দুঃসহ: অউশভিৎজ়ের সংগ্রহশালায় রাখা জুতোর স্তূপ। ২৭ জানুয়ারি, ২০২৫। ছবি: রয়টার্স।
২৭ জানুয়ারি তো প্রতি বছরই আসে। চলেও যায়— এশিয়ার এই দিকটায় তেমন কোনও তাপ-উত্তাপ না ছড়িয়েই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মূল্য এশিয়াও চুকিয়েছে, ইউরোপও। ইউরোপের চড়া দাম হলোকস্ট, ডেথ ক্যাম্প, পিঁপড়ের মতো মানুষ নিধন। ‘মানুষ’ বলাটা ভুল হল, মানুষ বলে তো ভাবা হত না ওঁদের। যদি তুমি হও ইহুদি— জার্মান, ইটালিয়ান, পোলিশ, সোভিয়েট ‘জ্যু’, বা অন্য যে কোনও দেশেরই; অথবা রোমা, বা সিন্টি, কিংবা সমকামী, না হোক ছাই শারীরিক প্রতিবন্ধী, অথর্ব— মোট কথা ‘আমাদের চেয়ে আলাদা’, তা হলেই জেনো তোমার ঠিকানা ডেথ ক্যাম্প। শত্রু দেশের মানুষ হলে তো বটেই, আর যুদ্ধবন্দি, ‘প্রিজ়নার অব ওয়র’ হলে তো কথাই নেই। একে একে মাথা তুলল কত ক্যাম্প: রাভেনসব্রাক, বের্গেন-বেলসেন, আর জার্মানির দখল করা পোল্যান্ডে অউশভিৎজ়-বার্কেনাউ— সবচেয়ে কুখ্যাত। হিসাব বলছে, শুধু এই এক কনসেনট্রেশন তথা এক্সটার্মিনেশন ক্যাম্পেই মারা হয়েছে এগারো লক্ষ মানুষকে। গণহত্যা তো কম হয়নি পৃথিবীতে, কিন্তু একটা চৌহদ্দির মধ্যে যে এত, এত মানুষকে মেরে ফেলা যায়, এমনটা পৃথিবী আর দেখেনি।
বিশ্বের বৃহত্তম গণহত্যার ‘সাইট’ সেই অউশভিৎজ়-এর ‘স্বাধীনতা দিবস’ই চলে গেল ক’দিন আগে, ২৭ জানুয়ারি। ১৯৪৫-এর এই দিনে রেড আর্মি মুক্ত করেছিল অউশভিৎজ়, আশি বছর পূর্ণ হল সেই স্বাধীনতার। অউশভিৎজ় এখন এক স্মৃতি-সংগ্রহশালা ও আর্কাইভ, সারা বিশ্বের মানুষ দেখতে আসেন বছরভর। ক্যাম্পে ঢোকার মুখে গেটে খোদাই করা, ‘আর্বেইট মাখ্ত ফ্রেই’, ‘কর্মেই তোমার মুক্তি’। শুরু থেকেই প্রতারণা। বন্দি যখন, গায়ে গতরে খাটো, মুক্তি মিলবে ঠিক। অউশভিৎজ়ের প্রহরীরা বন্দিদের দেখাত চিমনির ধোঁয়া, আর নিষ্ঠুর হাসত: মুক্তি আসলে ওইখানটায়, মরে তবে মুক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই গেট দিয়ে ঢুকেছেন অগণিত মানুষ, হাতে গোনা ক’জন ছাড়া কেউ বেরোতে পারেননি। সেই তোরণের কাছেই এ বছরের অনুষ্ঠানে মোমবাতি জ্বাললেন তাবড় অতিথিরা, কুখ্যাত ‘ডেথ ওয়াল’-এ ছোঁয়ালেন ফুল।
কে আসেননি! ইংল্যান্ডের রাজা চার্লস। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট, স্পেন নেদারল্যান্ডস ডেনমার্কের রাজা-রানি। কানাডার জাস্টিন ট্রুডো, ইউক্রেন থেকে ভলোদিমির জ়েলেনস্কি। জার্মানি-সহ ইউরোপের আরও দেশের তাবড় লোকজন, পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী তো ছিলেনই। কিন্তু অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা যাঁরা, সেই অউশভিৎজ় মেমোরিয়াল-এর তরফে বলে দেওয়া হয়েছিল, আপনারা আসুন, কিন্তু কিছু বলবেন না প্লিজ়। আজ আপনাদের বলার দিন নয়, শোনার দিন। আপনারা শুধু শুনবেন।
তা হলে বলবেন কারা? অউশভিৎজ় পেরিয়ে এসেছেন যাঁরা, তাঁরা। ‘সারভাইভার’ শব্দটার জুতসই বাংলা প্রতিশব্দ নেই, এক দিক থেকে ভাল। ইংরেজি শব্দটার মধ্যে কেমন হীনতা মাখা। কিন্তু অউশভিৎজ়-অতিক্রমীরা তো হীন নন, তাঁরা বীর, বীরশ্রেষ্ঠ। বেঁচে থেকে তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, বেঁচে থাকাটাই মানুষের সবচেয়ে বড় কাজ এই পৃথিবীতে। টোভা ফ্রিডমান, এখন ছিয়াশি বছরের বৃদ্ধা— অউশভিৎজ়ের কনিষ্ঠ সারভাইভারদের এক জন— বলেছেন, চোখের সামনে, পাশে, পিছনে মৃত্যুর ছায়া, ভাবতে পারেন কেউ কখনও? শীত এসেছে, বরফের উপর খালি পায়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ছোট ছোট মেয়েদের, গ্যাস চেম্বারের দিকে: কেউ টলমল-পা, কেউ পাঁচ, আট, দশ, বারো। একটা করে দিন যেত, টোভা ভাবতেন, আমিই নির্ঘাত পৃথিবীতে একমাত্র জ্যু শিশু, যে বেঁচে আছি এখনও!
টোভা ফ্রিডমান, মারিয়ান টারস্কি, ইয়ানিনা ইওয়ানস্কা, লেয়ন ওয়েনট্রবরাই বলেছেন এ দিন। শুনেছে সারা বিশ্ব। শুনেছেন নেতারা, এক-একটা দেশ-মহাদেশের নীতিনিয়ন্তা-ভাগ্যবিধাতারা। এই বীরশ্রেষ্ঠরা এখন কেউ ছিয়াশি, চুরানব্বই, আটানব্বই, একশো বছর ছুঁই-ছুঁই। দিন দিন এঁদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ২০১৫-য় একশো কুড়ির বেশি অউশভিৎজ়-অতিক্রমী বেঁচে ছিলেন, গত কয়েক বছরে মারা গিয়েছেন অনেকে। লিলি এবার্টকে চেনেন? মাত্র মাস চারেক আগে, ২০২৪-এর ৯ অক্টোবর একশো বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন অউশভিৎজ়-এর বীরাঙ্গনা, এই গ্রহের মাটিতে লেখা শ্রেষ্ঠ স্মৃতিগ্রন্থগুলির একটি, লিলি’জ় প্রমিস-এর লেখিকা। লিলিরা চলে যাচ্ছেন দ্রুত। ওঁদের অনেকে লিখে রেখেছেন অউশভিৎজ়ের কথা। বেঁচে থাকার দর্শন। আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি-র পাশাপাশি লিলি’জ় প্রমিস, ভিক্টর ফ্রাঙ্কলের ম্যান’স সার্চ ফর মিনিং বা প্রিমো লেভি-র ইফ দিস ইজ় আ ম্যান আর দ্য পিরিয়ডিক টেবল-এর মতো বইয়ের সামনে রোজ নতজানু হওয়া দরকার আজকের পৃথিবীর।
বই তো রইলই। বইয়ের সবচেয়ে বড় গুণ, সে ভুলতে দেয় না। আজকের মানবসভ্যতার সবচেয়ে বড় রোগ বিস্মৃতি: ভুলে যাওয়া, কিংবা ভুলিয়ে দেওয়া। অউশভিৎজ়-ফেরত ওঁরা সবাই একটাই কথা বলে যাচ্ছেন অবিরত: যেন ভুলে না যাই কী হয়েছিল মানুষের সঙ্গে, যেন মনে রাখি মানুষ কী ভাবে, কত রকম ভাবে মানুষকে ঘৃণা করতে পারে, না-মানুষ ভাবতে পারে, উদ্ভাবন করতে পারে মেরে ফেলার নিত্যনতুন ছল ও কল। আবার, কত নিষ্ঠুর কায়দায় মানুষ মানুষকে মারে, শুধু সেটুকু মনে রাখার জন্যই অউশভিৎজ়কে মনে রাখা প্রয়োজন নয়। এই কারণেই আরও মনে রাখা প্রয়োজন— যারা মেরেছিল, তারও বেশি, অনেক বেশি সংখ্যার মানুষ সমর্থন করেছিল, বলেছিল হ্যাঁ, মারো, মেরে ফেলো ওদের। বিপুল সংখ্যক মানুষ মুখে বলেনি কিন্তু মনে মনে চেয়েছিল মরে যাক ওরা; আরও বিপুল সংখ্যক মানুষ হয়তো মুখেও বলেনি, মনে মনেও চায়নি, কিন্তু নীরব থেকেছিল।
চেনা-চেনা লাগছে? মনে হচ্ছে কি— ঘরে-বাইরে, কাছে-দূরে অউশভিৎজ়ের প্রলম্বিত ছায়ার এক খণ্ড থাকলেও থাকতে পারে? হয়তো তার (ছদ্ম)বেশটি অন্য, কিন্তু বয়ান একই। তুমি অন্য ধর্ম, অন্য জাত, অন্য লিঙ্গ, এমন সব ‘অন্য’ সত্তাকে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে তুমি হয়ে উঠেছ অপরস্য অপর— তোমার অধিকার নেই আমার মাটিতে থাকার, আমার বাতাসে শ্বাস নেওয়ার: তুমি মরো। এ দেশে জন্মালেও তুমি এ দেশের নও, চলে যাও তোমার ‘ভাই-বেরাদর’দের দেশে, নয়তো যাও আজীবন অশান্তি ভোগ করো, বাঁচো মৃত্যুভয়ে, ঠিকানা হোক ডিটেনশন সেন্টার। বিশ্বের নেতাদের সামনে অউশভিৎজ়ের বীররা বলেছেন, ১৯৩০-এর ইউরোপ গোড়ায় নাৎসিবাদকে আমল দেয়নি, ভেবেছিল এ বুঝি স্রেফ একটা পার্টির দলীয় মতাদর্শের ঝনঝনানি— পরে কী হয়েছিল তা সবার জানা। আজকের ইউরোপে দেশে দেশে ফের নব্য-নাৎসিবাদের স্লোগান আর উন্মাদনা, এক অউশভিৎজ় থেকে শিক্ষা হল না তবে?
ইতিহাসেরও কী নিদারুণ ঠাট্টা! ‘ইহুদিদের দেশ’ ইজ়রায়েল আর অউশভিৎজ়ের মুক্তি-সেনার দেশ রাশিয়া, দুই-ই অনুপস্থিত ছিল ২৭ জানুয়ারির অনুষ্ঠানে। কারণ তো জানা-ই: গাজ়া আর ইউক্রেনের যুদ্ধে ওরাই তো কাঠগড়ায়। একদা আক্রান্ত, এখন আক্রমণকারী। অউশভিৎজ়কে ভুলব না যেমন, তেমনই এ-ও মনে রাখব। এটুকু আমরা করতে পারি: স্মৃতিধার্য রাখতে পারি অতীত থেকে বর্তমান সবটা। সেই স্মৃতি হয়তো যন্ত্রণা দেবে, অস্বস্তি জাগাবে, অসহ্য মনে হবে, কিন্তু সে-ই আবার পথ দেখাবে। স্মৃতিই জীবন-অভিজ্ঞতার, মানুষের ইতিহাসের ‘পয়েন্ট অব রেফারেন্স’— যেন ভুলে না যাই।