কিছু কি এসে যায়, যদি আমরা যারা নিজেদের বলি বুদ্ধিব্রতী (বুদ্ধিজীবী কথাটার গায়ে মাথায় কেমন যেন অসম্মানের ছ্যাতলা) সম্মিলিত আবেদনে সই না করি, বা যদি পথে না নামি সাম্প্রদায়িক হিংসার প্রতিবাদে? যদি আমরা চুপ করে থাকি, ভাবতে ভাবতে হাই ওঠে, আর ঘুমিয়েই পড়ি এক সময়, কিছুই না করে? আমরা তো দেখেছি এ সব করলে কেউ বাহবা দিয়ে পিঠ চাপড়ায় না আমাদের, সোশ্যাল মিডিয়াতে বন্ধুদের কাছে পাওয়া কিছু ইমোজি, কিছু লাইক ছাড়া। বরং সোশ্যাল মিডিয়া ও ঘরে বাইরে অপর পক্ষ ফুঁসে উঠে বলে, হ্যাঁ খুব দেখেছি, তখন কোথায় ছিলে যখন অমুকদের বিতাড়ন হচ্ছিল, তমুকদের ফ্রিজ থেকে মাংস বার করে তাদের পিটিয়ে মারা হচ্ছিল, তখন কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিলে বাছারা? কেউ কি পড়ে দেখে আমাদের প্রতিবাদ-পত্রের কপি? আমাদের তৈরি মানবশৃঙ্খলের ফটো দেখে কি কোনও দিন নড়েচড়ে বসে সরকার? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কোনও কনিষ্ঠ কেরানি নিশ্চয়ই আমাদের দৃপ্ত প্রতিবাদকে ফাইলের ভিতর গুঁজে দেয় হলুদ, জীর্ণ, ভঙ্গুর হওয়ার জন্য।
না কি, সত্যিই কোনও অনুরণন হয় কোথাও? পোড়া, লুণ্ঠিত ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে যে বধূ দেখছে দাঙ্গার নামে তাদের চাল ডাল টাকা পয়সা সব নিয়ে গিয়েছে গুন্ডারা, সে কি এই ভেবে একটু ভরসা পায় যে, তারা একা নয়, সঙ্গে আছে আরও লোকজন যারা সামাজিক ভাবে অসম্পর্কিত, অচেনা? যখন দাঙ্গায় নিহত পিতার সন্তানকে কোনও কথা না বলে কেবল জড়িয়ে ধরে থাকেন হর্ষ মান্দার, এ কথা নিশ্চিত জেনে যে তাঁর ঘর অফিসে হামলা চালাবে ইডি কিংবা গোয়েন্দা পুলিশ, কোথাও কি অশ্রুজলে সিঞ্চিত হয় না সংবিধানের পাতায় আঁকা বৃক্ষলতাপাতার ক্যালিগ্রাফি? টেলিভিশনের পর্দায় দেখছি হাতে পাথর নিয়ে চিৎকার করতে করতে উন্মত্ত ভিড় চলেছে, ঘর জ্বালাবে, মন্দির ভাঙবে, সংখ্যালঘুদের বেছে বেছে মারবে। তারা নিশ্চিত, তাদের ধর্মই শ্রেষ্ঠ, তাদের ঈশ্বর উচ্চতম, তাদের অধিকার আছে ভিন্নধর্মীদের উপাসনার অধিকার, জীবিকার, এমনকি জীবনের অধিকার নষ্ট করার। তারা এটাই শিখেছে শৈশব থেকে, ঘৃণার আঁচে প্রস্তুত হয়েছে তাদের শিক্ষা। আশ্চর্য যে, বিধর্মী নারীকে আক্রমণ করতে বারণ করে না এই ধর্মসঞ্জাত ঘৃণা। এ দেশেও উন্মত্ত জনতা মায়ের গর্ভ চিরে সন্তানকে বার করে আনায় অভিযুক্ত হয়েছে, ঘর-দুয়ার জ্বালানোর পর ধ্বংস করা হয়েছে দোকানপাট, হোটেল, ব্যবসার যাবতীয় উপাদান, এমনকি বিমার টাকা পাওয়ার পথও বন্ধ করা হয়েছে কলকাঠি নেড়ে। সংখ্যালঘুদের অর্থনৈতিক অবলুপ্তিই কি দাঙ্গার অন্যতম পরিণতি?
সভ্যতার আদিপর্ব থেকে ধর্ম আছে মানুষের সঙ্গে। প্রকৃতির নানা শক্তির উপাসনা থেকে সে এসেছে সাকার ঈশ্বরের সাধনায় অথবা নিরাকারের উপাসনায়। রাষ্ট্র যখন ধর্মের নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় হল, গোষ্ঠী যখন পরাভূত করতে চাইল মানবাধিকারকে, তখন থেকে আরম্ভ হয়েছে ব্যক্তিগত ধর্মাচরণের সঙ্কট। পৃথিবী জুড়ে ধর্মের নামে দুর্বল ও প্রান্তিকের উপর অত্যাচার চলেছে বহু শতাব্দী ধরে। ধর্মগুরুদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে কী-ই না করেছে দরিদ্র প্রান্তিক। নাস্তিক হয়েছে, ধর্মান্তরিত হয়েছে, ভিটেমাটি ছেড়ে পরদেশে চলে গেছে। উপনিবেশ থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে, জীবনপণ স্বাধীনতার লড়াই করেও আমরা রক্ষা পেলাম না ধর্ম-ব্যবসায়ীদের হাত থেকে। দেশবিভাগের পরও গৃহহীন মানুষের মিছিল চলেছে, কেবল গ্রাসাচ্ছাদনটুকু নিয়ে বাঁচার জন্য। নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্মপূর্ববর্তী কাল রাঙা হয়ে গিয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মবলিদানে, নারীর উপর আক্রমণে। এখনও ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ হতদরিদ্র। অপুষ্টিতে ভোগে শিশুরা, রক্তাল্পতায় আমাদের প্রসূতি কিশোরী মায়েরা, তবু রাষ্ট্রলালিত ধর্মব্যবসায়ীদের অধ্যবসায়ের কোনও শেষ নেই। এত ঘৃণা কোনও ঈশ্বরপ্রবণতা আমাদের দিতে পারে না। এর পিছনে আছে ব্যবসায়ী ও শিল্পগোষ্ঠীদের স্বার্থ। ঘর জ্বালানো, হত্যার মতোই ভয়াবহ, মজ্জাগত ঘৃণাকে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ও সংস্কৃতির নামে চতুর্দিকে নিক্ষেপ করা। বিজ্ঞাপনে হিন্দু সংস্কৃতির অবমাননা হয়েছে, অতএব বন্ধ করো বিজ্ঞাপন, ভাঙচুর করো দোকান, শাসন করে শেখাও যে এ দেশে থাকতে গেলে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতো করে থাকতে হবে। সংখ্যালঘুকে বাঁচতে হবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের হিসাবের খাতায় কি সবাই সমান? তা হলে দলিতদের জীবন এত অসম্মানের কেন? কেন মেয়েদের উপর আক্রমণের নিন্দা করেন না হিন্দু বা ইসলাম সংস্কৃতির ধারক ও বাহকরা? দাভোলকর, গৌরী লঙ্কেশের হত্যা কেন উৎসব-উল্লাসে উদ্যাপিত হয়?
আমরা যারা সক্রিয় রাজনীতি করি না, মননের চর্চা করে নিজেদের কিঞ্চিৎ উচ্চবর্গের ভাবি, যারা বিশ্ব সাহিত্য-সংস্কৃতির পাঠ নিয়েছি বংশপরম্পরায়, যারা পাবলিকের টাকায় ভাল স্কুল-কলেজে পড়েছি, কেউ শিক্ষক, কেউ আইটি প্রফেশনাল, কেউ ডাক্তার— তারা কি সত্যিই চোখ ফেরাতে পারি ধর্মের নামে অমানবিক আগ্রাসনের ঘটনাবলি থেকে? সত্যি কি নীরবতা সাজে আমাদের? আমাদের অনেকের জীবনেই ধর্ম আজ অবান্তর অথবা একান্ত ব্যক্তিগত। আমাদের মতোই জীবনযুদ্ধে লিপ্ত অসংখ্য নরনারীও মাথার উপর ছাদ, নিশ্চিন্ত জীবিকা, খিদের অন্ন ছাড়া কিছু চান না। আমরা যদি নীরব থাকি, তবে আমরা তাঁদের পাশে না দাঁড়িয়ে কেবল মৌলবাদীদের হাত শক্ত করি। এই পটভূমিতে বাংলাদেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকরা ধর্মমত-নির্বিশেষে সে দেশের সংখ্যালঘুদের বিপন্নতার বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, তা অন্তত এই আশাটুকু জাগায় যে— আমরা একা নই, পীড়িত মানুষ বিচ্ছিন্ন নন।
কুমিল্লা জেলার পূজামণ্ডপের যে স্ফুলিঙ্গ থেকে এই সাম্প্রদায়িক হিংসার সূচনা, তার সংবাদ আগেভাগে সংগ্রহ না করতে পারা একটা বিরাট পুলিশি ব্যর্থতা, সন্দেহের অবকাশ নেই। দেশের প্রশাসন সক্রিয় হওয়ার আগেই আগুন ছড়িয়ে গিয়েছে বারোটি জেলায়। সরকারের দোলাচলের সুযোগে উন্মত্ত মিছিলে নব যুবকদের সংখ্যা মনে ভয় ধরিয়েছে। তবে কিনা, দেরিতে হলেও বাংলাদেশ সরকার শেষ পর্যন্ত আইনমাফিক ব্যবস্থা করেছে। অথচ উল্টো দিকে, গত কয়েক বছরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর কয়েকশো হিংসার ঘটনা ঘটেছে ভারতবর্ষের মতো ঘোষিত ধর্মনিরপক্ষ রাষ্ট্রে, এবং সরকারের কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছে নিশ্ছিদ্র নৈঃশব্দ্য। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ ও লেখালিখি হয়েছে, ছাত্র-আন্দোলন হয়েছে ক্যাম্পাসে, কিন্তু নিরপেক্ষ সাধারণ মানুষের পথে বেরিয়ে প্রতিবাদ জানানোর দৃষ্টান্ত থেকেছে নগণ্য। আইনে ষড়যন্ত্রী বা দেশদ্রোহী চিহ্নিত হয়ে জেলে ঢুকলে এ দেশে বেরোবার পথ বন্ধ, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের দীর্ঘ কাল বিনা জামিনে আটক থাকা আমাদের মজ্জায় সেই বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। এ ছাড়া আছে আইটি শক্তিধর ট্রোল বাহিনী। তাদের দ্বারা নিগৃহীত হওয়ার অভিজ্ঞতাও মধুর নয়।
তবে কি আমরা নিরপেক্ষ বুদ্ধিব্রতীরা সরকারকে সংবিধান-নির্দেশিত পথে চলার ইঙ্গিতটুকুও দিতে ভয় পাই? না কি সরকারের কানে ইশারা পৌঁছনো যথেষ্ট নয়? অথবা আমাদের নিরপেক্ষতা তার ধার হারিয়েছে, আমাদের আচরণে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব জনমানসে, সরকারের কাছেও? না কি এ সবই নির্বাচন-চালিত গণতন্ত্রের সমস্যা— যেখানে প্রতিবাদীর কথা না শুনলেও সরকারের চলে যায়?