এ বারের ১৫ অগস্ট স্বাধীনতা উদ্যাপনের গতানুগতিক উপলক্ষ না হয়ে থেকে স্বাধীনতা ব্যাপারটা নিয়েই গভীর ভাবে ভাবাল। হয়তো তার প্রথম কারণ, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি। দ্বিতীয় কারণ, কলকাতাতেই আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে তরুণী চিকিৎসকের এমন নৃশংস হত্যা।
পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার ইতিহাস বড়ই জটিল! সেখানকার মানুষ কত বার যে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করল, স্বাধীনতা পেল, আর পেয়েও হারাল! ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে বাঙালি সামূহিক ভাবে আত্মঘোষণা করেছিল, পূর্ব বাংলাকে বাংলায় ধরে রাখার উদ্দেশ্যে। কেবল বঙ্গভঙ্গ রদের দাবি নয়, সেই আন্দোলনে বাঙালির স্বাধীনতাস্পৃহারও প্রথম স্পষ্ট ও ব্যাপক প্রকাশ। ১৯৪৭-এ কিন্তু বাংলার মুসলমানরা হিন্দুদের কাছ থেকে স্বাধীনতা চাইল, আর হিন্দুরা মুসলমানদের কাছ থেকে। তার পর আবার পূর্ব বাংলার মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের নিপীড়ক মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করল। ১৯৭১-এর সেই মুক্তিযুদ্ধের আকুলতা ছুঁয়ে গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতকেও।
কিন্তু দুই দেশের ‘কামারাদারি’-সহ স্বাধীনতার আকুতি ক’দিনই বা টিকল! নবজাত বাংলাদেশে অনেকেরই মনে হল, সেখানে ভারতীয়রা আসলে স্বার্থসিদ্ধির ধান্দা করছে। তার চেয়ে বড় কথা, সদ্য-স্বাধীন দেশে স্বাধীনতাটাই পড়ল সন্দেহের মুখে। ‘এক জাতি, এক প্রাণ, একতা’র আবেগ ঘুচে গেল। অনেক মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের পার্থিব স্বার্থসিদ্ধিতে মন দিলেন। কে মুক্তিযোদ্ধা আর কে রাজাকার তা নিয়েই বিভ্রান্তি তৈরি হল। আওয়ামী লীগের মধ্যেই বিভাজন, স্বজনপোষণ, দুর্নীতি। চার দিকে চুরি-জোচ্চুরি, কালোবাজারি। বিরোধী শক্তিকে জায়গা না দেওয়ায় সেনাবাহিনীর উত্থান। শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার অসততা, অপদার্থতাকে সামলাতে পারল না। ১৯৭৫-এ ভারতের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের মধ্যেই খবর এল, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের নায়ক শেখ মুজিবুর রহমান সেনার হাতে নিহত। সেই মুজিব, যাঁর শিহরন-জাগানো বক্তৃতা ‘এ বারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এ বারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ তখনও আমাদের কানে টাটকা!
এর পর কত বছর ধরে দুই বিপরীত মতাদর্শের জোয়ার-ভাটার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস বয়ে চলল। একটু সরলীকৃত করে বললে, এক দিকে ইসলামি আত্মপরিচয়ের প্রাধান্য, পাকিস্তান-প্রীতি, পাকিস্তানি মডেলে সামরিক শাসন, ভারতের প্রতি বিরূপতা। অন্য দিকে, বাঙালি আত্মপরিচয়ের প্রাধান্য, জাতীয়তাবাদী আবেগ, ভারত সম্পর্কে অনুকূল মনোভাব, গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের আকাঙ্ক্ষা। নব্বইয়ের দশকে গণতন্ত্র ফিরে এলেও র্যাডিক্যাল ইসলামের পুনরুত্থানও হল। তার পর গণতন্ত্রের মুখোশের আড়ালে ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচার। সাম্প্রতিক ছাত্র-আন্দোলন যখন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জয় ছিনিয়ে আনছিল আর আমাদের অনিবার্য ভাবে মনে করিয়ে দিচ্ছিল সেই ১৯৭১-এর তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের কথা, ঢাকার এক বন্ধু ফোনে বলল তার দুই পুত্র বিজয়-মিছিল থেকে সাত-তাড়াতাড়ি ফিরে এসে আক্ষেপ করেছে যে, তাদের জয় ‘হাইজ্যাকড’ হয়ে গেছে। স্বাধীনতা তা হলে অধরাই রয়ে গেল?
আমাদের দেশের ১৯৪৭-এর স্বাধীনতাও ভীষণ ভাবে প্রশ্নের মুখে পড়েছিল সেই সত্তরের দশকে। কিন্তু ‘সত্তরের দশক মুক্তির দশক’ ঘোষণা করে সে দিন যারা বিদ্রোহ করেছিল, সেই তরুণরাও কয়েক বছরের মধ্যেই দমিত হল। আবার মুজিবের পাশাপাশি আমাদের কাছে যিনি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সহনায়িকা হয়ে উঠেছিলেন, সেই ইন্দিরা গান্ধীর আরোপিত জরুরি অবস্থা ভারতবাসীর স্বাধীনতা হরণ করল। বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার এই সব পরিণতি আমরা দেখলাম চোখের সামনে। সত্যিই তো, একটা রাষ্ট্র স্বাধীনতা পেলেও দেশের ক’জন তার স্বাদ পায়! ব্যক্তিস্বাধীনতা কিসহজলভ্য? থাকবন্দি সমাজের তলার দিকের জনগোষ্ঠীগুলির স্বাধীনতা?
আর মেয়েদের স্বাধীনতা? মেয়েদের অবদমন তো সর্বদেশে সর্বকালে সত্যি। বলা হয়, সেই নতুন প্রস্তরযুগ থেকে পৌরুষ-আদর্শকে প্রাধান্য দিয়ে মেয়েদের অবদমনের ফলেই বিকৃত হয়ে উঠেছে সভ্যতার ইতিহাস: নারী-পুরুষ উভয়েরই লিঙ্গভূমিকা সম্পর্কে বিকৃত ধারণা, বাহুবলের ভিত্তিতে নির্মম আগ্রাসন, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, সমাজে উঁচু-নিচু ভেদের পীড়ন, প্রকৃতি-পরিবেশ থেকে অসংবেদী বিচ্ছিন্নতা। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, এ রকম মনোবিকারে ভোগে মাতৃহীন শিশুরা, উপরন্তু যাদের পিতা উদাসীন বা উৎপীড়ক স্বভাবের।
আমাদের এই সভ্যতাও যেন মাতৃহীন। বাংলাদেশের কথাই যদি বলি, শাহীন আখতারের তালাশ উপন্যাসে স্বাধীনতার বিড়ম্বনার সবচেয়ে বড় পরিচয় বহন করেন পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা নির্যাতিত সেই নারীরা যাঁদের পরে শেখ মুজিব ‘বীরাঙ্গনা’ বলে গৌরবান্বিত করেছিলেন। ক্রমে কিন্তু ‘বীরাঙ্গনা’ অভিধা তাঁদের কাছে ব্যঙ্গের শামিল হয়ে দাঁড়ায়। স্বদেশের মানুষ, এমনকি স্বীয় পরিবারও তাঁদের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ফেলে-যাওয়া বর্জ্য বলে মনে করে। আর আমাদের দেশে? মেয়েরা সোৎসাহে যোগ দিয়েছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে, কিন্তু স্বাধীনতার পর তাঁদের প্রান্তিকায়ন ইতিহাসবিদদের বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তার পর তো মেয়েদের অনেক লড়াই করে এগিয়ে আসা, কিন্তু চড়া দাম দিয়ে। এ বার দাম দিতে হল আরজি কর-এ। আর তারই প্রতিবাদে এ বারের স্বাধীনতা দিবসের ঠিক আগে মেয়েরা দলে দলে রাতের দখল নিতে গেলেন। কেবল দিনের নয়, রাতের স্বাধীনতারও দাবি তাঁদের। কিন্তু আরও কত দাম যে তাঁদের দিতে হবে, কে জানে!
স্বাধীনতা বুঝি এমনই এক অধরা মাধুরী? স্বাধীনতার মুহূর্ত এমনই ক্ষণস্থায়ী? আলো ফুটতে না ফুটতে অন্ধকার? তাই ফরাসি বিপ্লব পরিণতি পায় নেপোলিয়নে? মার্ক্সের মানবমুক্তির তত্ত্ব নিয়ে যায় দমনমূলক কর্তৃত্ববাদের দিকে?
মনস্তত্ত্ববিদ এরিক ফ্রমের ‘ফ্রিডম ফ্রম’ আর ‘ফ্রিডম টু’-র তত্ত্ব মনে পড়ে। ‘ফ্রিডম ফ্রম’ অর্থাৎ অত্যাচারী দখলদারের কাছ থেকে স্বাধীনতা যদি বা মেলে— ‘ফ্রিডম টু’ অর্থাৎ যে স্বাধীনতা মানুষকে নিজের ভাল লাগা, ভালবাসা, মৌলিক চিন্তা আর সৃজনশীলতা নিয়ে বাঁচার সুযোগ দেয়, যে স্বাধীনতা পারস্পরিকতা আর ন্যায়বোধের সঙ্গে যুক্ত, যে স্বাধীনতা কর্তৃত্বকে সব সময়ে সন্দেহ করে, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, সে স্বাধীনতা যে বড়ই দুর্লভ। ফ্রম বলেন, ‘ফ্রিডম টু’ না পেলে অনেক সময়ে মানুষ ফ্রিডম থেকেই পালাতে চায় (ফিয়ার অব ফ্রিডম), স্বৈরাচারী দাপুটে নেতার পায়ে নিজেকে সঁপে দিয়ে আরাম পেতে চায়। তেমন তেমন পরিস্থিতিতে কিন্তু বিদ্রোহও হয়। ১৪ অগস্ট রাতে যেমন মেয়েদের প্রতীকী বিদ্রোহ দেখলাম।
এই যে নিজের ভাল লাগা ভালবাসা নিয়ে নিজের আনন্দে বাঁচার স্বাধীনতা, একে ফরাসিতে বলে ‘আমু দ্য সোয়া’। আর এক রকম স্বাধীনতার কথাও কিন্তু ফরাসিতে আছে, ‘আমু প্রপ্র’। পার্থিব উন্নতির স্বাধীনতা। অন্যদের উপর দেখনদারি, দখলদারি আর দাপটের জন্য অর্থ-যশ-প্রতিপত্তি অর্জনের স্বাধীনতা। এটি জড়িত প্রতিযোগিতার মনোভাবের সঙ্গে, প্রায়শই যা হিংস্র হয়ে ওঠে। আজকের দুনিয়ায় রাজনীতিক, ব্যবসাদার ও অন্য মাননীয়দের দৌলতে এই স্বাধীনতার ধারণাটিই প্রবল। তাই স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সংবাদপত্রে পাতা জোড়া বিজ্ঞাপনে ‘একটা জিনিসের সঙ্গে একটা ফ্রি’র লোভ দেখিয়ে মানুষকে বাজারের দাস বানানো হয়। সেটাই যেন পরম ‘ফ্রিডম’।
তবু তো এ বারের অলিম্পিক্স দেখিয়ে দিল ‘আমু দ্য সোয়া’র দু’টি চমকপ্রদ দৃষ্টান্ত। জ্যাভলিন নিক্ষেপে রুপোর মেডেল পাওয়া নীরজ চোপড়ার মাকে জিজ্ঞেস করা হল, এই যে অল্পের জন্য ছেলে সোনা মিস করল, তাও এক পাকিস্তানির কাছে, এতে তাঁর খারাপ লাগছে না? তিনি উত্তর দিলেন, বাচ্চারা খেলা করবে, কেউ প্রথম হবে, কেউ দ্বিতীয়, এটাই তো স্বাভাবিক। আর তিনি তো আরশাদ নাদিমেরও মা। এই ভাবে তিনি অন্ধ বাৎসল্য আর সঙ্কীর্ণ দেশভক্তি থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন।
আর স্পেনের দৌড়বাজ আইভান ফার্নান্ডেজ আনায়া যখন দেখলেন যে তাঁর থেকে এগিয়ে গিয়েও কেনিয়ার এবেল মুতাই ফিনিশিং লাইনটা ঠিক বুঝতে পারছেন না, জিতে গেছেন ভেবে আগেই দাঁড়িয়ে পড়েছেন ফিনিশিং লাইনের সামনে, তিনি চেঁচামেচি করে মুতাইকে এগিয়ে যেতে বলেন। তাতেও মুতাই বুঝতে না পারলে ধাক্কা দিয়ে তাঁকে ফিনিশিং লাইনে ঠেলে দেন। আনায়াকে জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি নিজে প্রথম হওয়ার সুযোগটা এ ভাবে ছেড়ে দিলেন কেন। সরল উত্তর আসে, আমি তো ওটা ডিজ়ার্ভ করি না, মুতাই-ই তো আসল বিজয়ী। এই ভাবে আনায়া স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন— পার্থিব সাফল্যের সামাজিক চাপের হাত থেকে। আরও বললেন, ওকে বঞ্চিত করলে আমার মায়ের কাছে কী কৈফিয়ত দিতাম!
এই মায়েদের ন্যায়বোধ আর ভালবাসা যেন আমাদের হাত ধরে নিকষ কালো রাত থেকে দিনের পারাবারের দিকে নিয়ে যায়। আলো-আঁধারি মোহনায় আবছা একটু সোনার স্বাধীনতার দেখা পেয়ে কৃতার্থ হই।