এটাই ভারতীয় রাষ্ট্রের বিধান
Bilkis Bano

অপরাধীর ধর্ম দেখে শাস্তি ঠিক করবে আমাদের দেশ?

ভারতের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে বড় আকারের সংগঠিত অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়া ও শাস্তি পাওয়ার উদাহরণ খুব কম।

Advertisement

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০২২ ০৭:০০
Share:

১৫ অগস্ট ধর্ষকরা মুক্তি পেল। ৭৬তম স্বাধীনতা দিবসে লাল কেল্লার প্রাচীর থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন তাঁর পরিচিত নাটকীয় শৈলীতে নারীশক্তির বন্দনা করছেন, তখনই কুড়ি বছর আগে তাঁর রাজ্যে তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বকালের সবচেয়ে বড় কলঙ্কে আবার কালিমা লেপন করা হল। বিলকিস বানো গণধর্ষণ ও হত্যা মামলার এগারো জন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিতকে স্বাধীনতা দিবসে মুক্তি উপহার দিল গুজরাত সরকার।

Advertisement

ভারতের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে বড় আকারের সংগঠিত অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়া ও শাস্তি পাওয়ার উদাহরণ খুব কম। ভূমিহীন গরিবদের গণহত্যার প্রায় প্রতিটি মামলাতেই মূল অভিযুক্তরা তদন্তের দুর্বলতা ও প্রমাণের অভাবে ছাড় পেয়ে গিয়েছে। পুলিশ হেফাজতে হত্যা, পুলিশের গুলিতে হত্যা, রাষ্ট্রের দ্বারা সাজানো এনকাউন্টারে হত্যা ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ঘটনায় তদন্ত হওয়াই প্রায় অসম্ভব। আর সেনাবাহিনীর জন্য তো রয়েছে উপদ্রুত এলাকা আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের ঢাল। এ সত্ত্বেও গুজরাত গণহত্যার কয়েকটি নৃশংস অপরাধের ঘটনায় কিছু শাস্তি হয়েছিল। কিন্তু, সেটুকুও মুছে যাচ্ছে দ্রুত। বিলকিস বানোর ধর্ষক ও তাঁর শিশুকন্যা, মা ও বোন-সহ পরিবারের অন্য সদস্যদের ধর্ষক ও হত্যাকারীদের কারামুক্তির ঘটনা এই উল্টো রথের নির্লজ্জ তাজা উদাহরণ।

ন্যায়ের জন্য বিলকিসের নিরলস সংগ্রাম ভারতের গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক প্রেরণাদায়ী কাহিনি। গোধরা অগ্নিকাণ্ডের পর হিংসার আগুন ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সপরিবার বিলকিস ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পালিয়ে যান। গর্ভে পাঁচ মাসের সন্তান, সঙ্গে তিন বছরের শিশুকন্যা-সহ যৌথ পরিবার। কিন্তু তিন দিনের মাথায় আক্রমণের মুখে পড়ে বিলকিসের পরিবার। ধর্ষণ ও হত্যার তাণ্ডব শেষে বেঁচে যান শুধু বিলকিস এবং একটি শিশু ও এক জন পুরুষ। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই শুরু হয় বিলকিসের লড়াই। লিমখেড়া থানায় প্রাথমিক অভিযোগ দায়ের করার পর ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও সর্বোচ্চ আদালতের সহানুভূতিশীল ও সদর্থক হস্তক্ষেপে বিলকিসের আর্জির শুনানি হয় মহারাষ্ট্রের এক আদালতে। প্রমাণের অভাবে অভিযুক্তদের সাত জন ছাড়া পেলেও এগারো জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি হয়। তাদেরই মুক্তি দিল গুজরাত সরকার।

Advertisement

এই কারামুক্তি ঘোষণার ‘ক্রোনোলজি’ বা কালক্রম ভাল করে বুঝে নেওয়া দরকার। গুজরাত গণহত্যার বহু অপরাধের মধ্যে তিনটি ঘটনা সবচেয়ে বেশি চর্চিত। নারোদা পটিয়া গণহত্যা, গুলবার্গ সোসাইটি গণহত্যা এবং বিলকিস বানোর পরিবারের গণহত্যা। গুলবার্গ সোসাইটি গণহত্যার মামলায় সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে সচেতন নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ উঠেছিল, যা বিভিন্ন গণশুনানি ও তদন্ত রিপোর্টে বার বার উল্লিখিত হলেও আদালত কর্তৃক খারিজ হয়ে যায়। এই অভিযোগের সমীক্ষা আর্জি সর্বশেষ গত জুন মাসে সর্বোচ্চ আদালত খারিজ করে দেওয়ার পরেই ন্যায়প্রার্থী তিস্তা শেতলবাদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নারোদা পটিয়া মামলার প্রধান দুই অভিযুক্ত, প্রাক্তন বিজেপি বিধায়ক ও মন্ত্রী মায়া কোডনানি ও বজরং দল নেতা বাবু বজরঙ্গিকে দণ্ডিত করা হলেও ২০১৮ সালে গুজরাত হাই কোর্ট মায়া কোডনানিকে বেকসুর ঘোষণা করে, আর ২০১৯ সালের মার্চ মাসে অসুস্থতার ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট বাবু বজরঙ্গিকে জামিনে মুক্তি দেয়।

বিলকিস মামলার দোষীদের কারামুক্তির পর গুজরাত গণহত্যার নামজাদা অপরাধীরা প্রায় সবাই এখন জেলের বাইরে। বিপরীতে জেলে বন্দি গণহত্যার বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের যোদ্ধা পুলিশ অফিসার সঞ্জীব ভট্ট ও আর বি শ্রীকুমার; আইনজীবী ও আন্দোলনকারী তিস্তা শেতলবাদ। সরকারি প্রচারতন্ত্র অবশ্য পুরো ব্যাপারটাকেই আদালত নির্দেশিত ও আইনসম্মত বলে তুলে ধরতে চায়। গুজরাত সরকারের বক্তব্য হল, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশবলে রাজ্য সরকার এ প্রশ্নে বিবেচনা করে সমীক্ষা সমিতির সর্বসম্মত রায়ের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে এ বছর মার্চ মাসে কেন্দ্রীয় সরকার যে বিশেষ কারামুক্তি নীতি অনুযায়ী ১৫ অগস্ট ২০২২, ২৬ জানুয়ারি ২০২৩ এবং ১৫ অগস্ট ২০২৩ তিন দফায় কিছু কয়েদিকে মেয়াদ ফুরোনোর আগেই মুক্তিদানের কথা ঘোষণা করেছে, তাতেও ধর্ষণের মতো অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তিদের এই নীতির আওতার বাইরে রাখার কথা।

এ কথা তাই বুঝতে অসুবিধে নেই যে, স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর উপলক্ষে এই দণ্ডিতদের মুক্তিদানের সিদ্ধান্তটি আপাদমস্তক রাজনৈতিক। আর এত বড় একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যে কেন্দ্রীয় সরকারের অবগতি ও অনুমোদন ছাড়া হয়নি, তা-ও সহজেই অনুমান করা চলে। কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে এই সিদ্ধান্ত? অনেকেই বলছেন আসন্ন গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনের কথা। ২০০২ সালের গণহত্যার পর থেকেই যাবতীয় সমালোচনা ও বিরোধিতাকে গুজরাতের অপমান বা গুজরাত-বিরোধী কুৎসা হিসেবে চিহ্নিত করে গুজরাত গৌরবের ধ্বজা তুলে বিজেপি বার বার নির্বাচনী বৈতরণি পার করেছে। তাই আরও এক বার মুসলিমবিদ্বেষ এবং হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণের ভাবনাকে বাড়িয়ে তুলে ভোটযুদ্ধে জয়ের ছক হিসেবে এই সিদ্ধান্তকে দেখাটা অমূলক নয়।

কিন্তু স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তিতে এই ঘোষণার তাৎপর্য অবশ্যই গুজরাত নির্বাচনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সামনে ২০২৪-এর জাতীয় নির্বাচনও রয়েছে। আর ভোটের হিসাবের বাইরেও নিহিত রয়েছে এক বড় মতাদর্শগত বার্তা— এ হল হিন্দুরাষ্ট্রের আগমনবার্তা, যে হিন্দুরাষ্ট্র মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের মামলাতেও অপরাধী ও ভুক্তভোগীদের ধর্ম দেখে সিদ্ধান্ত নেবে। পীড়িতার নাম যদি বিলকিস বানো হয়, তবে তাঁর ধর্ষকদের মুক্তি দেওয়া হবে। সেই ধর্ষক যদি ব্রাহ্মণ হয়, তবে তার সংস্কারের কথা বলে তাকে অভিনন্দন জানানো হবে। হিন্দুত্বের প্রথম মতাদর্শগত প্রবক্তা সাভারকরের বক্তব্য অনুযায়ী তো হিন্দু পুরুষ দ্বারা মুসলিম নারীর ধর্ষণ এক জরুরি রাজনৈতিক হাতিয়ার, যে হাতিয়ার শিবাজির মতো হিন্দু রাজারা পরাজিত মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ব্যবহার করলে ভারতের ইতিহাস নাকি অন্য রকম হত।

হিন্দুরাষ্ট্রের ধ্বজাধারীরা বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সমাবেশী ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে কখনওই মেনে নেয়নি। সাভারকরের কাছে দেশপ্রেমের সংজ্ঞা ছিল পিতৃভূমি ও পুণ্যভূমিকে এক হতে হবে, অর্থাৎ ভারতে জন্মে যাঁরা ভারতের বাইরে উদ্ভূত কোনও ধর্মকে অবলম্বন করবেন, তাঁরা প্রথম শ্রেণির দেশপ্রেমিক এবং নাগরিক হতে পারেন না। ‘সবার এ দেশ সবার ছাড়া তো জানব না’— সলিল চৌধুরীর এই ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের বিপরীতে হিন্দুত্ববাদীদের চোখে ভারত সবার আগে হিন্দুদের। স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উঠে আসা ভারতের সংবিধান ও জাতীয় পতাকাকেও হিন্দুত্ববাদীরা মানতে অস্বীকার করেছিল। তাদের কাছে মনুস্মৃতি ছিল ভারতের ঐতিহাসিক সামাজিক বিধান এবং গেরুয়া পতাকাই ছিল একমাত্র গ্রহণযোগ্য পতাকা। গান্ধীহত্যার কারণে দেড় বছর নিষিদ্ধ থাকার পর সংবিধান ও জাতীয় পতাকাকে মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিষেধাজ্ঞামুক্ত হয়েছিল আরএসএস। আজ সংবিধানের নামে শপথ নিয়ে সরকারি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সেই মনুস্মৃতির অবস্থান থেকেই দেশ চালাতে চায় তারা।

দশ বছর আগে রাজধানীতে ধর্ষণের একটি নৃশংস ঘটনার বিরুদ্ধে উত্তাল হয়ে উঠেছিল গোটা দেশ। ধর্ষণবিরোধী আইনকে আরও শক্তিশালী করে প্রতিটি ধর্ষক যাতে শাস্তি পায়, নারীর নির্ভীক স্বাধীনতা যেন সমাজে সুনিশ্চিত হতে পারে, সেই দাবিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল আকাশ বাতাস। আজ দশ বছর পর বিলকিসের ধর্ষকদের মুক্তি নারী স্বাধীনতা ও সামাজিক পরিবর্তনের সেই আকাঙ্ক্ষাকে ক্ষমতার অহঙ্কারী অঙ্গুলিহেলনে নস্যাৎ করে দিতে চাইছে। এই চূড়ান্ত অন্যায় ও ক্ষমতার আগ্রাসী অহঙ্কারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে ভারতের জনতা কি এক স্বরে রুখে দাঁড়াতে পারবে না?

সাধারণ সম্পাদক, সিপিআই(এমএল)-লিবারেশন

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement