পরিচয়: নোয়াখালির দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শনে মহাত্মা গান্ধী ও তাঁর সহযোগীরা। নভেম্বর, ১৯৪৬
অতীত দাঙ্গার স্মৃতি হারায় না, থেকেই যায়। প্রশ্ন হল এই স্মৃতি নিয়ে আমরা কী করব? প্রতিহিংসার রাজনীতি প্রত্যাঘাতের পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য নানা ভাবে দগদগে করে তুলতে চায় পুরনো ক্ষত। তারই বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসাবে মানবতাবাদীরা অস্বীকার করতে চান দাঙ্গা বা সংঘর্ষের বাস্তব— যেন হয়নি তেমন কিছুই। ফলত, প্রতিহিংসার রাজনীতি প্রাণঘাতী, আর নীরবতার রাজনীতি বালিতে মুখ ঢেকে অস্বীকার করতে চায় ঝোড়ো বাস্তব, যা পলায়নবাদ ছাড়া আর কিছু নয়। আজকের ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা প্রতিহিংসার রাজনীতির যে সুকৌশলী প্রয়োগ ঘটাতে চাইছেন, নানা ক্ষেত্রে তার জবাব নীরবতার রাজনীতি দিতে পারছে না। প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই হবে, পালালে চলবে না। যে মহাত্মাকে খুন করেছিলেন নাথুরাম, সেই মহাত্মা কিন্তু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে ভয় পেতেন না। ভয়শূন্য মানুষটি এও ভাবতেন কী ভাবে মারা যাবেন তিনি। “হত্যাকারীর ছুরিতে মরে যাওয়া ভাল, তার থেকেও ভাল কথা বলতে বলতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা। আমি জানি না ভগবান আমার জন্য কী সঞ্চয় করে রেখেছেন।” ছুরি নয়, হিন্দুত্ববাদী আততায়ীর গুলি প্রার্থনার পর হরণ করেছিল তাঁর প্রাণ। নাথুরাম যে প্রতিহিংসার রাজনীতির প্রতীক তারই বিপরীতে বাপু সত্যাগ্রহী। বিদ্বেষ ও দাঙ্গার সত্যানুসন্ধানে, প্রতিরোধে তিনি নেমেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে শুরু করে নোয়াখালির পথে।
নোয়াখালিতে মুসলমানদের হাতে হিন্দুরা, আর বিহারে হিন্দুদের হাতে মুসলমানেরা আক্রান্ত। দু’জায়গাতেই গিয়েছিলেন গান্ধী, মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, কথা বলেছিলেন। দাঙ্গার ঘটনাকে অস্বীকার করেননি, বরং শুনেছিলেন তার বিস্তারিত বিবরণ, মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে এই যাত্রায় অন্যতম সঙ্গী ছিলেন নির্মলকুমার বসু। মহাত্মা লিখেছিলেন তাঁকে, তুমি আমার সঙ্গী, আমার কর্মের ব্যাখ্যাকার হিসাবে যোগ দেবে এই যাত্রাপথে। নৃতত্ত্ববিদ নির্মলকুমার এই সুযোগ নষ্ট করেননি— গান্ধীর সঙ্গে পদযাত্রায় তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরে উঠেছিল।
উনিশশো সাতচল্লিশ সালে যে খণ্ডিত স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল ভারত, তার শরীর ছিল রক্তাক্ত। রক্তপাত যদিও ধর্মের নামে, কিন্তু ধর্মই তো একমাত্র কারণ ছিল না। দাঙ্গাবাজরা কী করতেন? দাঙ্গা-কবলিত নোয়াখালির মানুষদের বিবৃতি নিচ্ছিলেন গান্ধী আর তাঁর সহযোগীরা। লক্ষ্মীপুর থানার অধীন বিজয়নগর গ্রামের বাসিন্দা পোস্টমাস্টার প্রকাশচন্দ্র দাস শ্রদ্ধেয় মহাত্মাজিকে চিঠি লিখেছিলেন। চিঠির শেষে পোস্টমাস্টার লিখেছিলেন, “যতই লিখি ততই আবেগ বাড়িয়া উঠে।” গান্ধী আর তাঁর সহযোগীদের কাজই ছিল এই আবেগ যাতে প্রতিহিংসার পথ প্রস্তুত না করে সে দিকে খেয়াল রাখা। মানুষকে বোঝানো, আক্রান্তদের ভয়ঙ্কর দাঙ্গার বিবরণ বলিয়ে-লিখিয়ে নিয়ে ক্রোধ ও ভীতি প্রশমিত করা, আক্রমণকারীদের সরাসরি প্রশ্ন করা। এ সবই করছিলেন তাঁরা।
আক্রমণ ও দাঙ্গার কারণ যে কেবল ধর্ম নয়, অর্থনৈতিকও বটে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। নির্মলকুমার বসু নোয়াখালির অবস্থার পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছিলেন, “ধনী হিন্দু গরিব হয়ে মধ্যবিত্ত হয়েছে, গরিব মুসলমান লীগ গবর্মেন্টের ফলে ধনী হয়েছে, মধ্যবিত্ত হয়েছে এবং মধ্যবিত্ত হিন্দু যে সব ব্যবসায়-বাণিজ্য নিয়ে ছিল সেগুলি দখল করার জন্য লড়ছে। গরিব মুসলমান স্ত্রীলোক ও লুঠের ধনসম্পদের লোভে তাদের সঙ্গে রয়েছে।” টাকার লোভ, নারী-মাংসের লোভ দাঙ্গাকে জটিল ও শক্তিশালী করে তোলে। দরিদ্র মুসলমানদের মনোভাব নিয়ে নির্মলকুমার বিচলিত। তাঁর সিদ্ধান্ত, “দারিদ্র ও সমাজের নিষ্ঠুরতার ফলে তাদের মন[মনে] এমন অবস্থা আনা হয়েছে যাঁর[যার] জন্য তারা সেই নিষ্ঠুরতা ক্ষণেকের জন্য অপরের প্রতি প্রয়োগ করে সাময়িক তৃপ্তি পায়।” এর থেকে মুক্তির উপায় কী? দারিদ্র রোগের নিরসন ঘটানো। গান্ধীর রাজনীতিতে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের কথা নানা ভাবে উঠে এসেছিল। যাঁরা দাঙ্গা করেছেন সেই মানুষদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন গান্ধী। মুসলমানদের সোজা তাঁদের দোষ দেখিয়ে দেওয়ায় তাঁরা নরম হয়ে যান। নির্মলকুমারের মন্তব্য, “দোষারোপের মধ্যেও রাগ ছিল না, যে ভুল করেছে তার ভুল দেখানোর ব্যাপারই ছিল।” গান্ধী লাঞ্ছিতা ও ধর্ষিতা মেয়েদের বয়ান আলাদা করে নিতে বলেন। মেয়েদের মধ্যে অনেকেই তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা নিজের মুখে বলেন।
আক্রান্তদের মধ্যে ক্রোধ, ভয়, বেদনা ও নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে। ওঠে নানা প্রশ্ন। সে সব প্রশ্ন সব সময় প্রতিহিংসামুখী নয়, অনেক সময় নিরুপায় জিজ্ঞাসা মাত্র। “প্রিয়জন যাহাদের নিহত হইয়াছে, অথবা যাহাদের বহুকষ্টে ও বহুদিনে নির্মিত বাড়িঘর ভস্মীভূত হইয়াছে তাহাদের পক্ষে সেই বেদনা ভুলিয়া যাওয়া, কি ক্ষমা করা অতীব কঠিন কাজ। সেই আঘাত ভুলিবার উপায় কি? যে সম্প্রদায়ের লোকে সেই দুষ্কার্য করিয়াছে তাহাদের প্রতি ভ্রাতৃভাব মনে কি করিয়া আনা যায়?”
গান্ধী জবাবে বলেন, নিজের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি বিহারে যা ঘটে গেছে তা স্মরণ করতে হবে। নোয়াখালি-ত্রিপুরার তুলনায় তা কম নয়, হয়তো আরও অনেক বেশি। এখানে যা হয়েছে, তার প্রতিশোধ ওখানে, ওখানে যা হয়েছে তার প্রতিশোধ আবার নতুন কোনও জায়গায়, এই ভাবে বর্বরতার নরকে ডুবতে না চাইলে বিহারের ঘটনা থেকেই নিজেদের বেদনা ভোলার ও ক্ষমা করার পাঠ নিতে হবে। নির্মলকুমার বসুর বয়ান থেকে বোঝা যায়, নোয়াখালির মতো বিহারেও দাঙ্গার পিছনে ক্রিয়াশীল ছিল— অর্থের লোভ।
এই সব বিবরণ পড়তে পড়তে মনে হয় গান্ধী ও তাঁর সহযোগীরা চিকিৎসকদের মতো প্রবেশ করতে চাইছেন ব্যাধির মূল কারণে— দাঙ্গামুহূর্তটি কেন কী ভাবে অনুষ্ঠিত হল, কিংবা অনুষ্ঠিত করানো হল, তার চুলচেরা বিচার করে দাঙ্গার বিস্তারিত বিবরণ সংগ্রহ করে সাধারণ মানুষের কাছে তা উপস্থিত করছেন। এ বার বেছে নেওয়ার পালা মানুষেরই। কী চান তাঁরা: প্রতিহিংসা না অপ্রতিঘাত? অপ্রতিঘাতই যে দাঙ্গার হাত থেকে বাঁচার উপায় সন্দেহ নেই— আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিচার করে নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান করা চাই, ধর্মের নামে দাঙ্গা হয় বটে কিন্তু কারণটি যে ধর্মে মাত্র নিহিত থাকে না, তা স্পষ্ট করে জানা চাই। নাথুরামের, নাথুরামদের মন অবশ্য এ সব তলিয়ে দেখতে চায় না। গুলি এসে লাগে মহাত্মার বুকে।
মহাত্মা হত্যার রাজনীতি থেকে অনেক কিছুই শেখার ছিল এ দেশের মানুষের। যে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষের বিরোধিতা করে সত্যাগ্রহের সূচনা করেছিলেন মহাত্মা, সেই দক্ষিণ আফ্রিকা নেলসন ম্যান্ডেলার হাতে বর্ণবিদ্বেষের কারাগার থেকে রাজনৈতিক ভাবে মুক্তি পেয়েছিল গান্ধীহত্যার অনেক বছর পরে। ম্যান্ডেলা খুবই সচেতন ছিলেন ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’ সম্বন্ধে। সাদারা কালোদের উপর যে বর্বরতা করেছে সেই বর্বরতার পুনরাবৃত্তি যেন ক্ষমতাসীন কালোরা না করে সে বিষয়ে সচেতন সাংবিধানিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। গান্ধীর অপ্রতিঘাতের আদর্শ ম্যান্ডেলার কার্যক্রমে ফিরে এসেছিল আর এক ভাবে। কালো মানুষ হিসাবে তিনি নিজে যে বর্বরতার শিকার হয়েছিলেন সেই বর্বরতার পুনরাবৃত্তি কোনও ভাবেই চাননি তিনি। নোয়াখালি আর বিহারের দাঙ্গার পর অপ্রতিঘাতের আদর্শই জনমানসে সঞ্চারিত করতে চেয়েছিলেন বাস্তববাদী গান্ধী। তিনি ধর্মপরিচয়ে হিন্দু, নোয়াখালির ধ্বংস হয়ে যাওয়া বহু পোড়াবাড়িতে তিনি দেববিগ্রহের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মপালনের নিজস্ব সামাজিকতার অর্থ যে প্রতিহিংসা গ্রহণ নয় গান্ধী সাধারণ মানুষকে তা বোঝাতে অনেকটাই সমর্থ হয়েছিলেন।
নাথুরামের গুলি সেই অপ্রতিঘাতের আদর্শের কণ্ঠরোধ করেছিল। আজ নাথুরামকে সম্মান জানিয়ে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি যে প্রতিহিংসার আগুনকে জাগিয়ে তুলতে চায়, তা প্রতিরোধ করার জন্য দাঙ্গা বিষয়ে নীরবতা কোনও পথ হতে পারে না। বরং দু’পক্ষের সেই ভয়ঙ্কর হানাহানির স্মৃতি-শ্রুতি-নথিকে সামনে এনে গান্ধী আর ম্যান্ডেলার মতোই অপ্রতিঘাতের আদর্শকে বাস্তববাদী মানবপন্থা বলে মেনে নেওয়ার সময় এসেছে। ‘কালো’ ম্যান্ডেলা ‘হিন্দু’ গান্ধী দু’জনেই মানবতাবাদী হিসাবে যা চেয়েছিলেন, প্রতিহিংসা-পরায়ণ উচ্চবর্ণী স্বার্থান্বেষী হিন্দুত্ববাদীরা তা চান না।
বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী