COVID-19

বাঁচতে হবে কোভিডকে নিয়েই

বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী দিনে পরিচিত কোনও উপসর্গ ছাড়া কোভিড পরীক্ষা করার প্রয়োজন থাকবে না।

Advertisement

সুমিত মজুমদার

শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০২২ ০৪:২৮
Share:

লক্ষণ এবং পরিসংখ্যান বলছে যে, অতিমারি আপাতত নিয়ন্ত্রণে। ব্রিটেনের মতো দেশ প্রায় সব বিধিনিষেধ তুলে দিয়ে ফিরতে চাইছে চেনা ছন্দে; অনেক দেশ একটু দেখেশুনে ঠিক করতে চাইছে কিংকর্তব্য। এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে, আগামী বেশ কিছু দিন জনজীবনের অঙ্গ হয়েই হয়তো থেকে যাবে এই ভাইরাস। তাই দরকার উপযুক্ত প্রস্তুতির।

Advertisement

বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী দিনে পরিচিত কোনও উপসর্গ ছাড়া কোভিড পরীক্ষা করার প্রয়োজন থাকবে না। তবে, ভবিষ্যতে এই ভাইরাসের কোনও নতুন স্ট্রেন তৈরি হলে চটজলদি তার হদিস পাওয়ার ব্যবস্থা থাকা চাই। তার একটা উপায় হল, ঝুঁকিপূর্ণ পেশার (যেমন স্বাস্থ্য পরিষেবা, গণপরিবহণ, পুলিশ ইত্যাদি) সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে নমুনা-সমীক্ষার নিয়ম মেনে মাঝেমধ্যে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা, এবং প্রয়োজনমতো নমুনা থেকে প্রাপ্ত ভাইরাসের জিনগত বিশ্লেষণ করা। এরই পাশাপাশি প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে নিয়মিত নজরদারি।

এর পরেই আসে কোভিড টিকার কথা। আমেরিকা বা ইউরোপের অনেক দেশের তুলনায় ন্যূনতম দু’টি ডোজ়, এবং পরবর্তী বুস্টার ডোজ় দেওয়ার কাজে এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলো পিছিয়ে। এই মারণ-ভাইরাসের বিভিন্ন স্ট্রেন বা প্রজাতির প্রকোপ থেকে ভবিষ্যতে সুরক্ষা পাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে বুস্টার ডোজ় নেওয়া প্রয়োজন, সে কথা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-সহ প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই স্বীকার করে নিচ্ছে। ভারতে এক দিকে যেমন যথেষ্ট সংখ্যায় টিকার জোগান নিশ্চিত করা চাই, তেমনই ভাবা দরকার যে, অতি ভারাক্রান্ত সরকারি পরিকাঠামোর মধ্যে দিয়ে কী ভাবে মানুষকে এই টিকাকরণ কর্মসূচির আওতায় আনা যায়। সরকারি-বেসরকারি দড়ি-টানাটানির বাইরে কিছু বিকল্প সম্ভাবনার কথাও মাথায় রাখলে ভাল। যেমন, সরকারি, আধা-সরকারি ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করে কোভিড টিকা উৎপাদনে কাজে লাগানো যায়।

Advertisement

সেই রকমই, সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে টিকা দেওয়ার জন্য ভিড় না বাড়িয়ে, বিভিন্ন অবাণিজ্যিক অসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এ কাজে যুক্ত করা যায়। স্বল্পমেয়াদি কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে শিক্ষিত স্থানীয় তরুণ-তরুণীদের কাজে লাগানো যেতে পারে। যদিও এ বারের কেন্দ্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দের স্বল্পতা দেখে এই ধরনের নতুন উদ্যোগের সম্ভাবনা নিয়ে বিশেষ আশান্বিত হওয়া যাচ্ছে না। কোভিড টিকাকরণের বাইরে অন্যান্য পরিচিত ব্যবহারিক দিকগুলি, যেমন মাস্ক ব্যবহার, বার বার হাত ধোয়ার মতো কম খরচের স্বাস্থ্যবিধানের প্রচার চালু রাখতে হবে।

কোভিড মোকাবিলায় চিকিৎসাক্ষেত্রে কিছু ঘাটতিও বার বার নজরে এসেছে। পরিকাঠামোগত ঘাটতি মেটাতে জেলা-মহকুমা শহরের হাসপাতালগুলিতে জীবনদায়ী ওষুধ, অক্সিজেন, রক্ত ইত্যাদির নিয়মিত জোগান সুনিশ্চিত করা দরকার। প্রয়োজন উপযুক্ত সংখ্যায় স্বাস্থ্যকর্মীরও। নার্স, টেকনিশিয়ান ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কর্মীদের অভাব রয়েছে অনেক বড় শহরের হাসপাতালগুলিতে। উপযুক্ত সংখ্যায়, এবং সঠিক গুণমান বজায় রেখে, নার্সিং বা প্যারামেডিক্যাল কলেজ গড়ে না ওঠাই তার কারণ। এই দীর্ঘ দিনের ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার একটি উপায় হতে পারে জেলার সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল তথা মেডিক্যাল কলেজগুলির সংলগ্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা।

একই ভাবে প্রয়োজন দেশ জুড়ে গবেষণার নিবিড় পরিকাঠামো গড়ে তোলা। নতুন রোগজীবাণু নির্ণয়, সেগুলির গতিপ্রকৃতির সমীক্ষা, এবং ভারতের আর্থসামাজিক পটভূমিকার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সুষ্ঠু প্রতিবিধানের জন্য ধারাবাহিক ভাবে গবেষণার একান্ত প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থা খুব ভাল নয়, বিশেষত সরকার-পরিচালিত ব্যবস্থায়। এই পরিস্থিতি বদলানোর সময় এসেছে। পাশাপাশি এটাও খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে, কোভিড-পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্য পরিকল্পনার অভিমুখ যেন হাসপাতাল-কেন্দ্রিক হয়ে না দাঁড়ায়। দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভারসাম্য অনেকটাই নির্ভর করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার কার্যকারিতার উপর। গত বছর দুয়েকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যের নানা কর্মসূচিতে শিথিলতা আসার ইঙ্গিত দেখা গিয়েছে, যা পুষিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আর বিলম্ব নয়।

কী করা উচিত নয়, সেগুলিও স্মরণ করা চাই। প্রথমেই বলা যায় যে, লকডাউন-জাতীয় ব্যবস্থা কেবলমাত্র চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসাবেই ব্যবহার করা উচিত। নির্দিষ্ট এবং নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সরাসরি গোটা রাজ্য বা মহানগর জুড়ে লকডাউন বলবৎ করার প্রয়োজন নেই। জনসমাগম নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গেও বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই চলতে হবে।

আশার কথা, অনেক দেরিতে হলেও অবশেষে খুলেছে স্কুল। দীর্ঘ দিন স্কুল বন্ধ থাকার পরিণামে বোঝা গিয়েছে যে, অতিরিক্ত সাবধানতারও নেতিবাচক প্রভাব আছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে নানা বয়সি ছাত্রছাত্রীদের শরীর-মন-মস্তিষ্ক। আগামী অন্তত বছরখানেক স্কুলভিত্তিক স্বাস্থ্য-কর্মসূচির প্রতি মনোযোগী হতে হবে। মনোবিদদের সাহায্যে ছাত্রছাত্রীদের উপযুক্ত কাউন্সেলিং করার ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন।

এই অতিমারির সবচেয়ে দগদগে স্মৃতি হয়ে হয়তো থেকে যাবে রাজপথ জুড়ে অভুক্ত, অসহায় মানুষের ঘরে ফেরার মরিয়া প্রয়াসের দৃশ্য। আশঙ্কা এই যে, এই পোড়া দেশের রাজা-প্রজা সবাই বড় স্মৃতিবিভ্রমে ভোগেন। তাই কোভিড-পরবর্তী দু’টি কেন্দ্রীয় বাজেটে আতশকাচ নিয়ে খুঁজলেও চোখে পড়ে না অসংগঠিত পেশার, অনিশ্চিত জীবিকাগুলির সঙ্গে জড়িত শ্রমজীবী নাগরিকের স্বার্থে কোনও ফলপ্রসূ কর্মসূচির। অথচ, তাঁরাই ভারতের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ, কোভিড-কালে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত। অতিমারির আঘাতকে প্রতিহত করতে হলে জীবন আর জীবিকা, দুয়েরই সুরক্ষা প্রয়োজন।

ইউনিভার্সিটি অব ইয়র্ক, ইংল্যান্ড

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement