সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আইপিসিসি-র যে রিপোর্টগুলি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলে দেওয়া হয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন শুরু হয়ে গিয়েছে, কারণ বর্তমানে বিশ্বের উষ্ণতা শিল্প-বিপ্লবের আগের চেয়ে (১৮৫০-১৯০০) ১.১ ডিগ্রি বেশি। জলবায়ু পরিবর্তন হয়েছে মানুষের জন্যই, তার কার্যকলাপে উৎসারিত গ্রিনহাউস গ্যাস থেকে।
ভারতে পঞ্চাশের দশক থেকেই অত্যন্ত গরম, আর অতি ভারী বৃষ্টি ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। ভারতকে জলবায়ু পরিবর্তনের ‘হটস্পট’ বলা হচ্ছে। তা কেবল ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্যই নয়, উন্নয়নে খামতির কারণে (যেমন দারিদ্র, অপুষ্টির উচ্চ হার) বাড়তি বিপন্নতার জন্য। গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমানো বিশ্ব উষ্ণায়নের মোকাবিলার একমাত্র উপায়। দুর্ভাগ্য, এখন বিভিন্ন দেশ নিঃসরণ কমানোর যে লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছে, তাতে একবিংশ শতাব্দীর শেষে বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়তে পারে ২.৬ ডিগ্রি থেকে তিন ডিগ্রি পর্যন্ত। ভারতের মতো গরম, আর্দ্র দেশে উষ্ণায়নের এই হার এক ভয়ানক পরিণামের সঙ্কেত দেয়।
গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাবে পঞ্চাশের দশকের পর থেকে সারা বিশ্বে গড় বৃষ্টিপাত বেড়েছে। কিন্তু ভারতে মৌসুমি বায়ুজনিত বৃষ্টিপাত ছয় শতাংশ কমেছে। বিশেষ করে গাঙ্গেয় উপত্যকায়, যা সারা ভারতের খাদ্যশস্যের এক প্রধান উৎস। এর কারণ, বায়ুদূষণের জন্য উৎক্ষিপ্ত ‘এয়ারোসল’ কণার শৈত্যপ্রভাব। মৌসুমি বৃষ্টি কমে আসায় পঞ্চাশের দশক থেকেই খরার সংখ্যা বেড়েছে। একই সঙ্গে অতিরিক্ত বৃষ্টির ঘটনাও বেড়েছে, বিশেষ করে আশির দশক থেকে। অল্প জায়গায় অতিরিক্ত বৃষ্টির জন্য বন্যার ঝুঁকি বেড়ে গিয়েছে। ভবিষ্যতে বন্যার তীব্রতা বাড়ার সম্ভাবনা, এবং তা বাড়বে গঙ্গা, সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্রের মতো বড় নদীগুলির উপত্যকায়।
গত দুই দশকে হিমালয়ের হিমবাহগুলি যতখানি ক্ষয় হয়েছে, তার আগের একশো বছরে অতটা হয়নি। বিশেষ করে বাকি দক্ষিণ এশিয়ার তুলনায় হিন্দুকুশ হিমালয়ে উষ্ণতা বাড়ার সম্ভাবনা বেশি, ফলে হিমবাহ গলবে বেশি। অনুমান, উষ্ণায়ন কমানোর জন্য এখনই ব্যবস্থা না করলে একুশ শতকের মধ্যে হিমবাহের দুই-তৃতীয়াংশ গলে যাবে।
বিশ্বে যত ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার হয়, তার এক-চতুর্থাংশ হয় ভারতে। তার উপর নির্ভর করেই ভারতের সবুজ বিপ্লব হয়েছে।এই পরিবর্তন জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অতটা নয়, যতটা দেশের নীতির জন্য। ভূগর্ভের জল ব্যবহারের নীতির জন্য গাঙ্গেয় উপত্যকার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে বছরে ২ সেন্টিমিটারেরও বেশি হারে ভূগর্ভের জল কমছে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের সময়ে ভারতে আধা-শুষ্ক এলাকাগুলিতে ভূগর্ভের জলের ঘাটতি অনেকটাই পূরণ হয়। তবে জলবায়ু পরিবর্তন হতে থাকলে ভবিষ্যতে তা কতটা সম্ভব হবে, তা স্পষ্ট নয়। ভারতে ভূগর্ভস্থ জল কমে আসার প্রধান কারণ হল ভ্রান্ত নীতি। জলের জন্য উৎপাদনে ঘাটতি সব চাইতে বেশি হবে বিশ্বের যে পাঁচটি নদী উপত্যকায়, তার তিনটি ভারতে— সিন্ধু, সবরমতী ও গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র।
ভারতের খাদ্য নিরাপত্তাও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিপন্ন। সারা বিশ্বেই কৃষি উৎপাদন কমছে, তবে দক্ষিণ এশিয়ার মতো উষ্ণতর অঞ্চলগুলি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যত বার্ষিক গড় তাপমাত্রা বাড়বে, তত গড় ফসল উৎপাদন কমবে, এটা ১৯৬৭-২০১৬, এই সময়ের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে। একুশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে প্রধান ফসলগুলির উৎপাদন দুই থেকে সাত শতাংশ কমতে পারে, শতকের শেষে সাত শতাংশ থেকে চব্বিশ শতাংশ কমতে পারে। গম, ভুট্টার ক্ষতি হবে বেশি, ধানের কম, কারণ ধান বরাবরই আর্দ্র অঞ্চলে জন্মায়। সেই সঙ্গে আমাদের পাতের প্রধান প্রোটিন জোগানদাতা মাছের সংখ্যাও কমছে, কারণ উপকূল এলাকাগুলিতে বাড়ছে লবণাক্ততা। তার জন্য মাছেদের মৃত্যুহার ইতিমধ্যেই বেড়েছে।
এ সবের ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধা দূর করার যে লক্ষ্য ভারত তথা বিশ্ব গ্রহণ করেছিল, রাষ্ট্রপুঞ্জের সেই ‘সুস্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্য’ অধরা থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। ভারতে পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে যে, যে সব জেলায় জলবায়ু-জনিত বিপন্নতা বেশি, সেখানে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির জন্য কম দৈর্ঘ্য, অতিরিক্ত রোগা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। একটি বিশ্লেষণ অনুসারে, এই শতকের মাঝামাঝি সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলাতে এই রাজ্যকে এখনকার চাইতে তিন গুণ বেশি শস্য মজুত রাখতে হবে।
এখনই সর্বাত্মক চেষ্টা না করলে ভারতে জলবায়ুর পরিস্থিতি যথেষ্ট ভীতিপ্রদ হতে পারে। সেই সঙ্গে উষ্ণতর পৃথিবীর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার নানা উপায়ও কার্যকর করতে হবে। জল ও খাদ্যের জোগানের দিকে তাকিয়ে এখনই জরুরি ভিত্তিতে কাজ করা প্রয়োজন। চাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও।
ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।