উৎসবের আশ্চর্য গন্ধ কাটস্কিল পাহাড়ের গহ্বরে রিপ ভ্যানদের ক্রমশ আবিষ্ট করে ফেলছে। প্রতি বার এই আবেশের ক্যানভাসে শরতের তুলো-মেঘ থাকে, বাতাসে জ্বরতপ্ত সুখের মতো শিরশিরানি থাকে, বোনাসের প্রতীক্ষা থাকে, কাচের শো-কেসের এ-পারে অপার আগ্রহ থাকে ও-পারের প্রতি। কিন্তু তারই সঙ্গে যোগ হয় কুমোরটুলির কাদামাখা বাঙালি ব্যস্ততা, পাড়ার মোড়ে বাঁশের কাঠামোর আনন্দ আশ্বাস, মধ্যবিত্ত মার্কেটে উপচে পড়া ভিড়। এক দিন ভোরবেলায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সুগম্ভীর আহ্বান মহাকাশের অতল থেকে ভেসে আসবে, সেই অপেক্ষায় সুটকেস গোছাতে থাকেন উমারাও। তাঁদের সন্তানরা অপেক্ষায় থাকে স্কুলের দরজায় তালা পড়ার। সাবেক বাড়ির একলা কার্নিশ অথবা দিগন্ত বিস্তৃত টইটই প্রান্তর কৈশোরের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দেয় প্রবল অথবা প্রচ্ছন্ন উচ্ছ্বাসে।
স্কুলের দরজায় তালা পড়েছে সেই কবে। এখন কেবল খোলার জন্য হা-পিত্যেশ। পলস্তারা খসা কড়িবরগায় বহু মাসের ঝুল। না ঘোরা পাখায় বাসা বেঁধেছে পাখি। ক্লাস পালানো ছেলেমেয়ের প্রিয় বারান্দায় খেলে বেড়াচ্ছে শূন্যতার হাহাকার। মাঠের ঘাস লম্বা হয়ে ঢেকে ফেলেছে খেলাধুলো। ‘ছুটি’ থেকে ছুটি চাইছে শিক্ষাঙ্গন। দেড় বছর আগে ব্ল্যাকবোর্ডে করা শেষ অঙ্কটা এখন কেবল ধূসর কয়েকটি সংখ্যায় এসে ঠেকেছে। সেই অনড়, জং ধরা অসুখ-সংখ্যার যেন শেষ নেই। মিড-ডে মিলের চাল আলুর থলিতে তার অবয়বটিকে ভরে ফেলা যায়, আর্তিটাকে নয়।
আমরা কি ফিরতে চাইছি প্যান্ডেলে? অন্তত গত বার তো খুব করে চেয়েছিলাম। তখনও পুজো আমাদের কাছে ‘শারদোৎসব’ ছিল। পুরাণ, প্রতিমা ছাপিয়ে ‘উৎসব’ যখন সবার হয়ে যায়, তখন তাতে কেবল আনন্দের চর্চা হয়, অন্য কিছু নয়। গত বার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইউলিসিসের শেষ ঢোঁকের মতো সেই শেষ বিন্দু জীবন পানের উদগ্র তেষ্টা আমাদের আদালত পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিল। শুধু যে পথে নেমে উৎসব যাপন করার প্রত্যাশা ছিল তা-ই নয়, অন্ন অর্জনের অনন্যোপায় আকাল ছিল। অনাহার আর অসুখের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার লক্ষ মানুষের আকুতি ছিল। অস্বীকার করার উপায় নেই, গত বছর সেই দুই অন্তিমের মধ্যে আমরা একটি ভারসাম্য আনতে পেরেছিলাম। কেরল পারেনি, আমেরিকা পারেনি, কিন্তু আমরা পেরেছিলাম। উৎসবের আনন্দ নিশ্চয় স্তিমিত হয়েছিল। কিন্তু শ্মশানের স্তব্ধতা তো নেমে আসেনি শরতের আবহে?
আবার আমাদের শ্রেষ্ঠ আনন্দ-সময় গৃহের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের উঠোনে তার স্থিতি মাত্র দিন-চারেকের। কিন্তু তার পথ চেয়ে থাকার সময়টা অনেকখানি। ক্যালেন্ডারে ‘কুড়ি’ এ বার ‘একুশ’ হয়েছে। বাকি আর কিছু বিরাট আঙ্গিকে বদলায়নি। যুক্তি দেখানো যেতেই পারে, শরীরে বিঁধে যাওয়া দুই প্রতিষেধকের, খানিক নেমে যাওয়া গ্রাফ-চিত্রের। প্রতিযুক্তি মনে করিয়ে দেবে দ্বিতীয় তরঙ্গের বিভীষিকার কথা। অক্সিজেন সিলিন্ডার তখন বেহুলার শেষ ভেলা। ভাসতে না পেরে ভেসে গিয়েছে লক্ষ লক্ষ সংসার। আনন্দের উদ্যাপন বল্গাহীন হলে অসুখ কী ভাবে তার শোধ নেয়, আমরা দেখেছি। ‘বল্গা’কে কেমন করে ‘হীন’তা থেকে রক্ষা করতে হয়, ভারত তো দূর অস্ত্, পৃথিবীর তথাকথিত উন্নত দেশগুলিও কিন্তু এখনও শেখেনি। কাজেই এ বার আমরা কী করব? অভাব, অসুখ আর আনন্দকে মেলাব কী করে?
চিকিৎসকরা একমত হয়ে বারংবার বলেন, ‘সেরা প্রতিষেধক হল মুখাবরণী’। শুধু নাক আর মুখটুকু ঢেকে রাখতে হবে। তাতেই জীবাণুর জীবননাশের ক্ষমতা অর্ধেকের চেয়ে বেশি কমে যায়। আমরা কি সেই আপ্তবাক্য স্মরণে রাখি? গত বারে ‘পুজোর বাজার’-এর যতগুলি ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, আর এক বার অ্যালবামটি খুলে দেখা যেতে পারে। নতুন জামার এ-ধারে, ও-ধারে কত জন মানুষের মুখে মাস্ক ছিল? কোভিড-সচেতনতা কেবল পোস্টার হয়ে দেওয়ালে ঝুলেছিল বহু বাজারে। মাস্ক ছিল ক্রেতা বা বিক্রেতার পকেটে কিংবা থুতনিতে। সেই প্রবণতা এখনও পথঘাটে সর্বত্র। প্রতিষেধককে মানুষ প্রতারকের পর্যায়ে এনে ফেলছেন কোভিড-সতর্কতাকে নস্যাৎ করে দিয়ে। কড়া সরকারি ফরমান যদি গত বারের মতো জারি না হয়, তা হলে মানুষ তাঁর আনন্দকে আগল দেবেন কি? অথচ, এটা আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন।
অন্নের পাল্লা অসুখের চেয়ে ভারী হোক। বিকিকিনির হাটে উৎসবের ছোঁয়া লাগুক। তার সঙ্গে কোভিড বিধিও যেন পোস্টার থেকে নেমে এসে ক্রেতা আর বিক্রেতার মাঝখানে মাথা উঁচু রেখে দাঁড়াতে পারে। অতিরিক্ত শ্রমসাধ্য কাজ যখন কেউ করছেন, তিনি খানিক বিরতি চাইতেই পারেন। কিন্তু যাঁরা সেই সমস্যায় নেই, তাঁদের ‘সচেতনতা’কে কড়া হাতে সচেতন করার সরকারি সহায়ক দরকার। তৃতীয় ঢেউ ডেল্টা আনবে না ডেল্টা প্লাস, তা আমাদের হাতে নেই। কিন্তু আমরা নিজেরা যেন তার জন্য দায়ী না হই। গত বারের মতোই পুজো প্যান্ডেলে কঠোর ভাবে কোভিড বিধি পালিত হোক। মিডিয়ার মাধ্যমে নতুন পোশাক পরেই নাহয় আর একটি বার আমরা উৎসবের আমেজ নিলাম? প্রিয়জনকে কাছে পাওয়ার যে আনন্দ, আড্ডা-গান-গল্পের যে উৎসব, তাকে কি কোনও ভাইরাস কেড়ে নিতে পারে? কাছে থেকেও দূরে চলে যাওয়া উমাদের আরও এক বার ফিরে পাওয়ার মধ্যে দিয়েও তো ‘শারদোৎসব’ পালিত হতে পারে? প্যান্ডেলের জৌলুসকে তো ধনী পুজো কমিটিগুলি বদলে দিতে পারে অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটার, আইসোলেশন সেন্টার, অল্প মূল্যে খাদ্য জোগানো ক্যান্টিন ইত্যাদিতে? নাইবা পাওয়া গেল ‘সেরা প্যান্ডেল’-এর ট্রফি। মানুষের পাশে দাঁড়ানোয় তো সেরা হওয়া যাবে। এ বারের পুরস্কারগুলি সেই মর্মে দেওয়া যেতে পারে না?
রিপ ভ্যান উইঙ্কল যখন ঘুমিয়েছিল, তার দেশ তখন অন্যের উপনিবেশ। যখন সে জেগে উঠল, তখন দেখল তার চেনা জগৎ অনেক বদলে গিয়েছে বটে, কিন্তু সে এখন স্বাধীন দেশের বাসিন্দা। আর একটি বারের জন্য ‘উৎসব’কে মৃত্যুর প্রথম সত্তার করাল গ্রাস থেকে বাঁচিয়ে আমরাও অসুখ থেকে স্বাধীন হওয়া এক নতুন দেশে জেগে উঠতে পারি না?