অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির ভিত্তিতে যেন আঘাত না লাগে Sourced by the ABP
কোনও বিদেশি মুদ্রার পরিবর্তে টাকার মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক লেনদেন করার উদ্দেশ্যে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ করল কেন্দ্রীয় সরকার। মার্চ মাসে কেন্দ্রীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রী ভাগবত কৃষ্ণরাও করাড রাজ্যসভায় জানালেন যে, ১৮টি দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে টাকার মাধ্যমে পাওনা মেটানোর ব্যবস্থা তৈরি করেছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক।
টাকার অঙ্কে বৈদেশিক বাণিজ্যের পাওনা মেটানোর কথা প্রথম উঠেছিল যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর পশ্চিমি দেশগুলি রাশিয়ার উপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করল। আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সুইফ্ট ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ— যুদ্ধের সূচনাতেই সাতটি রুশ ব্যাঙ্ককে এই ব্যবস্থা থেকে ছেঁটে ফেলায় রাশিয়ার সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্য চালিয়ে নিয়ে যেতে ভিন্নতর পথের প্রয়োজন পড়ল। বিশেষত রাশিয়ার দীর্ঘ দিনের বাণিজ্যসঙ্গী ভারতের, কারণ সামরিক সরঞ্জাম ছাড়াও পেট্রোলিয়াম ও সার আমদানির ক্ষেত্রে ভারত রাশিয়ার উপরে খুবই নির্ভরশীল। কাজেই ভারত সোভিয়েট আমলের টাকা-রুবল বাণিজ্যচুক্তির পথে হাঁটল। ২০২২-২৩ সালে এই লেনদেনের উপর নির্ভরশীলতা আরও বাড়ল, কারণ ভারত সস্তা রুশ পেট্রোলিয়াম আমদানির পরিমাণ বাড়াল— ভারতের মোট অপরিশোধিত তেল আমদানির ১৮ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকেই।
২০২২ সালের জুলাই মাসে ভারতীয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক এই পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে ভারতীয় টাকায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পাদন সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করল। শুধু বাণিজ্যিক পাওনাগন্ডা মেটানোর কাজেই নয়, এই বিজ্ঞপ্তিতে টাকার অঙ্কে আন্তঃসীমান্ত লেনদেনের কথা বলা হল। যে কোনও দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক পাওনাগন্ডা মেটানোর জন্য ভারতে অথরাইজ়ড ডিলার (এডি) ব্যাঙ্ককে অধিকার দেওয়া হল, বাণিজ্যসঙ্গী দেশের ব্যাঙ্কের স্পেশাল রুপি ভস্ট্রো অ্যাকাউন্ট (এসআরভিএ) খোলার। এই ব্যবস্থার ফলে, ভারতীয় আমদানিকারকরা আমদানির মূল্য এই অ্যাকাউন্টে ভারতীয় টাকার অঙ্কে জমা করতে পারবেন, এবং ভারতীয় রফতানিকারকরা বাণিজ্যসঙ্গী দেশের ব্যাঙ্কে এসআরভিএ অ্যাকাউন্টে টাকার অঙ্কেই পাওনা বুঝে নেবেন। ২০২৩ সালে ঘোষিত বৈদেশিক বাণিজ্য নীতিতে এই ব্যবস্থাকে সমর্থন করে জানানো হয়েছে যে, টাকার অঙ্কে রফতানির মূল্য পেলেও রফতানিকারকরা সংশ্লিষ্ট প্রণোদনাগুলি পাবেন।
লক্ষণীয় যে, অ্যাকাউন্টে থাকা উদ্বৃত্ত টাকা ভারতে মূলধনি খাতে এবং চালু খাতার লেনদেনের কাজে ব্যবহার করা যাবে। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রকল্পে লগ্নি, সরকারি ট্রেজ়ারি বিল এবং সরকারি সিকিয়োরিটিজ়-এ লগ্নিও। অর্থাৎ, কোনও বিদেশির যদি ভারতে ভারতীয় টাকায় সম্পদ থাকে, তবে তিনি সেই টাকা সরাসরি ভারতীয় সম্পদে লগ্নির কাজে ব্যবহার করতে পারবেন।
২০২২-এর দ্বিতীয়ার্ধে টাকার তাৎপর্যপূর্ণ অবমূল্যায়ন ঘটায় টাকার অঙ্কে বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেন মেটানোর গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পেল। টাকার মূল্য হ্রাস পেল দু’টি কারণে— এক, অতিমারিজনিত আর্থিক মন্দা থেকে ভারতীয় অর্থব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই আমদানির চাহিদা বাড়ল, ফলে বাণিজ্যখাতে ঘাটতির পরিমাণও বৃদ্ধি পেল; অন্য দিকে, মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে কঠোর মুদ্রানীতি গ্রহণ করে আমেরিকার ফেডারাল রিজ়ার্ভ পর পর সুদের হার বাড়াতে থাকায় ভারত থেকে ফরেন পোর্টফোলিয়ো ইনভেস্টমেন্ট বেরিয়ে গেল।
ভারতীয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক টাকার অঙ্কে বৈদেশিক লেনদেনের কাজে আগ্রহী হওয়ার পর ১৮ দেশের বিভিন্ন ব্যাঙ্ক ভারতে টাকার অঙ্কে এসআরভিএ খোলার অনুমতি পেয়েছে। ৬০টি ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভারতীয় ও বৈদেশিক এডি ব্যাঙ্ক বৎসোয়ানা, ফিজি, জার্মানি, গায়ানা, ইজ়রায়েল, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, মরিশাস, মায়ানমার, নিউ জ়িল্যান্ড, ওমান, রাশিয়া, সেশেলস, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, তানজ়ানিয়া, ইউগান্ডা ও ব্রিটেনের বিভিন্ন ব্যাঙ্কের এসআরভিএ খোলার অনুমতি পেয়েছে। মালয়েশিয়ার সঙ্গে টাকার অঙ্কে লেনদেনের ব্যবস্থাটি চালু হয় এপ্রিলের গোড়ার দিকে, যখন মালয়েশিয়ার ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল ব্যাঙ্ক ভারতে ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে এসআরভিএ খোলে।
উল্লেখ্য যে, টাকার অঙ্কে বৈদেশিক লেনদেন বিষয়ে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অন্তত গত এক দশক ধরে ভাবনাচিন্তা করছে। ২০১৩ সালে ব্যাঙ্কের তৎকালীন গভর্নর রঘুরাম রাজন বলেছিলেন যে, ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আয়তন বৃদ্ধি পেলে টাকার অঙ্কে আরও বেশি লেনদেনের চাহিদাও বাড়বে। ২০২১ সালে ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অন কারেন্সি অ্যান্ড ফাইনান্স-এ এই প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়— রিপোর্ট আশাবাদী ছিল যে, “ভারতীয় টাকা আন্তর্জাতিক লেনদেনের মুদ্রা হয়ে উঠবে, তা নিশ্চিত।” রিপোর্টে বলা হয়, টাকার অঙ্কে আরও বেশি বৈদেশিক লেনদেন হলে তা আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য ও লগ্নির ক্ষেত্রে টাকার বিনিময়মূল্যজনিত অনিশ্চয়তা দূর করে লেনদেন সংক্রান্ত ব্যয়ের পরিমাণ হ্রাস করবে।
টাকার মাধ্যমে বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেন মেটালে অন্তত দুটো সুবিধা। প্রথমত, এর মাধ্যমে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা টাকার বিনিময় হার সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পাবেন। তার ফলে বাণিজ্যের ব্যয় কমতে পারে, এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় পণ্য আরও বেশি প্রতিযোগিতার যোগ্য হয়ে উঠতে পারে। দ্বিতীয়ত, ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের একটা বড় অংশ যদি টাকার মাধ্যমে হয়, তবে দেশে বিদেশি মুদ্রার ভান্ডারে অনেক কম আন্তর্জাতিক মুদ্রা রাখার প্রয়োজন হবে।
এই সুবিধাগুলি সত্ত্বেও টাকার অঙ্কে বৈদেশিক লেনদেনের পথে বেশ কিছু বাধা রয়েছে। প্রথমত, টাকার মাধ্যমে বাণিজ্যের চুক্তি বাস্তবায়ন করা খুব সহজ নয়। বস্তুত, রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের চুক্তিটিই— দু’দেশের মধ্যে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা আলোচনা সত্ত্বেও— এখনও সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়নি। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন এখনও সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো তৃতীয় দেশের মাধ্যমে চলছে। এই প্রক্রিয়াটিতে অন্যতম বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের বিপুল বাণিজ্যিক ঘাটতি— টাকার অঙ্কে এই ঘাটতি বজায় রাখার অর্থ, রাশিয়ার বিপুল সম্পদ ভারতীয় টাকায় আটকা পড়ে থাকবে। পূর্ববর্তী জমানায় টাকা-রুবল বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এটি এক বাস্তব অসুবিধা ছিল— বস্তুত, টাকার অঙ্কে নিজেদের আটকে পড়া পুঁজিকে সম্পূর্ণ নগদে রূপান্তরিত করতে রাশিয়ার সময় লেগেছিল দেড় দশকেরও বেশি।
দ্বিতীয় সমস্যা সম্বন্ধে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক বিশেষ ভাবে অবহিত। ভারতীয় মুদ্রার আন্তর্জাতিকায়ন ঘটলে একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে বিনিময় মূল্যে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে, এবং অভ্যন্তরীণ আর্থিক বাজারের কথা মাথায় রেখে মুদ্রানীতি স্থির করতে হবে— এই যুগপৎ চ্যালেঞ্জ সামলানো নেহাত মুখের কথা নয়। এ কাজ তখনই সম্ভব, যখন অভ্যন্তরীণ আর্থিক বাজারটি আন্তর্জাতিক ধাক্কা সামলানোর মতো বড় এবং গভীর হবে। টাকার আন্তর্জাতিকায়ন হলে যে-হেতু ভারতীয় এবং অ-ভারতীয়, দুই গোত্রের লগ্নিকারীই টাকার অঙ্কে আর্থিক সম্পদ কেনাবেচা করতে পারবেন, ফলে অভ্যন্তরীণ আর্থিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে দেশের বাজারে নগদের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা, এবং সুদের হার সামলানোর কাজটি কঠিনতর হবে।
এবং, কার্যকর আন্তর্জাতিকায়নের জন্য সরকারকে দেশি এবং বিদেশি, উভয় গোত্রের লগ্নিকারীর জন্যই দেশের মুদ্রা কেনা-বেচার ক্ষেত্রে— সেটা স্পট মার্কেটেই হোক বা ফরওয়ার্ড মার্কেটে— বাধানিষেধ সম্পূর্ণ তুলে নিতে হবে। এর ফলে টাকার সঙ্গে বিদেশি মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে কার্যত কোনও বাধা থাকবে না। ভারতে একাধিক সরকার দীর্ঘ দিন ধরে এই পথে হাঁটতে দ্বিধা বোধ করেছে, যাতে বৈদেশিক আর্থিক সঙ্কট সরাসরি ভারতে প্রবেশ করতে না পারে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে চিনই একমাত্র, যারা মূলধনি খাতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেই দেশের মুদ্রার সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিকায়ন ঘটাতে পেরেছে। তা সম্ভব হয়েছে দু’টি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। প্রথমত, পিপল’স ব্যাঙ্ক অব চায়না ৪৩টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সঙ্গে কারেন্সি সোয়াপ চুক্তি সম্পাদন করেছে— এটি দুই কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের মধ্যে মুদ্রা বিনিময়ের চুক্তি, যার মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায় যে, বাজারে কখনও রেমনিবির অতি-জোগানের পরিস্থিতি তৈরি হবে না। দ্বিতীয়ত, চিন এমন এক বৈদেশিক বাজার তৈরি করতে পেরেছে, যেখানে বিদেশি লগ্নিকারীরা রেমনিবি বিক্রি করে পরিবর্তে ডলার কিনতে পারেন।
কাজেই, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক টাকার আন্তর্জাতিকায়নের কথা ভাবলে সতর্কতা জরুরি, যাতে সেই প্রক্রিয়ায় অভ্যন্তরীণ অর্থব্যবস্থার ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।