৪ শতাংশ হারে মুদ্রাস্ফীতির কথা ভুলে গিয়ে প্রস্তাবিত আয়বৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণে সচেষ্ট হওয়া তার চেয়ে সাময়িক ভাবে অন্তত শ্রেয়তর পরিস্থিতি। প্রতীকী ছবি।
জার্মান কবি-ঔপন্যাসিক হারম্যান হেস তাঁর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির (১৯৪৬) আগে ১৯৪৩ সালে ‘ম্যাজিস্টার লুডি’ (ইংরেজিতে ‘মাস্টার অফ দ্য গেম’) নামে এক উপন্যাস প্রকাশ করেন। বইটির আর একটি নাম ‘দ্য গ্লাস বিড গেম’ সে ভাবে ব্যাখ্যাত হয়নি। উপন্যাসটির পটভূমিকা ভবিষ্যতের কোনও এক সময়, উপন্যাসের ঘটনা ঘটছে এমন এক স্থানে, যা ‘লাইফ অফ মাইন্ড’ বা ‘মানসিক জীবৎকাল’-এর প্রতি উৎসর্গীকৃত। উপন্যাসের কুশীলব এমন এক খেলায় রত, যার নিয়মাবলি যেন প্রহেলিকাময়, খেলায় অংশগ্রহণকারীদের বছরের পর বছর সঙ্গীত, গণিত এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাসের মতো পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্করহিত বিষয়ের চর্চা চালিয়ে যেতে হয়। তারা এদের মধ্যেকার অন্তর্নিহিত সম্পর্ক খুঁজে পায় এবং সেই সন্ধান তাদের খেলাটি আরও দক্ষতার সঙ্গে খেলতে সাহায্য করে। পুরো বিষয়টি খানিক উদ্ভট, অনেকটা আর্থিক নীতির মতোই। যে বিষয়ে আমরা এখন আলোচনা করতে চলেছি।
সেই সব স্বাধীন ব্যাখ্যাকর্তাদের কথা ভাবুন, যাঁরা প্রায় ঐক্যমত হয়ে আশা করেছিলেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আর্থিক নীতি নির্ধারণকারী কমিটি গত বৃহস্পতিবার ‘ওভারনাইট মানি’ (সেই সব ঋণদানকারী সংস্থা যারা এক দিনের মেয়াদের কোনও সিকিউরিটি বা অ্যাসেটে টাকা লগ্নি করে)-র উপর এক-চতুর্থাংশ পার্সেন্টেজ পয়েন্ট বাড়ানোর কথা ঘোষণা করতে চলেছিল। কিন্তু কমিটি আচমকা প্রায় একতরফা ভাবেই সিদ্ধান্ত নেয় যে, হারের বৃদ্ধি ঘটানো হবে না। তা অপরিবর্তিত থাকবে। মুদ্রাস্ফীতি কঠোর ভাবে ‘আপার টলারেন্স লিমিট’ (এক বিশেষ পরিসংখ্যানের উপর নির্ভর করে তৈরি সীমা, যা প্রেক্ষিতের উপরেও নির্ভর করে)-এর ৬ শতাংশের উপরে অবস্থান করছে— এমন এক ভাবনার দ্বারা ব্যাখ্যাকর্তারা প্রভাবিত হন এবং আইনের বাধকতা মেনে নেন। অন্য দিকে, কমিটি আবার অদূর ভবিষ্যতে মুদ্রাস্ফীতি ৫ শতাংশ কমবে বলে ধরে নেয়।
এ কথা মনে রাখতে হবে যে, আইনি বাধকতার নিরিখে মুদ্রাস্ফীতির হার ৪ শতাংশ। উভয় দিকে আবার যার ২ শতাংশ পয়েন্ট প্রসারিত থাকে। কমিটি এক বছর পরেও মুদ্রাস্ফীতি ৪ শতাংশে আটকে থাকবে বলে আশা করে না। তা সত্ত্বেও নীতিগত ভাবে কমিটি হারের বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে অনড় ছিল। এই অনড়ত্বের কারণ এই নয় যে, তা অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ঝুঁকির কথা বলে। কার্যত নতুন আর্থিক বছরে বৃদ্ধি সম্পর্কে তার ধারণাকে সে ৬.৫ শতাংশে দেখেছিল। এই পরস্পর-বিরোধী সঙ্কেত থেকে কিন্তু ব্যাখ্যাকর্তারা তাঁদের সামনে হারম্যান হেসের উপন্যাসে বর্ণিত ‘ম্যাজিস্টার লুডি’-কে ক্রিয়াশীল দেখেও সংযত থাকতে পারেননি।
এই যদি বিশেষজ্ঞদের চিন্তাভাবনার দৌড় হয়ে থাকে, তা হলে কেউ এ কথা বলতে ব্যগ্র হয়ে পড়তেই পারেন যে, এই বিশেষ খেলাটি আসলে লুডোর চেয়ে পরিশীলিত কিছু নয়। লুডোর অনিশ্চয়তা এখানেও দৃশ্যমান। খেলোয়াড়, বিশেষজ্ঞ— সকলের পরিমিতিবোধই কিন্তু কমবেশি খেলার যুক্তি আবিষ্কারের উপরেই নির্ভরশীল থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের ব্যাঙ্কারদের সাম্প্রতিক আচরণের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, কম মুদ্রাস্ফীতি-সম্পন্ন দেশগুলিতে তাঁরা দিশাহারা রকমের মুদ্রাস্ফীতিকে দায়ী করছেন। পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আর্থিক নীতিকে আচমকাই ঘুরিয়ে নিয়েছেন। এ থেকে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থায় এক ক্ষণভঙ্গুরত্ব দেখা দেয়। প্রকৃতপক্ষে যেখানে অভিজ্ঞদের উপস্থিতি কাম্য ছিল, সেখানে সাধারণ এক দর্শক কুখ্যাত এক ব্রেক্সিটপন্থীর সুরে বলে উঠতেই পারেন, “... যথেষ্ট বিশেষজ্ঞপনা দেখা গিয়েছে।”
তখনকার মতো এখনও আবেগে ঘাটতি নেই। বিশেষজ্ঞ নন, এমন ব্যক্তিদের দ্বারা নীতি নির্ধারণ করে ভারত ঠিক কী করতে চেয়েছে, তা সবিশেষ বোঝা যায় না। প্রকৃত ঘটনা এমনও হতে পারে যে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তার নিজের তৈরি বাধকতাতেই আর সায় দিল না এবং নির্বাচনের আগের বছরে সরকার নীরবে এই নির্জ্ঞান অবস্থানকে সমর্থন করে বসল। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যে পদক্ষেপগুলি আগে করা দরকার ছিল অথবা অর্থনীতির বৃদ্ধিকে একটি সম্পূরক উদেশ্য বলে স্বীকৃতি দেওয়ার লক্ষণ কিন্তু সরকারের তরফে দেখা যায়নি। অগ্রাধিকারের তালিকার এহেন বিপরীত গতিকে আর্থিক নীতি সংক্রান্ত কমিটির আচরণের একমাত্র ও তর্কাতীত ব্যাখ্যা বলে ধরে নেওয়াই যায়। যদি অন্য রকম হত, তা হলে গত বৃহস্পতিবার কমিটি অপেক্ষাকৃত ধীরগতির অথচ এখনও পর্যন্ত কার্যকর বৃদ্ধির স্বপক্ষে পলিসি রেট বাড়াত।
কিন্তু আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি মাথায় রাখতে হবে। গত সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে মাথাপিছু আয়ে গড়ে মাত্র ২ শতাংশ বৃদ্ধি দেখা গিয়েছে। গত ছ’মাসে তা ৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। নতুন আর্থিক বছরে তা ৫ শতাংশে দাঁড়াবে বলে জানানো হচ্ছে। যখন দেশীয় অর্থনীতির গতিছন্দ সংক্রান্ত লক্ষণ ধীরগতির বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে থাকে, বিবর্ধিত উচ্চতর সুদের হারের সঙ্গে সহজে তাল রেখে চলতে পারে না, তখন এটি এক প্রকার অনুজ্ঞা হিসেবে দেখা দেয়। ৪ শতাংশ হারে মুদ্রাস্ফীতির কথা ভুলে গিয়ে প্রস্তাবিত আয়বৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণে সচেষ্ট হওয়া তার চেয়ে সাময়িক ভাবে অন্তত শ্রেয়তর পরিস্থিতি।
নীতিগত বাধকতার বিষয়টির দিকে তাকালে প্রশ্ন জাগতেই পারে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে সরকারের তরফে কি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বেঁধে দেওয়া উচিত নয়? এ বিষয়ে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন যে, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কি আদৌ ব্যাঙ্কের রয়েছে? সেই সঙ্গে ঠিক কতগুলি বিষয় ব্যাঙ্কের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে, সে প্রশ্নও উঠতে পারে। কিন্তু এ ধরনের প্রশ্ন তোলা আর্থিক নীতি নির্ধারণ কমিটির এক্তিয়ারের বাইরে। সুতরাং আমাদের হাতে যা থাকছে, তা সম্ভবত আইনে উল্লিখিত বিধিসম্মত অবস্থান আর নীতি-নির্ধারকদের প্রকৃত অবস্থানের মধ্যেকার ফারাকটুকুই। তার বেশি কিছু নয়।