কূটনীতির আড়ালে অর্থনীতি
Narendra Modi

ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের স্বার্থে আঘাত লাগবে, তাই নূপুরকে শাসন?

ভারতে মোট যত ভেজিটেবল অয়েল আমদানি করা হয়, তার ৪৫ শতাংশ আসে এই দু’টি দেশ থেকে।

Advertisement

বিশ্বজিৎ ধর

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২২ ০৬:০৫
Share:

বোঝাপড়া: আবু ধাবিতে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির প্রেসিডেন্ট ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। পিটিআই

পয়গম্বর বিষয়ে বিজেপির দুই মুখপাত্রের আপত্তিকর মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় যা যা ঘটল, তা বিভিন্ন দিক থেকে অভূতপূর্ব। ভারতের দীর্ঘ দিনের কূটনৈতিক সহযোগী আরব দুনিয়ায় সেই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে রীতিমতো ঝড় বইল। প্রথমে প্রতিক্রিয়া জানাল ওমান ও কুয়েত; তার কিছু দিনের মধ্যেই উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলি, এবং ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ইরান-সহ বেশ কিছু মুসলিমপ্রধান দেশ তাতে যোগ দিল। বিজেপি দুই মুখপাত্রের মধ্যে এক জনকে বহিষ্কার, এবং অন্য জনকে সাসপেন্ড করল, তাঁদের মন্তব্যের সঙ্গে দলের দূরত্বও তৈরি করল। কেন্দ্রীয় সরকার জোর দিয়ে বলল যে, তারা ‘সব ধর্মের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান পোষণ করে’— ভারতের ঘনিষ্ঠতম কূটনৈতিক সহযোগী দেশগুলিতেও যে ভারত-বিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছিল, তাকে প্রশমিত করতেই এমন সহিষ্ণুতার বার্তা।

Advertisement

শাসক দল এবং সরকার, দুই তরফেই এমন দ্রুত এবং কঠোর পদক্ষেপের কারণ কী? এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে বাণিজ্য এবং বিনিয়োগে। যে দেশগুলি বিজেপির মুখপাত্রদের মন্তব্যে চটেছিল, তাদের প্রতিটির সঙ্গেই ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক অতি গভীর। তার চেয়েও বড় কথা, ভারতের একাধিক বৃহদায়তন কর্পোরেট সংস্থার— প্রধানত আদানি এবং অম্বানীদের— বিশেষত গাল্ফ কোঅপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি) নামক অর্থনৈতিক জোটের সদস্য ছ’টি উপসাগরীয় দেশের দ্বিমুখী লগ্নির সম্পর্ক প্রবল। জিসিসি-র সদস্য দেশগুলি ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সহযোগী দেশের তালিকায় অন্যতম। ২০২১-২২ সালে এই দেশগুলির সঙ্গে ভারতের মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৫,৫০০ কোটি ডলার— ভারতের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের ১৫%। অন্য কোনও আঞ্চলিক বাণিজ্যগোষ্ঠীর সঙ্গে ভারতের এত বাণিজ্য হয়নি। বিশেষত সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক খুবই গভীর— এই দেশটি বহু দিন ধরেই ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানির কেন্দ্র। ভারতের সোনার গয়নার মোট রফতানির এক-চতুর্থাংশ যায় সংযুক্ত এই দেশে; মোবাইল ফোন রফতানির ২৯%, রেডিমেড গারমেন্টস রফতানির ১৮%। কিন্তু, জিসিসি-ভুক্ত দেশগুলির সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্কের কেন্দ্রে রয়েছে জ্বালানি। ভারতের মোট অপরিশোধিত তেল আমদানির ৪০% এবং পেট্রো-পণ্যের আমদানির ৬২% আসে এই দেশগুলি থেকে। তা ছাড়াও, দেশের মোট সার আমদানির এক-তৃতীয়াংশ আসে এই দেশগুলি থেকে।

অন্য যে দেশগুলি বিজেপির মুখপাত্রদের মন্তব্যে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে, তাদের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রীতিমতো জোরদার। ভারতে মোট যত ভেজিটেবল অয়েল আমদানি করা হয়, তার ৪৫ শতাংশ আসে এই দু’টি দেশ থেকে। তা ছাড়াও, ইন্দোনেশিয়া হল ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লার জোগানদার দেশ।

Advertisement

যে দেশগুলির কথা উল্লেখ করলাম, তাদের সঙ্গে ভারতের আর্থিক সম্পর্কের জোরের জায়গা হল অর্থনৈতিক সহযোগিতার চুক্তি— হয় সেই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, নয়তো অদূর ভবিষ্যতেই হওয়ার কথা। ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া, দুই দেশই অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথ ইস্ট এশিয়ান নেশনস (আসিয়ান)-এর সদস্য, যে জোটের সঙ্গে ভারতের সম্পূর্ণ কার্যশীল কমপ্রিহেনসিভ ইকনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (সিইপিএ) রয়েছে। এই চুক্তির ফলে ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আর্থিক সংযোগ বেড়েছে বহুলাংশে। সেই সম্পর্ক আরও দৃঢ়তর হওয়ার মুখে— ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া সম্প্রতি আমেরিকার নেতৃত্বে তৈরি হওয়া ইন্দো-প্যাসিফিক ইকনমিক ফ্রেমওয়ার্কে যোগ দিতে সম্মত হয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অবস্থিত ১৩ দেশের মধ্যে আর্থিক সংযোগ বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যেই সংগঠনটি তৈরি হয়েছে।

ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মধ্যেও ঘনিষ্ঠতর আর্থিক সম্পর্কের সূত্রপাত হয়েছে কমপ্রিহেনসিভ ইকনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট বা সিইপিএ স্বাক্ষরের মাধ্যমে। এই চুক্তিটির উদ্দেশ্য, দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করে তাকে পাঁচ বছরের মধ্যে অন্তত ১০,০০০ কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়া। এই চুক্তি অনুসারে, বস্ত্র, চর্মজাত দ্রব্য, জুতো, ওষুধ ও চিকিৎসাসংক্রান্ত যন্ত্রপাতি, গাড়ি-সহ বিভিন্ন পণ্যে ভারতের রফতানির পরিমাণ তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বাড়ার কথা। আমিরশাহির সঙ্গে সিইপিএ ভারতের কাছে অন্তত তিনটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এই দেশটি কেবলমাত্র মিডল ইস্ট অ্যান্ড নর্থ আফ্রিকা বা মেনা অঞ্চলের (পশ্চিম এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকা) প্রবেশপথই নয়, আফ্রিকার অন্যান্য অঞ্চলের বাণিজ্যিক পথও এই দেশ হয়েই যায়। ভারতের অন্যতম রফতানি পণ্য ওষুধের বাণিজ্যিক বণ্টনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে যে, ‘সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এক গ্লোবাল লজিস্টিক সেন্টার, যেখানে উন্নত মানের পরিবহণ ও পণ্য মজুত করার পরিকাঠামো রয়েছে’। ২০৩০ সালের মধ্যে ওষুধের ব্যবসায় সংযুক্ত আরব আমিরশাহি বৈশ্বিক ডিস্ট্রিবিউশন হাব হয়ে উঠতে চলেছে, এবং ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মতে, ওষুধ রফতানির জন্য নতুনতর বাজার ধরার ক্ষেত্রে এই দেশটি ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা করতে পারে।

জিসিসি-ভুক্ত দেশগুলির সঙ্গে ভারতের বিনিয়োগের সম্পর্কও সাম্প্রতিক কালে অনেকখানি বেড়েছে। ভারতের প্রায় সব বড় বাণিজ্যিক সংস্থাই এই দেশগুলির সঙ্গে হয় বিনিয়োগের চুক্তি করে ফেলেছে, বা করছে। উপসাগরীয় অঞ্চলে সভারেন ওয়েলথ ফান্ড ও অন্যান্য আর্থিক ক্ষেত্রের সঙ্গে বিনিয়োগের চুক্তি করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সক্রিয় আদানি গোষ্ঠী। রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ়, টাটা গোষ্ঠী এবং বিড়লারাও পিছিয়ে নেই। এই বাণিজ্যিক গোষ্ঠীগুলির অধিকাংশ লগ্নিই আসছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং সৌদি আরব থেকে। কাতারও ভারতের বেশ কিছু বাণিজ্যিক উদ্যোগে টাকা ঢালছে, তার মধ্যে শিক্ষাপ্রযুক্তি ক্ষেত্র অন্যতম।

মে মাসেই আবু ধাবির ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং কোম্পানির (আইএইচসি) সঙ্গে আদানি গোষ্ঠীর তিনটি সংস্থা পরিবেশবান্ধব জ্বালানি সংক্রান্ত প্রকল্পে লগ্নির চুক্তি পাকা করেছে। ভারতে উপসাগরীয় অঞ্চলের লগ্নিকারীদের বিনিয়োগের মধ্যে এটি অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে আইএইচসি যে ২০০ কোটি ডলার লগ্নি করছে, তাতে ভারতের পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির বাজারে আদানি গোষ্ঠীর অবস্থান সুদৃঢ় হবে।

এই মুহূর্তে আদানি গোষ্ঠী সৌদি আরবে অতি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক দরকষাকষি চালাচ্ছে। এই গোষ্ঠী সৌদি আরামকো এবং সে দেশের পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডে (পিআইএফ) অনেক ধরনের সহযোগ ও যৌথ উদ্যোগে ঢোকার চেষ্টা করছে। তার মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম তেল রফতানিকারক সংস্থা আরামকো-তে পিআইএফ-এর শেয়ারের কিছু অংশ কিনে নেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে। তারা আমিরশাহিতেও নিজেদের উপস্থিতি বাড়ানোর চেষ্টা করছে। আবু ধাবির পেট্রোকেমিক্যালস সংস্থা বরোগ-এর ২০০ কোটি ডলারের ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিংয়ে সাড়ে সাত কোটি ডলার লগ্নি করার সিদ্ধান্ত করেছে আদানি গোষ্ঠী। এই লগ্নির মাধ্যমে আদানি গোষ্ঠী নিজেদের মূল জোরের জায়গা জ্বালানি ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে অন্য দিকেও ডালপালা বিস্তার করতে চাইছে।

গত কয়েক বছরে আমিরশাহির দু’টি সভারেন বা রাষ্ট্রায়ত্ত ওয়েলথ ফান্ড আবু ধাবি ইনভেস্টমেন্ট অথরিটি (এডিআইএ) এবং মুবাডালা রিলায়েন্স গোষ্ঠীর জিয়ো প্ল্যাটফর্মে একত্রে ৩০০ কোটি ডলারেরও বেশি লগ্নি করেছে। জিয়োর ফাইবার-অপটিক সম্পদের অধিকারী সংস্থা ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্টেও (ইনভআইটি) এডিআইএ এবং সৌদি আরবের পিআইএফ একত্রে একশো কোটি ডলারের বেশি লগ্নি করেছে। ইনভআইটি-র ৫১% শেয়ার এই বিদেশি সংস্থাগুলির হাতে রয়েছে।

বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ওয়েলথ ফান্ড, বিশেষত উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলির, ভারতের পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ২০২১ সালে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সরকার জানিয়েছিল যে, তারা ভারতে, বিশেষত গ্রিন এনার্জি প্রকল্পে, মোট ৭৫০০ কোটি ডলার লগ্নি করবে। ২০২০-২১ থেকে ২০২৩-২৪ অবধি ভারতে লগ্নি থেকে ডিভিডেন্ড সুদ ও দীর্ঘমেয়াদি মূলধনি আয় হিসাবে এডিআইএ-র অধীনস্থ বিভিন্ন সংস্থা, সভারেন ওয়েলথ ফান্ড ও পেনশন ফান্ড যে টাকা উপার্জন করবে, তার উপর আয়করে ছাড় দেওয়া হবে, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী কথাটি ঘোষণা করার পরই এই লগ্নির কথা ঘোষণা করে আমিরশাহির সরকার।

মুসলমান-প্রধান দেশগুলির সঙ্গে, বিশেষত জিসিসি-ভুক্ত দেশগুলির সঙ্গে আর্থিক সম্পর্ক যে হেতু এতটাই গভীর, তাই নূপুর শর্মার বিতর্কিত মন্তব্যটির পরে দ্রুত কিছু ব্যবস্থা না করে উপায় ছিল না। ভারতের বাণিজ্যিক সহযোগী দেশগুলির ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত লাগলে তা সহ্য করা হবে না, এই বার্তাটি দেওয়া জরুরি ছিল।

সেন্টার ফর ইকনমিক স্টাডিজ় অ্যান্ড প্ল্যানিং, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, নয়াদিল্লি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement