নিজের ক্ষমতায় উন্নতি
nepotism

তারকাসন্তানরা অনর্জিত সুবিধা পান; আমরাও কি পাই না?

অবস্থানগত সুবিধার জন্য আমরা ভাল আছি।

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০২১ ০৫:১৮
Share:

ঝালমুড়ির ঠোঙাটাকে দলা পাকিয়ে একটা বলের মতো বানিয়ে ডাস্টবিন তাক করে ছুড়ল সূর্য। বলটা ডাস্টবিনের গায়ে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ল। ঝালমুড়ি খাওয়া হয়ে গিয়েছিল আগেই। তার পর খুঁটিয়ে ঠোঙাটা পড়ছিল সূর্য, প্রতি বারই যেমন পড়ে। কলেজে ওর এক অধ্যাপক এক বার বলেছিলেন, সব পড়বি, ঝালমুড়ির ঠোঙাটাও— সেই গুরুবাক্য কখনও অমান্য করে না ও।

Advertisement

“ঠোঙা হয়ে যাওয়া কোন খবরটা পড়লি আজ?” প্রশ্ন করেন শিবুদা।

“আক্ষরিক অর্থে ঠোঙা হয়ে যাওয়া খবর, রূপকার্থেও,” সরাসরি উত্তর দেয় না সূর্য। “বলিউডের আরও এক স্টারকিড— তারকানন্দিনী— প্রিভিলেজ বস্তুটিকে অস্বীকার করেছেন। জানিয়েছেন যে, বাপ-মা ইন্ডাস্ট্রিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হলেই ছেলেমেয়েদের বাড়তি সুবিধা মেলে, এই কথাটা নিতান্তই হিংসুটেদের মনগড়া। কত বছর ধরে কত ঠোঙায় যে পড়লাম কোনও না কোনও তারকানন্দন এই কথাটা বলেছেন, সেই হিসেব চাইলে আমি নাচার।”

Advertisement

গোপাল চা দিয়ে যায়। শিবুদা শিশিরের প্যাকেটটা টেনে নিয়ে একটা সিগারেট ধরান। তার পর গুনগুন করে ‘রিমঝিম গিরে সাওয়ন’ গানটার সুর ভাঁজতে থাকেন। একটুখানি গেয়ে থামলেন। বললেন, “কাউকে যদি ভালবাসতে হয়, বুঝলি, তবে কে কে মহাজনের ক্যামেরা এই গানটায় যে ভাবে বম্বে শহরটাকে ভালবেসেছিল, তেমন ভালবাসবি।”

তপেশরা এক বলে দু’বার বোল্ড! একে তো শিবুদা তাঁর পেয়ারের সূর্যের কথাগুলোকে পাত্তাই দিলেন না, তায় আবার তাঁর মুখে রোম্যান্সের কথা! তপেশ গলা খাঁকরে বলল, “প্রিভিলেজ নিয়ে তবে কিছুই বলার নেই আপনার? কথা ঘোরাচ্ছেন?”

শিবুদা যে ভাবে তপেশের দিকে তাকালেন, সত্যযুগ হলে তপেশ ভস্ম হয়ে যেত। বললেন, “প্রিভিলেজ নিয়ে যা বলার আছে, সেগুলো বললে তোদের গায়ে ফোস্কা পড়বে। কিন্তু খোঁচালিই যখন, তখন শোন। ফিল্মস্টারের ছেলেমেয়েদের দু’কথা শুনিয়ে দেওয়া সহজ। আর, বলতে নেই, কথাবার্তা যা বলে তাতে বেশির ভাগেরই মাথায় খুব কিছু আছে বলেও সন্দেহ হয় না। অবিশ্যি, অভিষেক বচ্চনের মতো দু’চার জন আছে, যারা নিজেদের প্রিভিলেজ— অবস্থানগত সুবিধার কথা— বিনা অজুহাতে স্বীকার করে নেয়। কিন্তু, ওদের সুবিধাগুলো দেখা যায় বলে কি শুধু ওদেরই সুবিধা আছে? আর কারও নেই? ভেবে দেখ, এই যে আজকের মোদী-লাঞ্ছিত ভারতে তুই হিন্দু হয়ে জন্মেছিস— শুধু হিন্দু নয়, একেবারে বর্ণহিন্দু— এটা কম প্রিভিলেজ? শুধু এই পরিচিতিটুকুর কারণে কত অজস্র ঝামেলা ছাড়াই প্রতি দিন বাঁচছিস, সেটা ভেবে দেখেছিস? এই ভয়ঙ্কর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যে পুরুষমানুষ হয়ে জন্মেছিস— মহিলা নয়, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ নয়— সেই অবস্থানগত সুবিধা যে কী প্রচণ্ড, পারলে কোনও মেয়ের সঙ্গে কথা বলে বুঝে নিস। কোনও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নেই, শহরের মধ্যবিত্ত বাড়িতে জন্মেছিস— তিন পুরুষ লেখাপড়া জানে— আর কত প্রিভিলেজ চাস তোরা? দেশের একশো চল্লিশ কোটি মানুষের মধ্যে ঠিক কত জনের এই এতগুলো অবস্থানগত সুবিধা আছে, ভাবলে লজ্জায় মাথা তুলতে পারবি না।”

কথা শেষ করে আর একটা সিগারেট ধরালেন শিবুদা। তপেশরা সত্যিই চুপ। প্রসঙ্গটা যে এ ভাবে ঘুরে যেতে পারে, ওরা ভাবেনি।

পর পর কয়েকটা রিং ছেড়ে শিবুদা বললেন, “শুধু কি তারকাদের সন্তানসন্ততিরাই এই প্রিভিলেজের কথাটা অস্বীকার করতে চায় রে? যারা সংরক্ষণের বিরুদ্ধে যুক্তি দেয়, বলে যে লেখাপড়া বা চাকরির সুযোগ শুধুমাত্র যোগ্যতার উপরই নির্ভর করা উচিত— তারা কি একই ভাবে অবস্থানগত সুবিধার কথাটা অস্বীকার করে না? যেটাকে ওরা ‘যোগ্যতা’ বলে চালায়, তার ছত্রে ছত্রে প্রিভিলেজ— এমন পরিবারে জন্মানো, যাকে যুগের পর যুগ সামাজিক ঘৃণা সহ্য করতে হয়নি; লেখাপড়া ছেড়ে খেতে বা গেরস্ত বাড়িতে কাজ করতে যেতে হয়নি; শুধু পড়তে চাওয়ার জন্য মৌলবাদীদের গুলি খেতে হয়নি— গোটাটাই তো প্রিভিলেজ।”

“আরে, এ ভাবে দেখলে তো মুশকিল— আমার সঙ্গে যে এই মন্দগুলো হয়নি, সেটায় তো আমার কিছু করার নেই,” শিবুদার কথার তোড়ে বাঁধ দিতে চায় শিশির।

“একজ়্যাক্টলি! প্রিভিলেজ কথাটার সংজ্ঞা খুঁজে দেখ, ঠিক এটাই পাবি— এমন সুবিধা, যেটা পাওয়া যায়, কিন্তু অর্জন করা যায় না; যে সুবিধা পেতে কোনও চেষ্টা বা প্রতিভার দরকার নেই। মজাটা কী জানিস, আমরা প্রত্যেকেই সামাজিক মইয়ে আমাদের চেয়ে উপরে থাকা মানুষগুলোর প্রিভিলেজ দেখতে পাই— চিত্রতারকা বা বড় ব্যবসায়ীর পুত্রকন্যারা কত সহজে সব সুযোগ পায়, দেখে হিংসে হয়। কিন্তু, নিজেদের অবস্থানগত সুবিধাটা কেউ দেখতে পাই না। মইয়ে আমার নীচে যে আছে, সে কিন্তু আমার প্রিভিলেজটা দিব্য দেখতে পাচ্ছে— তার নেই বলেই পাচ্ছে। যদি প্রান্তিকতম মানুষটার জায়গায়— মইয়ের সবচেয়ে নীচের ধাপে— দাঁড়িয়ে উপরের দিকে তাকাই, তা হলে কী দেখব জানিস? হরেক কিসিমের অবস্থানগত সুবিধা।

এ বার একটা প্রশ্ন করি— যেই বললাম যে তোরাও হাজার রকম অবস্থানগত সুবিধা পাস, তোরা অমনি এমন ডিফেন্সিভ হয়ে গেলি কেন? তার কারণ, আমার কথাটায় তোরা আসলে যেটা শুনলি, তা হল: তোরা জীবনে যতখানি পেয়েছিস, সেটা নিজের ‘যোগ্যতা’য় পাসনি, পেয়েছিস অনর্জিত কিছু সুবিধার কারণে। আমি এটা বলিনি, কিন্তু তোদের মন শুনল। আর, এখানেই বাঁধল একটা গন্ডগোল,” থামলেন শিবুদা।

গল্প যখনই নতুন কোনও মোড় নেয়, সেখানে নাটকীয় বিরতি নেওয়াটা শিবুদার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, ভাবল তপেশ। কিন্তু কিছু বলল না। এক বার খোঁচানোতেই যথেষ্ট খেপেছেন আজ।

আয়েশ করে চায়ে চুমুক দেন শিবুদা। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে, গোপালের দোকানে শিবুদারা চার জন ছাড়া আর লোক নেই। কেউ তাড়া দিল না দেখে শিবুদা নিজেই কথার খেই ধরলেন, “গন্ডগোলটা হল, আমরা নিজেদের বড্ড সম্মান করি— সৎ, ন্যায্য লোক হিসেবে সম্মান। ফলে, আমাদের জীবনে যতটুকু হয়েছে, সেটা যে নিজেদের কঠোর এবং সৎ পরিশ্রমের ফলে হয়নি, কোনও অনর্জিত সুবিধার কারণে হয়েছে, এই কথাটা নিজেদের সম্বন্ধে আমাদের যে ধারণা, তার সঙ্গে খাপ খায় না। আমার ঊর্ধ্বতন চোদ্দো পুরুষ অন্যায় ভাবে বহু মানুষকে শোষণ করেছিলেন বলে, অথবা সেই শোষণ ঘটছে দেখেও নির্বিকার থেকেছিলেন বলে আজ আমি অনেকের চেয়ে ভাল আছি, এই কথাটা মেনে নেওয়া খুব কঠিন। কর্ণ জোহর আর শাহরুখ খানকে আমি কাকু আর মামা বলে ডাকি, তাই আমি ফিল্মে সুযোগ পাই, এই কথাটা মানার মতোই কঠিন। আমরা বিশ্বাস করতে চাই যে, আমার মেধা আছে, আমি নিষ্ঠার সঙ্গে লেখাপড়া করেছি বলেই আজ উন্নতি করেছি।

এখানেই শুরু হয় অস্বীকার করার পালা। প্রথমে অস্বীকার করা যে, অবস্থানগত সুবিধার জন্য আমরা ভাল আছি। আমি বর্ণহিন্দু পুরুষ, তাই অনেক সহজে জীবনে সফল হয়েছি— খোঁজ করে দেখ তো, ক’জন কথাটা স্বীকার করবে? অথচ কথাটা টাকায় ষোলো আনা খাঁটি। উল্টে যুক্তি দেবে যে, সংরক্ষণের কারণে তাদের চেয়ে অনেক অযোগ্য লোক এগিয়ে যাচ্ছে। এটা হল অস্বীকার করার দ্বিতীয় ধাপ। এটা প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া যে, শুধু ব্যক্তিগত ভাবে আমার ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক ভাবেই এই ধরনের প্রিভিলেজের কোনও গল্প নেই। অর্থাৎ, শুধু আমিই নই, সামাজিক ভাবে যারা আমার মতো, তারা কেউই এই অবস্থানগত সুবিধা পায় না। আর, যেখানে কারও কারও ক্ষেত্রে সুবিধা পাওয়াটা এতই প্রকট যে, সেটাকে অস্বীকার করার কোনও সুযোগই নেই, সেখানে বলে দেওয়া যায়— ও রকম দু’এক জন আছে, কিন্তু সবাই এই রকম প্রিভিলেজ পায় না।

“এই যে ছকটা বললাম, এ বার মিলিয়ে দেখ— তারকানন্দনদের গল্পও খাপে খাপে বসবে, আমার-তোর মতো লোকজনের গল্পও। কারণটা খুব সহজ— রাজার ঘরে যে মন আছে, টুনির ঘরেও সে মন আছে। অবস্থানগত সুবিধা পেয়েছিস, সেটা প্রকট হলে তোর মনে যতটা গ্লানি হয়, ফিল্মস্টারের পুত্রকন্যাদেরও ততটাই হয়,” কথা শেষ করে মিটমিট করে হাসেন শিবুদা।

“সবই বুঝলাম, শিবুদা, কিন্তু ওদের প্রিভিলেজে একশো কোটির সিনেমা, আর আমার প্রিভিলেজে পঁয়ত্রিশ হাজারের কেরানিগিরি, এ দুটোকে এক করে দিলেন?” ছদ্ম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তপেশ।

“বৃষ্টিটা ধরেছে, এখন না বেরোলে আবার আটকে যাব,” উঠে পড়েন শিবুদা। “তোর প্রশ্নটা বকেয়া থাক, অন্য কোনও দিন বলব’খন, কেন পঁয়ত্রিশ হাজারে আটকে যাওয়াই তোর কপাল।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement