এক নিঃসঙ্গ পথযাত্রী
jawaharlal nehru

নেহরু কেন তাঁর ভাবনা রাষ্ট্রগঠনে প্রতিফলিত করতে পারেননি

নেহরু তাঁর জাতিগঠনের ভাবনা বা স্বপ্ন পুরোটা কাজে পরিণত করতে পারেননি, নিজেই তা শেষ জীবনে উপলব্ধি করেছিলেন।

Advertisement

সুরঞ্জন দাস

শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২২ ০৪:২৮
Share:

এবছর আমরা ৭৩তম প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করছি। আজ যখন ভারতের গণতান্ত্রিক, যুক্তরাষ্ট্রীয়, সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ সাংবিধানিক কাঠামো বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, তখন প্রজাতন্ত্র দিবসের উদ্‌যাপন কেবল সামরিক কুচকাওয়াজ ও আলোকসজ্জায় সীমাবদ্ধ থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। আজ আমাদের প্রয়োজন, নাগরিক সমাজে সাংবিধানিক মূল্যবোধের প্রতি দায়বদ্ধতা শক্তিশালী করা, এবং যাঁদের নেতৃত্বে ভারতের প্রজাতন্ত্রের পথ চলা শুরু, তাঁদের স্বপ্ন কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে তার পর্যালোচনা করা।

Advertisement

এ দেশের সংবিধান রচনার মূল নেতৃত্ব দেন আম্বেডকর। তবে স্বাধীন ভারতের প্রজাতান্ত্রিক কাঠামোকে বাস্তবায়িত করার প্রধান কান্ডারি প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। পরিকল্পিত অর্থনীতি, শিল্পায়ন, বিজ্ঞানমনস্কতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার সামাজিক প্রসার এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক ‘উন্নয়নশীল রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৫১-৬৪’কে অনেক ইতিহাসবিদ ভারতের ‘পরিণতি আর অর্জনের কাল’ হিসাবে দেখেছেন।

তবু প্রশ্ন ওঠে, নেহরু-নেতৃত্বাধীন জাতিগঠনের ক্ষেত্রে কি কিছু বৈপরীত্য ছিল? এবং এই বিচ্যুতির মধ্যেই কি ভারতীয় রাজনীতির সাম্প্রতিক কিছু প্রবণতার শিকড় খুঁজে পাওয়া যায়? আজ সেই সব দিকেও আলোকপাত প্রয়োজন। তবে আমার এই বক্তব্যকে নেহরুপন্থার রক্ষণশীল বিচার বলে ধরে নেওয়া ঠিক হবে না। আমার বক্তব্য— নিজে যতটা চেয়েছিলেন, হয়তো ততখানি প্রগতিশীল বা সমাজতন্ত্রী হয়ে উঠতে পারেননি নেহরু। গুরুতর কিছু ফাঁক কি থেকে গিয়েছিল নেহরুর প্রচার আর তাঁর সমকালীন ঐতিহাসিক বাস্তবের মধ্যে?

Advertisement

পণ্ডিতজি আঞ্চলিক, স্থানীয় বা চিরাচরিত আনুগত্যকে অতিক্রম করে ভারতীয় রাষ্ট্রকে দেখতে চেয়েছিলেন একটি ‘যুক্তিবাদী প্রতিষ্ঠান হিসাবে, যার ভিত্তি হবে কতকগুলো সাধারণ স্বার্থের ধারণা’। ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দৈন্যের মহৌষধ নেহরু দেখতেন সমাজতন্ত্রের মধ্যে। আবার, অস্তিত্বরক্ষার জন্যই জওহরলালের কাছে অপরিহার্য ছিল সংসদীয় গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতা। তাঁর উদ্যোগে তৈরি হয় ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, বিভিন্ন সমাজ-উন্নয়নমূলক প্রকল্প। লক্ষ্য ছিল— ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। সংখ্যাগুরুর আগ্রাসনে সংখ্যালঘুর বিপদ আঁচ করেই সংবিধানে তাদের রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করেছিলেন। ভারতীয় জনজীবনে আধ্যাত্মিকতার গুরুত্বকে তিনি অস্বীকার করেননি, কিন্তু ধর্মের রাজনৈতিক ভূমিকা মানেননি। ধর্মকে বিচ্ছিন্ন রাখেন রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থেকে। দূরত্ব বজায় রাখেন ধর্মগুরুদের থেকে। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান থেকে বাদ দিতে চান ধর্মীয় প্রতীক বা আচার। জনতার মধ্যে বিজ্ঞানসম্মত চেতনার উন্মেষ চেয়েছিলেন তিনি, যা দেশকে করে তুলবে ‘স্বয়ম্ভর’ আর ‘আধুনিক’। উল্লেখ্য, ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের প্রায় প্রতি অধিবেশনেই নেহরু ভাষণ দিয়েছেন।

আদর্শ বনাম বাস্তব

তবে ক্রমে নেহরুজির ‘জাতীয় ঐক্য’-এর আদর্শ ক্রমশই ‘জাতীয় সংহতি’র একটা চাপিয়ে দেওয়া আদলের রূপ নিতে থাকল, স্থানীয় বা আঞ্চলিক সত্তাকে বিচ্ছিন্ন করে দিল। প্রাথমিক আপত্তি সত্ত্বেও নেহরু মেনে নিলেন অঙ্গরাজ্যগুলির ভাষাভিত্তিক পুনর্গঠন। শিল্পায়নের উদ্যোগেও নেহরুর ভারতে আঞ্চলিক এবং শ্রেণিগত বিরোধ থেকে জন্ম নিল কিছু ভৌগোলিক বৈষম্য। কোনও বিকল্প শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা তৈরি হল না, বরং সেই পুলিশ আর আমলাদের মুখোমুখি হতে হল ভারতীয়দের— ঔপনিবেশিক পর্বে যাদের কাছ থেকে ক্রূর অবজ্ঞা ও অত্যাচার ছাড়া আর কিছুই মেলেনি।

১৯৪৯ আর ১৯৫০-এর মধ্যেই তেলঙ্গানার কৃষক বিক্ষোভ দমনে প্রায় বারো হাজার সশস্ত্র পুলিশ ব্যবহার করেছিল দিল্লি। স্বাধীনতার প্রথম দশকেই পুলিশি প্রক্রিয়ায় নিহত মানুষের নথিবদ্ধ সংখ্যাই অন্তত ৮০০; পুলিশ খাতে ভারত সরকারের ব্যয়বরাদ্দ ১৯৫১-৫২’র নব্বই লক্ষ থেকে ১৯৭০-৭১ সালে বেড়ে হয় আশি কোটি টাকা; ১৯৬১ থেকে ’৭০-এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সামরিক বাহিনীর সাহায্য নিতে হয় ৪৭৬ বার। আবার, নেহরু সরকারই ১৯৫৮-র আফস্পা আইনের সাহায্য নিয়েছে। ১৯৫২-৬৪’র মধ্যে বিভিন্ন রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হয়েছিল অন্তত পাঁচ বার, হয় কংগ্রেসের ভিতরকার চাপেই, অথবা সেই অঞ্চলে কংগ্রেসের প্রাধান্য সুনিশ্চিত করতে। বিশেষত ১৯৫৯ সালে কেরলে দেশের প্রথম গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত কমিউনিস্ট সরকারের অপসারণে নেহরু কড়া সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। নেহরু সরকারই বিনা বিচারে ‘নিবর্তনমূলক আটক আইন’ প্রয়োগ করে, যার বিরোধিতা করেন কংগ্রেসের জে বি কৃপালনীর মতো নেতারাও। জওহরলাল নিজেও জনমানসে এই আইনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা বিষয়ে চিন্তিত ছিলেন, তার প্রমাণ মেলে ১৭ জানুয়ারি ১৯৪৯-এ মুখ্যমন্ত্রীদের লেখা তাঁর চিঠি থেকে।

সেই সময়ই ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই জন্ম দিল এক কেন্দ্রাভিমুখী প্রক্রিয়া। এককেন্দ্রিক প্রবণতা থেকে জন্ম নিল কিছু ‘ক্ষয়িষ্ণু পিছুটান’, আঞ্চলিক বঞ্চনা থেকে তৈরি হল বিভিন্ন কেন্দ্রবিরোধী প্রবণতা।

সমাজতন্ত্রের প্রতি তাত্ত্বিক আনুগত্য সত্ত্বেও, কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ চাপেই, জওহরলাল মেনে নিলেন ১৯৫৬-র শিল্পনীতির খসড়াটি, যেখানে ‘সমাজতন্ত্র’র বদলে গৃহীত হল ‘সমাজতান্ত্রিক ঝোঁক’। এর ফলে, অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারি থাকল বেসরকারি ক্ষেত্রের। তৃতীয় পরিকল্পনা-পর্বের শেষ দিকে ভারতবর্ষের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি ছিল কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের হাতে, সংখ্যাটা ১৯৬৪-র মহলানবীশ কমিটি রিপোর্টের মতে ২০ আর ১৯৬৫-র কে সি দাশগুপ্ত কমিশন রিপোর্টের মতে ৭৫। ভারতে কর্পোরেট সেক্টরে মোট মুনাফায় বিদেশি কোম্পানির অংশ ১৯৫৯-৬০ সালে ছিল ২৯.৮%, যা ১৯৬২-৬৩ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩.৩%। এই আমলের অর্থনীতিতে বেসরকারি ক্ষেত্রের বাড়বাড়ন্তে কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। ভূমিসংস্কারের পরিকল্পনাও যে যথাযথ বাস্তবায়িত হতে পারেনি, নেহরু নিজেই স্বীকার করেছেন।

নেহরু তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতার কর্মসূচিকেও যতটা চেয়েছিলেন ততটা জোর দিয়ে কায়েম করতে পারেননি। অনেক ধর্মীয় উৎসবের দিনগুলোই হয়ে গিয়েছিল সরকারি ছুটির দিন; মৌলবাদী সংগঠনগুলো সক্রিয়ই রইল। ১৯৬১-তে জব্বলপুরে, ১৯৬৪-তে রৌরকেলা আর কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ থেকে সরে আসে কংগ্রেসের ভিতরেরই গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। নেহরুর আপত্তি সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ উদ্বোধন করলেন পুনর্নির্মিত সোমনাথ মন্দির, বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হাজিরা দিতেন কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীরাও।

ভারতের জাতীয়তার গঠনে অন্য যে ক্ষেত্রটিতে নেহরুর অবদান অবিস্মরণীয়, তা হল আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জোট-নিরপেক্ষতার নীতি। এই নীতির ফলে সূচিত হয়েছিল ‘পুরনো একটি যুগের অবসান, বিশেষত ইউরোপ তথা পাশ্চাত্যের প্রতি এশীয় দেশগুলির আনুগত্যের যুগের অবসান’। কিন্তু কখনও কখনও মনে হয়, উদীয়মান এশিয়ার প্রতিভূ হিসাবে ভারতকে দেখতে চাওয়া, হয়তো সেটাই আমাদের প্রতিবেশী অনেক দেশের মধ্যেই ভারতের ক্ষমতালিপ্সা সংক্রান্ত একটা ভীতির সঞ্চার করেছিল। আবার, সত্যিই বিভিন্ন সময়ে নেহরু প্রতিবেশী দেশগুলোর মন জুগিয়ে চলেছিলেন, সম্ভবত পড়শির সঙ্গে সৌহার্দ বজায় রাখার আন্তরিক আগ্রহ থেকেই। সেই জন্যই অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ সত্ত্বেও, স্বীকৃতি দিয়েছেন চিনের মধ্যে তিব্বতের অন্তর্ভুক্তিতে। ১৯৬২-র চিন-ভারত সীমানা সংক্রান্ত বিরোধকে অনেকেই নেহরুর ‘পঞ্চশীল’ নীতির ব্যর্থতা হিসাবে দেখে থাকেন, যে নীতির উদ্দেশ্যই ছিল চিন-ভারত মৈত্রী। আহূত হয়েও তিনি নেপাল থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছিলেন। একটা সময়ে তিনি চিন্তাভাবনা করছিলেন পাকিস্তানের সঙ্গে একটা ফেডারেশন গঠনের, যদিও তাতে অপর পক্ষের কোনও সমর্থনই মেলেনি। রাষ্ট্রপুঞ্জে কাশ্মীর প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্যের কাঙ্ক্ষিত ফল মেলেনি।

কেন বিচ্যুতি

সমাজবিজ্ঞানীরা প্রশ্ন করেছেন: কেন নেহরু তাঁর সমাজবাদী, গণতান্ত্রিক ও আধুনিক ভাবধারা নিজের মতো করে ভারতের রাষ্ট্র গঠনে প্রয়োগ করতে পারলেন না? হয়তো এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতটি তৈরি হয়েছিল সেই ১৯৩৬-এর নির্বাচনের সময়েই। সাম্প্রতিক গবেষণা দেখিয়েছে, ১৯৩৬-এর নির্বাচনের জন্য সংগঠিত কংগ্রেসের কর্মী-দলের একটা নির্দিষ্ট রক্ষণশীল অভিমুখ ও অভিপ্রায় ছিল। অধিকাংশ প্রার্থীই ছিলেন স্থানীয় ব্যবসায়ী, ঠিকাদার বা জমিদার/জোতদাররা। এর ফলে, কংগ্রেসের ভিতরেই শুধু রক্ষণশীলরা প্রভাবশালী হয়ে ওঠেনি, ১৯৩৭-এর প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় এই অংশটাই রাজনৈতিক ভাবে ক্ষমতাবান হল।

স্বাধীনোত্তর পর্বে কংগ্রেস দলের মধ্যে দক্ষিণপন্থী প্রাধান্য দৃঢ় ভাবে প্রোথিত হল, এবং সেটা নেহরুর প্রগতিবাদী ভাবধারার প্রতিবন্ধক হয়ে উঠল। অনেকে মনে করেন, দলের মধ্যে রক্ষণশীল চিন্তার সঙ্গে মোকাবিলার প্রয়োজনেই নেহরু কংগ্রেসের মধ্যে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সচেতন প্রয়াস চালিয়েছেন। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই সরকারের সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্কের উপরে। ১৯৪৭-এর নভেম্বরে কৃপালনীর পদত্যাগের পর এমন কেউই কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হলেন না, যাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সামনে প্রশ্ন তোলার মতো ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠতে পেরেছেন। লক্ষণীয়, কংগ্রেসের এই পার্টি-সরকার সংঘাতের পুরো সময়টা জুড়েই স্পষ্ট ভাবে উঠে এল নেহরুর রাজনীতির তত্ত্ব আর অনুশীলনের স্ববিরোধ। নেহরু নিজেই এক সময় মনে করছিলেন, একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী আর কংগ্রেস সভাপতি না হওয়াই শ্রেয়। ১৯৫১ আর ১৯৫৩-তে কিন্তু তিনি কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করলেন—‘অন্য কোনও বিকল্প নেই’ এই যুক্তিতে।

তবে মনে রাখা প্রয়োজন, যখনই উপনিবেশের শাসন কাটিয়ে কোনও জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় এসেছে, অথচ রাজনৈতিক পটপরিবর্তন আর সামাজিক বিপ্লব যুগপৎ ঘটে যেতে পারেনি, তখনই সরকার আর শাসক দলের মধ্যে থেকেই গেছে এমন একটা ব্যবধান। ইন্দোনেশিয়ার সুকার্নো, মিশরের নাসের, কেনিয়ার কিনিয়াট্টা, ঘানার এনক্রুমা— এঁরা সকলেই ক্ষমতাকে কেন্দ্রীয়করণ করতে চেয়েছেন, আর তার ফলে বিপর্যয় ঘটেছে তাঁদের নিজেদের রাজনৈতিক দলের কার্যকারিতায়।

১৯৫৩-র এপ্রিলে যথেষ্ট আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গেই নেহরু বলছেন: “আই শ্যাল নট রেস্ট কনটেন্ট আনলেস এভরি ম্যান, উয়োম্যান অ্যান্ড চাইল্ড ইন দ্য কান্ট্রি হ্যাজ় আ ফেয়ার ডিল অ্যান্ড হ্যাজ় আ মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড অব লিভিং।” নেহরুর মৃত্যুর প্রায় ছয় দশক পরেও এই আশা আজও মরীচিকা। সন্দেহ নেই, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সামনে ছিল ‘পাহাড়প্রমাণ দায়ভার’। তবু, জাতিগঠনের ক্ষেত্রে তাঁর নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যগুলিতে পৌঁছতে জওহরলাল বাধাপ্রাপ্ত হন নিজের দলের ভিতর থেকেই। দলের মধ্যে বিভিন্ন শক্তির আন্তঃসম্পর্ক এবং দক্ষিণপন্থীদের কর্তৃত্বের জন্য। আত্মজীবনীতে নিজের এই নিঃসঙ্গতা স্বীকার করছেন জওহরলাল।

আর একটু এগিয়ে বলা যায়, নেহরুর জাতিগঠনের প্রগতিবাদী ধ্যানধারণার বাস্তবায়িত করার কাঠামোগত প্রধান অন্তরায়টিই ছিল— ১৯৪৭-এর ক্ষমতার হস্তান্তরের অপূর্ণতা। ১৫ অগস্ট যা ঘটেছিল, তাকে গ্রামশ্চির ভাষায় বলা চলে, একটা ‘প্যাসিভ রেভলিউশন’, যেখানে ক্ষমতার হস্তান্তরের সঙ্গে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের এক গভীর ব্যবচ্ছেদ থেকে যায়। নেহরুর ভারতের দরকার ছিল সামাজিক বিপ্লব আর মৌলিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জন্যে রাজনৈতিক আন্দোলন। সেটা হল না। পাশাপাশি দিল্লিই ভারতের প্রতিভূ হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু ভারতকে আমাদের দেখতে পাওয়া দরকার ছিল এমন একটি জাতিসত্তা হিসাবে— যেখানে বহু আঞ্চলিক ও বিবিধ সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সমবায় বর্তমান। তা হলেই নেহরুর জাতিগঠনের পথ পরিপূর্ণতা পেত।

নেহরু তাঁর জাতিগঠনের ভাবনা বা স্বপ্ন পুরোটা কাজে পরিণত করতে পারেননি, নিজেই তা শেষ জীবনে উপলব্ধি করেছিলেন। তা সত্ত্বেও ভারতের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক কাঠামোর যে মূল আদর্শ— গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রবাদ— এ সব বাঁচাতে ও তাদের শক্তিশালী করতে আমাদের আজ নেহরুর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণের দিকেই আবার ফিরে তাকাতে হবে।

উপাচার্য, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement