—প্রতীকী চিত্র।
ভূলোকে মাঠ-ঘাট জ্বলছে, পুকুরের মাটি শুকিয়ে ফুটিফাটা, জলের তল নেমে যাচ্ছে, জলাভাবে মানুষ নাজেহাল। দ্যুলোকে মেঘের নামমাত্র চিহ্ন নেই, সকাল থেকেই ঝরে পড়ছে আগুন, আর যেটুকু বাতাস বইছে তা ছড়িয়ে দিচ্ছে তপ্ত হলকা। প্রায় এক মাস হতে চলল পশ্চিমবঙ্গের এই হাল। কত কাল আগে কালবৈশাখী হয়েছিল, মানুষ ভুলে গিয়েছে। বৃষ্টির আশায় শহর থেকে গ্রাম, ফুটপাতবাসী থেকে সুউচ্চ অট্টালিকার বাসিন্দা হাপিত্যেশ করে অপেক্ষায়। এমন নিরবচ্ছিন্ন উত্তাপ চৈত্র দিয়ে গেল বৈশাখকে, আর সে তাপের রেগুলেটর ধীরে ধীরে বাড়িয়েই চলেছে। তাপমাত্রা কত তাতে আর লোকের আগ্রহ নেই, ওটা এখন একটা সংখ্যামাত্র, আসল হল তাপ যা সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় বাতানুকূল যন্ত্রের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা, জোগান দিতে না পারলে পাওয়ার কাট।
গত শতক থেকে কায়িক শ্রমের ঘরোয়া সামগ্রীগুলো বৈদ্যুতিক যন্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। এসেছে বৈদ্যুতিক আলো-পাখা, মিক্সি-গ্রাইন্ডার, ওয়াশিং মেশিন, ফ্রিজ, রেডিয়ো, টেলিভিশন, এসি। জীবনযাপনে এগুলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সামগ্রী হয়ে উঠেছে। ফলে শুধু ভারত নয়, সারা পৃথিবী জুড়ে বিদ্যুতের চাহিদা ও ব্যবহার ক্রমবর্ধমান।
ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশ। বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা ৪২৬১৩২ মেগাওয়াট। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ১৮৪৪ টেরাওয়াট ঘণ্টা। ওই বছরের সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে ভারতে বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়েছে নানা ধরনের শিল্প ও কলকারখানায় ৪১%, গার্হস্থ কাজে ২৬%, কৃষিকাজে ১৭.৫% এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক সংস্থায় ৮.৩%। মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৭১.৫% অর্জিত হয় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে, যার মূল উপাদান কয়লা। এ ছাড়াও প্রাকৃতিক গ্যাস (৩.৮%), জলবিদ্যুৎ (৯.৯%), নিউক্লিয়ার (২.৯%), এবং পুনর্নবীকরণ উৎস যেমন বায়ু, সৌরশক্তি, বায়োমাস ইত্যাদি থেকেও বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। বিশ্বে ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। বোঝা যাচ্ছে, যে ভাবে সভ্যতা আধুনিক হয়ে উঠেছে, তার অনেকটাই নির্ভর করছে বিদ্যুতের উপর, এবং সেই বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে প্রধানত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। এ দিকে জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারে আমাদের ধরিত্রী তাড়াতাড়ি গরম হয়ে যাচ্ছে। তাঁরা এও বলছেন যে, ২০৩০ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা ৩০% করতে হবে, নইলে সমূহ বিপদ।
যে ভাবে আমরা বিদ্যুৎ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি এবং বিভিন্ন দেশে কয়লা উৎপাদন ও তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই হিসাব মাথায় রাখলে বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য পূর্ণ হওয়া অসম্ভব। বলা হচ্ছে ঊনবিংশ শতাব্দীতে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন হতে শুরু করেছে, গরম হয়ে যাচ্ছে সমুদ্র, মাটি। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের জন্য বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের বৃদ্ধির পরিমাপ তাঁরা দেখিয়েছেন। এ দিকে ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন পৃথিবীর এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি স্বাভাবিক, কারণ আমরা এখন উষ্ণযুগের মধ্য দিয়ে চলেছি। হিমবাহ যুগের সমাপ্তি ঘটেছে, বারো হাজার বছর আগে শুরু হয়েছে উষ্ণযুগ। এর ফলে ক্রমে পৃথিবী গরম হবে তবে এক নাগাড়ে নয়, ক্রমে ক্রমে। মাঝেমধ্যে শীতল আবহাওয়া আসবে। যেমন বারো থেকে ছয় হাজার বছর আগে পর্যন্ত পৃথিবী এমন গরম হয়েছে যে দুই মেরুবৃত্তে হিমবাহ যুগে যা বরফ জমেছিল তার অর্ধেক গলে গিয়েছে, আর এরই জন্য সমুদ্রের জলের মাত্রা ১২০ মিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই ছয় হাজার বছরের মধ্যে আবার মাঝে-মাঝে শীতল আবহাওয়াও ছিল। যেমন, আট হাজার বছরেরও কিছু আগে ‘আটলান্টিক মেরিডিয়োনাল ওভারটার্নিং সার্কুলেশন’ নামে পরিচিত সমুদ্রস্রোতের একটি প্রধান ‘সিস্টেম’-এ পরিবর্তনের কারণে উত্তর অতলান্তিক ও উত্তর ইউরোপ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় শীতল হয়ে গিয়েছিল। তা পৃথিবীব্যাপী বৃষ্টিপাতের ধরনকেও প্রভাবিত করেছে। কয়েকশো বছরের মধ্যে আবার গরম হয়ে যায়, এখনকার পৃথিবী সেই তাপমাত্রায় এখনও পৌঁছয়নি। মনে করা হয়, লবণাক্ত সমুদ্রের জলে বরফগলা মিষ্টি জলের মিশ্রণের জন্যেই উল্লিখিত ‘সার্কুলেশন’-এর পরিবর্তন হয়। ফলে পৃথিবী গরম বা ঠান্ডা হওয়াটা শুধুমাত্র গ্রিনহাউস গ্যাস বেড়ে যাওয়ার মতো একটা সহজ পদ্ধতিতে হয় না।
উষ্ণায়নের জন্যে শুধু মেরু অঞ্চলের বরফই যে গলেছে তা নয়, সুউচ্চ পর্বতগুলোর মাথায় হিমবাহের গলনও উল্লেখ্য। মহেঞ্জোদড়ো ও হরপ্পা সভ্যতার যুগে অতি উন্নত মানের নিষ্কাশন ব্যবস্থার প্রমাণ মিলেছে, এবং এও জানা গেছে, উত্তরোত্তর সেই নালার জল পরিবহণের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। মনে করা হয়, মধ্য-হলোসিন যুগে উষ্ণায়নের প্রভাবে হিমালয়ের হিমবাহ গলে যাওয়ায় সিন্ধু নদ দিয়ে প্রবাহিত জলের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার অতিরিক্ত জল নিষ্কাশনের জন্যই নালা বার বার সংস্কারের প্রয়োজন হয়েছিল। হিমবাহের বরফ গলে জল জমে থাকে পাহাড়ের গায়ে নিকটবর্তী কোনও গর্তে। সেই গর্ত তখন সাময়িক হ্রদের চেহারা নেয়। জলের পরিমাণ বেড়ে গেলে তার চাপে গর্তের পাথরে ফাটল ধরে, জল হুড়মুড়িয়ে নীচে নেমে এসে প্লাবন ঘটায়। এমন ঘটনা হিমাচল প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডে ঘটেছে। এপ্রিলের গোড়ায় রাশিয়ার উরাল পর্বতে হিমবাহ গলে জলের প্রাকৃতিক বাঁধ ভেঙে উরাল নদীর বন্যায় রাশিয়া ও কাজ়াখস্তানে চৌত্রিশ হাজার ঘরবাড়ি ভেসে যায়, এক লক্ষ লোককে স্থানান্তরিত করতে হয়। হিমালয়ে ১৪,৭৯৮ হিমবাহের মধ্যে সাম্প্রতিক কালে কিছু হিমবাহের সঙ্কোচন লক্ষ করা যাচ্ছে।
প্রকৃতির এই স্বাভাবিক চরিত্রকে কিছু প্রভাবশালী দেশের মানুষ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বাণিজ্যিক করে তুলতে চাইছে। আমরা এখনও জানি না বিশ্ব উষ্ণায়নে মানুষ কতটা দায়ী; শুধু গ্রিনহাউস গ্যাসের সংখ্যা ও মাত্রা দিয়ে প্রকৃতির চরিত্রকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। তা হলে চারশো কোটি বছর ধরে চলা হিমবাহ-উষ্ণায়নের চক্র অস্বীকার করতে হয়, সাম্প্রতিক উষ্ণযুগ এবং তার ফলে ক্রমশ গরম হয়ে যাওয়া পৃথিবীতে শীতল-উষ্ণ সময়ের চক্রের ফলে উদ্ভূত যাবতীয় নিদর্শনকে অস্বীকার করতে হয়। পৃথিবী আরও গরম হবে, গ্রিনল্যান্ডের অনেকটা বরফ মুক্ত হয়ে বিভিন্ন খনিজ সম্পদ উন্মুক্ত হবে, হিমবাহের বরফ গলবে, নদীতে জলোচ্ছ্বাস হবে, সমুদ্রের জলের মাত্রা বাড়বে, অনেক প্রাণী শেষ হয়ে যাবে, নতুন প্রাণ জেগে উঠবে। এই সত্য স্বীকার করে মানুষকে তার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।
সূর্যের তাপশক্তি বিশ্বের জলবায়ুকে চালিত করে। সমুদ্রের স্রোত এর ফলে বিঘ্নিত হওয়ায় সারা পৃথিবীতে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। সৌরতাপে ক্রান্তীয় প্রশান্ত মহাসাগরের বাতাস ও সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার তারতম্যের জন্য মাঝেমধ্যে ‘বাণিজ্য বাতাস’ দুর্বল হয়ে পড়ে। একে বলা হয় ‘এল নিনো’। এ এক ‘বৈশ্বিক জলবায়ু ঘটনা’ যা কয়েক বছর অন্তর হয়ে থাকে। এই সময় উষ্ণ বাতাস পূর্ব থেকে আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের দিকে বইতে শুরু করে। এই উষ্ণ বাতাস দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় ঢুকে এক বিশাল এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে তাকে গরম করে তোলে। গত বছরের শেষার্ধ থেকে ভারতে এল নিনো-র প্রভাব চলছে, যার কারণে পশ্চিম থেকে তীব্র শুষ্ক হাওয়া ঢুকে, এই সময়ে যা স্বাভাবিক সেই বঙ্গোপসাগর থেকে আসা জলীয় বাতাসকে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে। আগামী জুন অবধি এই তাপপ্রবাহ চলবে বলে বিজ্ঞানীদের মত।