সুরবাহার: সলিল চৌধুরীর সঙ্গে লতা মঙ্গেশকর
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল ‘ইয়ে জ়িন্দেগি উসিকি হ্যায়’ শুনে। মফস্সলের কিশোরের চোখ ভেসেছিল আনারকলির বেদনায়। এমন প্রেমকে আঘাত করলে কোনও সাম্রাজ্যই স্থায়ী হয় না। এমনই মনে হয়েছিল সে-বয়সে। তখনও আনারকলি-র নাট্য-আখ্যানের সত্যতা নিয়ে ওঠা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি। কিন্তু জন্মের বহু আগে তৈরি সে-ছবিতে সি রামচন্দ্রের সুরে লতা মঙ্গেশকর কোন জাদুতে আমার মতো সাধারণ কিশোরের মনেও বীণা রায়কে জীবনের প্রথম প্রেমিকা এঁকে দিয়ে গেলেন! ১৯৫৩ সালের একই ছবিতে রাজিন্দর কৃষ্ণনেরই কলমে আর একটি গান ‘জাগ দর্দ ইশক জাগ’। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে লতা! মায়া-সভ্যতা বোধ হয় একেই বলে! লতা ধরছেন ‘কিসকো শুনায়ু দাস্তাঁ’ থেকে, সামান্য আলাপি আউচারের পর। ১৯৬০ সালে একই আখ্যানের আর এক রুপোলি বয়ান মুঘল-এ-আজ়ম। প্রেমিকা বদলে গেল আমার। নাদিরা বীণা রায়ের জায়গায় এলেন নাদিরা মধুবালা। উপমহাদেশের প্রবচন-পদাবলি হয়ে উঠল নৌশাদের সুরে ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া’।
ওই ছবিতেই তানসেনের ভূমিকায় গাইছেন উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান— ‘প্রেম যোগন বন কে’। উস্তাদজি ফিল্মে গাইতে অরাজি। একটি গানের জন্যই এমন বিপুল টাকা চেয়েছিলেন, যাতে পরিচালক কে আসিফকে ফিরিয়ে দেওয়া যায়। ফিরে যাননি পরিচালক। ওই একই ছবিতে নৌশাদ লতাকে দিয়ে গারা রাগে গাওয়াচ্ছেন দাদরা তালে ঠুমরি ‘মোহে পনঘট পে’, যে-গানে ‘মোরি সারি আনাড়ি’ অংশে এক অনতিক্রম্য লাস্যে ঠোঁট ফুলে উঠছে মধুবালার। সেই লাস্যভাব মূলত তৈরি হচ্ছে ওই মরাঠি কণ্ঠশিল্পীর গায়কিতেই। এমন গায়নভঙ্গি বিশ্বসঙ্গীতের সম্পদ।
লতা মঙ্গেশকরের গানের সংখ্যা কত, তিনি নিজেও জানতেন না। নানা ভাষায় গাওয়া সেই সব গানের সব শোনাও সম্ভব হয়নি জীবনে। এক জীবনে তিনি যা করে গিয়েছেন, সাধারণ শ্রোতার পক্ষে এক জীবনে তার রসাস্বাদন অসম্ভব। হিমশৈলের চূড়ার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর কী-ই বা করার থাকে! উষা মঙ্গেশকরের সঙ্গে লতা গেয়েছিলেন ‘অপলম-চপলম’। ১৯৫৫ সালের আজ়াদ ছবির সে-গান যুগল নাচের সঙ্গে। অতিদ্রুতি সে-গানের। অতিদ্রুত ঝালা বাজছে যেন। ‘ওয়ান-টেক’ রেকর্ডিংয়ে কী করে সম্ভব হল সে-কাজ, ভাবলে পাথার অকূলই হয়! এই লতাই শিব-হরির সুরে ১৯৮২ সালে সিলসিলা ছবিতে যখন গাইছেন ‘ইয়ে কাঁহা আ গয়ে হম’, মনে হচ্ছে বিশাল ডানার বিষাদ-পাখির অবতরণ ঘটছে। করুণ-নিস্তেজ শান্তি চরাচর দখল করে নামছে যেন। আবার বিমল রায়ের মধুমতী ছবিতে, যার চিত্রনাট্য ঋত্বিক ঘটকের, সলিল চৌধুরীর সুরে ‘আজা রে পরদেশি’ গানে তাঁর গলা অতিপ্রাকৃত, ছায়াময়, নিশিডাকের সমতুল হাতছানি। গানে এই অবিশ্বাস্য নাটকীয়তার আর এক নাম লতা মঙ্গেশকর।
লতা মঙ্গেশকর এক সাবেক সিন্দুকেরও নাম। যে-সিন্দুকে এক সঙ্গে নানা প্রজন্মের পরম্পরা প্রতিনিধিত্ব করে। সে-সিন্দুকে ঠাকুমা-দাদুর আবছা-ধূসর ছবিও আছে, আছে নিজের বাল্যবেলার পোশাক, আছে নাতি-নাতনির খেলনাও। ছায়াছবি এবং বেসিক রেকর্ডের ইতিহাসে সুরকার, গীতিকার, সঙ্গীতায়োজক প্রতি প্রজন্মে বদলেছেন। এসেছে নতুন নতুন আঙ্গিক। প্রযুক্তিও বদলেছে সমান তালে। এই সব কিছুর মধ্যে ধ্রুব থেকে গিয়েছেন লতা। যুগের সঙ্গে তিনিও নিজেকে বদলেছেন, কিন্তু ‘লতাত্ব’ অটুট রেখেই। সি রামচন্দ্র, মদনমোহন, নৌশাদ, শচীন দেব বর্মণ, জয়দেব, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, রাহুল দেব বর্মণদের মতো সুরকারের নাক্ষত্রিক অভিকর্ষেও আপন বলয়ছন্দে সাবলীল তিনি যেমন, তেমনই পরবর্তী বহু সুরকারের কাজেও প্রতিস্পর্ধী স্পন্দে নন্দিত। এ আর রহমানের সুরের প্রাচ্য-প্রতীচী অর্কেস্ট্রেশনের রসায়নাগারেও তাঁর তুলনা একমাত্র তিনি। রং দে বসন্তী-র ‘লুকাছুপি’ সবার পক্ষে গাওয়া সম্ভব নয়।
গান মধ্যেমাঝে সময় এবং ইতিহাসের দলিলও হয়ে ওঠে। লতা মঙ্গেশকরের অজস্র গান তেমনই মাইলফলক। যেমন, ১৯৬৩ সালের ‘অ্যায় মেরে বতন কে লোগো’ জাতীয়তাবাদের সমার্থক হয়ে রইল। যেমন, ‘ঝিলমিল সিতারোঁ কা’ হয়ে রইল প্রেমবাসনার চিরন্তন পরিকল্পকথা। যেমন, ‘সত্যম্-শিবম্-সুন্দরম্’ হয়ে রইল স্পর্শগন্ধি ভক্তিমার্গের উচ্চারণ। যেমন, মরাঠি মেয়ের বাংলা গানের অমিয় সম্ভার হয়ে রইল বাঙালির নিজস্ব-আপন। ‘শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে’!
তাঁর গানভুবন, তাঁর উচ্চারণের জাদু, তাঁর হাত-পা-মুখ-শরীর স্থিরনির্লিপ্ত রেখে দাঁড়িয়ে স্বরপ্রক্ষেপণের নিঃসীম তরবারি— মহাবিশ্ব আর কখনও পেয়েছে বলে মনে হয় না। আরও একটি বিষয়— উপমহাদেশের মার্গগান এবং লোকগানের উপর তাঁর দাপুটে দখল। নানা রাজ্যের লোকসঙ্গীত লতার কণ্ঠে নাগরিকতার ভিন্ন মাত্রায় অনূদিত। হিন্দি চলচ্চিত্রে বাংলা, পঞ্জাব এবং দক্ষিণী সুরের প্রভাব আগে থেকেই ছিল। নৌশাদ তাতে যোগ করেছিলেন উত্তর ভারতের লোকগানের আঙ্গিক। এই সব বয়ানেই লতা চাহিদার নিযুত শতাংশ বেশি উপহার দিয়েছেন। রাগসঙ্গীতের ব্যবহারে সুরকারদের চিন্তা থাকত না লতা মঙ্গেশকরকে পেলে। কারণ, তাঁর সারস্বত স্পর্শে সেখানে তানকারির আগুনে কাব্য বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকত না। ‘ইচকদানা বিচকদানা’ রাগনিবদ্ধ হলেও লতায় তার আলাদা নার্সারি রাইমের পরিভ্রমণ। একই ভাবে তাঁর ‘যাও রে যোগী তুম যাও রে’ গানের রাগাশ্রয় গড়ে তোলে শঙ্কর জয়কিষণের প্রার্থিত মাথুর-আন্দাজ। লতার কণ্ঠে চলচ্চিত্র এবং বেসিক রেকর্ডে রাগসঙ্গীতের ব্যবহার যে কোনও সঙ্গীত-গবেষকের বিপন্নতার মোক্ষম কারণ।
রেকর্ডিংয়ে তাঁর কত ক্ষণ সময় লাগবে, তা ব্রহ্মাণ্ডের কারও জানা ছিল না। এমনও ঘটেছে, সকাল ন’টায় স্টুডিয়োয় ঢুকে পরের দিন ভোর পর্যন্ত ব্যস্ত থেকেছেন, ব্যস্ত রেখেছেন প্রায় দেড়শো যন্ত্রী এবং প্রায় পঞ্চাশ জন সহকণ্ঠশিল্পীকে। কারণ, নিজের গাওয়া তাঁর পছন্দ হচ্ছিল না। কী সেই গান? ‘ঘর আয়া মেরা পরদেশি’। তাঁকে দিয়ে গাওয়ানোর আগে সুরকারেরা লতার এই নাছোড় মনোভাবের কথা মাথায় রাখতেন।
এক দিন গানকে পেশা হিসাবে নিতে হয়েছিল তাঁকে সংসার চালানোর জন্য। কিন্তু সে-পেশাকেই সংসার করে নিয়েছেন তিনি অচিরে। তার জন্য সব ধরনের সাধনা করেছেন। সঙ্গীতের পাঠ নেওয়া পারিবারিক সূত্রে শুরু হলেও সাধনার এই একাগ্রতা তাঁর স্বোপার্জিত। উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান তাঁর সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করেন? ‘উস্তাদোঁ-কে-উস্তাদ’। উস্তাদ বিসমিল্লা খানের প্রত্যয়, ‘সুরেলি লতা’ চেষ্টা করেও জীবনে বেসুর গাইতে পারবেন না। পণ্ডিত ভীমসেন জোশী তাঁকে ডাকতেনই ‘ভারতরত্ন’ নামে। এঁরা সবাই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে কিংবদন্তি শিল্পী। কিন্তু মার্গসূত্রের স্থিরনিবদ্ধ সঞ্চারগতি ছেড়ে গানের নানা ধারায় বহমান শিল্পী লতা মঙ্গেশকরের মধ্যে তাঁরা সঙ্গীতের আবহমানতাকেই প্রত্যক্ষ করেছেন, বিস্মিত হয়েছেন গানের শাখাপ্রশাখায় কোকিলকণ্ঠীর অনায়াস উড়ানে। সাধনধর্মেই লতা মঙ্গেশকর সরস্বতীর ব্যক্তিপ্রকাশ।
গানের সাধিকা, আধুনিক মীরাবাই লতা মঙ্গেশকর এক অনির্বচনীয় শ্রুতিসঞ্চয়, এক মহাজাগতিক বিস্ময়, যা সত্য না কি মায়া, বোঝা কঠিন। তাঁর মহাপ্রয়াণের অর্থ পৃথিবী থেকে একখণ্ড পৃথিবীর ছিটকে যাওয়া। মহাত্মা গান্ধী বিষয়ে যেমন বলেছিলেন আইনস্টাইন— ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এটা ভেবেই বিস্মিত হবে যে, রক্তমাংসের এমন এক জন সত্যিই এক দিন এই পৃথিবীর মাটিতে ঘুরে বেড়াতেন— উপমহাদেশের নন্দনকলায় লতা মঙ্গেশকর সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়।