উল্লসিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। লোকসভা ভোটের ফলপ্রকাশের পরে আরএসএসের সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত বেশ কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দেওয়ার পরে যাঁরা আনন্দ পেয়েছেন, তাঁদের কথা হচ্ছে। তাঁরা হয়তো ভাবছেন, নরেন্দ্র মোদী খানিকটা দুর্বল হতেই আরএসএস সুযোগ পেয়ে হাতে চাবুক তুলে নিল। বাস্তবে আহ্লাদিত হওয়ার মতো কিছু হয়নি। কারণ ‘ব্র্যান্ড হিন্দুত্ব’-এর ধ্বজাধারী নরেন্দ্র মোদীকে এখনও আরএসএসের প্রয়োজন।
মোহন ভাগবত সম্ভবত আরএসএসের একমাত্র সরসঙ্ঘচালক, যিনি খোলাখুলি স্বীকার করেছিলেন যে বিজেপির সভাপতি কে হবেন, তা তাঁরাই ঠিক করেন। দশ বছর আগে, ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের আগে লালকৃষ্ণ আডবাণীর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও আরএসএস সরসঙ্ঘচালক হিসেবে মোহন ভাগবতই বিজেপির ব্যাটন নরেন্দ্র মোদীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তাঁর স্পষ্ট মত ছিল, হিন্দুত্বই বিজেপিকে ভোটে জেতায়। রামজন্মভূমি, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, কাশ্মীরে ৩৭০ রদের দাবিই বিজেপিকে শক্ত ভিতের উপরে দাঁড় করিয়েছে। এ বার বিজেপির মূল ভোটব্যাঙ্ক মজবুত করে দলের ক্যাডারদের চাঙ্গা করতে নরেন্দ্র মোদীকে প্রয়োজন।
আগামী বছর আরএসএস শতবর্ষে পা দিচ্ছে। গত দশ বছরে নরেন্দ্র মোদী আরএসএসের মতাদর্শগত লক্ষ্য ও হিন্দুত্বের পথ থেকে সরেননি। রামমন্দির, ৩৭০ রদ, তিন তালাক নিষিদ্ধ করা, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে রাজ্য স্তরে আলোচনা শুরু, নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন হয়েছে। এ কথা ঠিক, মোদীর সরকারে আরএসএস সেই ভাবে ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ পায়নি। যেমনটা অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায় হত। কিন্তু আরএসএসের প্রাক্তন প্রচারক নরেন্দ্র মোদীর রাজত্বে শতবর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা আরএসএসের সংগঠন, প্রভাব, প্রতিপত্তি যে পরিমাণে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে, তা গত ৯৯ বছরে হয়নি।
তবু তৃতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরে নরেন্দ্র মোদী যখন নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে দফতর বণ্টনে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময়ই বেছে বেছে মোহন ভাগবত কিছু বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সত্যিকারের সেবক হতে গেলে অহঙ্কার থাকলে চলবে না। বিরোধীদের বিরোধী পক্ষ নয়, শুধুমাত্র প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখতে হবে। সংসদে দুই পক্ষই থাকবে। দু’দিকের মতামতই শুনতে হবে।
বার্তা যে নরেন্দ্র মোদীর জন্য, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কারণ আরএসএসের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর কর্মপদ্ধতিতে একটা মূলগত সংঘাত বরাবরই রয়েছে। তা হল, ব্যক্তিপুজো বা ব্যক্তিসত্তা-নির্ভর রাজনীতি। আরএসএস কোনও দিনই এতে বিশ্বাস করে না। আর নরেন্দ্র মোদী এর ঠিক বিপরীত পথে চলেন। ২০১৪-য় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেই তিনি বলেছিলেন, এ দেশের মানুষ বরাবরই নির্বাচনে কোনও ব্যক্তির উপরে আস্থা রেখে ভোট দেয়। সরকারে কে নেতৃত্ব দেবেন, তা স্পষ্ট বুঝে নিতে চায়। দল নয়, মানুষ ব্যক্তির নাম জানতে চায়। এ বার মানুষের বিশ্বাস ছিল, মোদীই একমাত্র ভরসা।
অর্থাৎ, নরেন্দ্র মোদী বিজেপিকেও নয়, শুধু নিজেকেই ২০১৪-র জয়ের কৃতিত্ব দিতে চেয়েছিলেন। ২০১৯-এও তাই হয়েছে। নরেন্দ্র মোদী এ বারেও ‘মোদীর গ্যারান্টি’-তেই বাজি ধরেছিলেন। ফারাক হয়েছে অন্য জায়গায়। যে আরএসএসের কর্মীরা এত দিন মোদীর বার্তা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন, তাঁরা এ বার নিষ্ক্রিয় থেকেছেন। যে আরএসএস এত দিন একশো শতাংশ ভোটদান নিশ্চিত করতে সক্রিয় থেকেছে, তারা এ বার ঘরে বসে থেকেছে। কারণ নরেন্দ্র মোদীর জমানায় আরএসএসের নিচুতলার কর্মীদের কোনও সুবিধা হয়নি। বছরের পর বছর আরএসএস কর্মীরা নীরবে কাজ করে মতাদর্শগত সমর্থনের ভিত গড়েছেন। মানুষকে হিন্দুত্বের পাঠ পড়িয়ে মোদী জমানার পৃষ্ঠভূমি তৈরি করেছেন। মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পরে তাঁরা টের পেয়েছেন, তাঁদের কোনও সুবিধা হচ্ছে না। কোনও কাজ নিয়ে গেলে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। বিতৃষ্ণা, উদাসীনতা জন্মেছে। উত্তরপ্রদেশ-সহ হিন্দি বলয়ে বিজেপির শক্ত ঘাঁটিতে ভোটের সময় মাটিতে কান পাতলে এ কথা শোনা গিয়েছে। এ বার বিজেপির চার ভাগের এক ভাগ প্রার্থীই ছিলেন অন্য দল থেকে আসা। যাঁদের সঙ্গে আরএসএসের কোনও যোগাযোগই নেই। নির্বাচনে উগ্র জাতীয়তাবাদ বা হিন্দুত্বের আবেগের প্রশ্নও ছিল না। তার মধ্যে আরএসএসের সংগঠন নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার ফলে ভোট পড়েছে কম। মোদীর বার্তাও ঠিকমতো পৌঁছয়নি।
এখানেই আরএসএস নিজের ‘প্রয়োজনীয়তা’ বুঝিয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের মধ্যেই বিজেপির জাতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নড্ডা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এখন বিজেপি নিজেই নিজেকে চালাতে পারে। শুরুতে হয়তো বিজেপি অক্ষম ছিল। “এখন বিজেপির বহর বেড়েছে। বিজেপি এখন সক্ষম। বিজেপি নিজেই নিজেকে চালায়।” নড্ডা বলেছিলেন, আরএসএস বিজেপিকে মতাদর্শের দিশা দেখায় ঠিকই, কিন্তু বিজেপি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজের মতো চলে। লোকসভা ভোটে আরএসএস বিজেপির সভাপতিকে ভুল প্রমাণিত করেছে। স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে, নরেন্দ্র মোদীকে এখনও আরএসএসের প্রয়োজন ঠিকই, কিন্তু বিজেপিরও আরএসএস-কে প্রয়োজন। এর মধ্যে অন্তর্নিহিত বার্তা হল, ভবিষ্যতে বিজেপি সভাপতি পদে নড্ডার উত্তরাধিকারী কে হবেন, বা নরেন্দ্র মোদীর উত্তরসূরি হিসেবে বিজেপির পরবর্তী প্রজন্মের নেতাদের মধ্যে কে উঠে আসবেন, তা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘই ঠিক করবে। ঠিক যে ভাবে মোহন ভাগবত ২০১৪-র লোকসভা ভোটের আগে লালকৃষ্ণ আডবাণীর কেরিয়ারে ইতি টেনে দিয়ে নরেন্দ্র মোদীকে তুলে এনেছিলেন।
নরেন্দ্র মোদী আপাতত নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। হতে পারে, বিজেপি এ বার একার জোরে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। মোদীকে তাই এনডিএ-র দুই শরিক, চন্দ্রবাবু নায়ডু ও নীতীশ কুমারের উপরে একটু বেশিই নির্ভর করতে হচ্ছে। ‘মোদী সরকার’ না বলে ‘এনডিএ সরকার’ বলতে হচ্ছে। তবে নীতীশ বা নায়ডুর থেকে মোদীর এখনই কোনও বিপদ নেই। বিজেপি যদি নীতীশকে আগামী বছর বিহারের ভোটে ফের এনডিএ-র মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে, জেডি(ইউ) প্রধান তাতেই খুশি থাকবেন। অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে ফেরা চন্দ্রবাবু নায়ডু এখন বেশি চিন্তিত রাজ্যের ঋণের বোঝা ও নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করার দিকে, যাতে তিনি তাঁর ছেলেকে শক্তপোক্ত সিংহাসনে বসিয়ে দিতে পারেন। খুব বেশি হলে ২০২৯-এর লোকসভা ভোটের আগে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক নিয়মে তৈরি অসন্তোষ থেকে গা বাঁচাতে নীতীশ-নায়ডু দূরত্ব তৈরি করতে পারেন। তার আগে নয়। ফলে যাঁরা ভাবছেন, যে কোনও দিন নীতীশ বা নায়ডু সমর্থন তুলে নেবেন আর মোদী সরকারের পতন হবে, তাঁদেরও উল্লসিত হওয়ার কারণ নেই।
নরেন্দ্র মোদীর বিপদ হতে পারে অন্য জায়গায়। তাঁর আসল পরীক্ষা চলতি বছরের শেষে মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড, হরিয়ানা এবং আগামী বছরের শেষে দিল্লির বিধানসভা ভোট। এই সব রাজ্যের বিধানসভা ভোটেও যদি ‘মোদী ম্যাজিক’ কাজ না করে, বিজেপি ভাল ফল করতে না পারে, তা হলে আরও স্পষ্ট হবে, নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তা কমছে। আগামী বছরই ১৭ সেপ্টেম্বর নরেন্দ্র মোদী পঁচাত্তরে পা দেবেন। পঁচাত্তরে পা দিলে মার্গদর্শক মণ্ডলীতে চলে যাওয়ার নিয়ম নরেন্দ্র মোদী নিজেই ঠিক করেছেন।
মোহন ভাগবতের বাবা মধুকর ভাগবতও আরএসএস প্রচারক ছিলেন। তিনিই গুজরাতে আরএসএসের শাখা বিস্তারে অগ্রদূতের ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁর কাছে, তাঁর বাড়িতে থেকে নরেন্দ্র মোদীও আরএসএস প্রচারক হওয়ার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। সেই হিসেবে মোদী ও মোহন ভাগবত গুরুভাই। কারণ মোহন ভাগবতেরও হাতে খড়ি তাঁর বাবার কাছেই। তখন থেকেই নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তাঁর ছ’দিনের বড় মোহন ভাগবতের বন্ধুত্ব। এক জন এখন প্রধানমন্ত্রী, অন্য জন সরসঙ্ঘচালক।
মোহন ভাগবত নিশ্চিত ভাবে চাইবেন, আগামী বছর যখন আরএসএসের শতবর্ষ পালন হবে, তখন তাঁর বন্ধু নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বের সরকারই দেশের ক্ষমতায় থাকুক। কিন্তু আগামী বছর ১১ সেপ্টেম্বর ভাগবত যদি নিজেই পঁচাত্তরে পা দিয়ে সরসঙ্ঘচালকের পদ থেকে সরে দাঁড়ান, তা হলে তাঁর ছ’দিন পরে পঁচাত্তরে পা দেওয়া নরেন্দ্র মোদীর উপরেও চাপ তৈরি হতে পারে।
সে অবশ্য অনেক পরের কথা। আপাতত মোহন ভাগবত খানিক কড়া কথা বললেও নরেন্দ্র মোদীর চিন্তার কারণ নেই। কারণ মতাদর্শগত লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে তিনিই আরএসএসের ভরসা।