক প্রশাসনিক অংশে বিভক্ত করা সঙ্গত। ভারতের সবাই ভারতীয়, সুতরাং এই সব প্রশাসনিক ভাগাভাগিতে কিছু যায় আসে না, এটাই বিজেপির যুক্তি। এই এক-ছাঁচের হিন্দুত্বের ধারণা ভুলে যায় যে, ভারত একটি সভ্যতা-ভিত্তিক রাষ্ট্র, যা গত অন্তত পাঁচ হাজার বছরের এই ভূমিতে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সভ্যতার ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, উপাসনা পদ্ধতির সমন্বয় সংমিশ্রণে একটি সনাতনী ভাবনার ভিত্তিতে গঠিত। এই বৈচিত্রকে আত্মস্থ করা না গেলে সনাতন ভারতকে বোঝা সম্ভব নয়।
ভাষাভিত্তিক রাজ্যের অবস্থান শক্তি হারিয়েছে, এবং ছোট রাজ্যের প্রবক্তারাই এখন ভারতীয় রাজনীতিতে বেশি শক্তিশালী। উন্নয়ন ও প্রশাসন এখন নতুন রাজ্য গঠনের ভিত্তি হতে চলেছে। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গ বিভাজনের প্রসঙ্গ আসতেই পারে। উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে, সে কথা শাসক তৃণমূল কংগ্রেস বা পূর্বতন শাসক সিপিএমও অস্বীকার করে না। তারাও বলে যে, উন্নয়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। একই রকমের উন্নয়ন সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে দক্ষিণবঙ্গের সুন্দরবন অঞ্চলে বা পশ্চিমে জঙ্গলমহল অঞ্চলেও। পূর্বেই বলা হয়েছে রাঢ়বঙ্গ ও জঙ্গলমহল রাজ্যের দাবির কথা। এও বলা হচ্ছে যে, উত্তরবঙ্গ চিন ও বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষা, ফলে নিরাপত্তার জন্য একে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হোক।
কিন্তু যে প্রশ্নটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা হল, পশ্চিমবঙ্গ কি আদৌ বিভাজন-যোগ্য? আপাতদৃষ্টিতে পশ্চিমবঙ্গ আর একটি ভাষাভিত্তিক রাজ্য, ফলে উন্নয়নের প্রশ্নে বিভাজন হতেই পারে। কিন্তু প্রায় লুকিয়ে রাখা যে সত্যটি এখন বারংবার বলার প্রয়োজন, তা হল, পশ্চিমবঙ্গ শুধুমাত্র কোনও ভাষাভিত্তিক, কোনও অর্থনৈতিক বা প্রশাসনিক অঞ্চল নয় যে, তাকে সুবিধামতো ভাগ করা যেতে পারে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সমগ্র বঙ্গের দাবির মুখ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ যখন গঠিত হয়, তার মধ্যে কি হিন্দু বাঙালির নিরাপদ বাসভূমি বা হোমল্যান্ড তৈরির বাসনা ছিল না? এই পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টির পক্ষে পশ্চিমবঙ্গ আইনসভায় জ্যোতি বসু-সহ কংগ্রেস কমিউনিস্ট তফসিলি সব সদস্যই মত দেন। পশ্চিমবঙ্গ মানে শুধু যুক্ত বঙ্গের পশ্চিমাঞ্চল ভূখণ্ড নয়, কেবল কোনও মানচিত্র নয়, বাংলা ভাষা নয়— ভারত-পাকিস্তান ভাগাভাগির সময় তা হয়ে ওঠে হিন্দু বাঙালির অস্তিত্বের ভাবনা, যা সম্পূর্ণ অবিভাজ্য।
যে কোনও দেশে, রাজ্যে স্থানিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক কারণে আঞ্চলিক উন্নয়ন বৈষম্য থাকে, তাকে যতটা সম্ভব বাস্তবগত ভাবে সমাধান করাই সরকারের কর্তব্য। সে জন্য দেশকে টুকরো টুকরো করাটা কোনও পথ হতে পারে না। মনে হচ্ছে এই দাবি তোলার কিছু বিশেষ কারণ থাকতে পারে। গত ২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে অনেকেই ভেবেছিলেন যে, এ বারে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসবে। অনেক বেনোজল দলে ঢুকেছিল। বেশ কয়েক জন মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গিয়েছিলেন, মনে হচ্ছিল নতুন সরকারে হয়তো একাধিক মুখ্যমন্ত্রী রাখতে হবে। যা হোক সে স্বপ্ন নির্বাচনের পর ভাঙল, অনেকে নিজের নীড়ে ফিরলেন। এ বার অন্য একটি স্বপ্ন দেখা শুরু হল। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গে বিজেপির সাফল্য ছিল প্রায় ৯০ শতাংশ। ২০২১-এর নির্বাচনে বিজেপির অত্যন্ত হতাশাজনক ফলাফলের পরও উত্তরবঙ্গের ফলাফল তেমন খারাপ নয়। সুতরাং কিছু নেতা যদি আগামী দিনে উত্তরবঙ্গ রাজ্যের মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তাতে দোষের কিছু নয়। তেলঙ্গানা, ঝাড়খণ্ড, ছত্তীসগঢ়েও এ সবের প্রভাব ছিল। আর তার সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সমর্থনও যদি যুক্ত হয়, এই দাবি তোলাটাও গ্রহণযোগ্য হয়ে যাবে। অতএব, জল আরও অনেক দূর গড়াবে বলেই মনে হয়।