লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই রাহুল গান্ধী একটি কথা বলতে শুরু করেছেন। আমেরিকা সফরে গিয়েও তিনি এই কথাটি বলে এসেছেন। হরিয়ানা, জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারেও তিনি রোজ একই কথা বলছেন।
কী কথা?
নরেন্দ্র মোদীর ‘ভাবমূর্তি’ এখন ‘ইতিহাস’। এই যে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি, ভগবানের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ, নিজেকে ঈশ্বরপ্রেরিত দূত হিসাবে তুলে ধরা, তা এখন উধাও। ও-সব এখন ইতিহাস। রাহুল গান্ধী দাবি করছেন, তিনি সংসদে প্রধানমন্ত্রী মোদীর ঠিক উল্টো দিকে লোকসভার বিরোধী দলনেতার আসনে বসে তা টের পাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের তিন-চার জন শীর্ষ মন্ত্রী তা বুঝতে পারছেন। মোদী সরকারের শরিকরাও ব্যাপারটা বুঝে গিয়েছেন। কারণ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এ বার একার জোরে সরকার গড়ার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ‘অব কি বার, চারশো পার’-এর লক্ষ্য নিয়ে নেমে বিজেপি ২৪০-এ আটকে গিয়েছে। সরকার গড়তে হয়েছে শরিক দলের দাক্ষিণ্যে।
নরেন্দ্র মোদীর সবচেয়ে প্রিয় বস্তু হল তাঁর ‘নরেন্দ্র মোদী’ নামক ভাবমূর্তি। দীর্ঘ দিন ধরে অতি যত্নে তা গড়ে তোলা হয়েছে। ইংরেজিতে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ বলে যে কথাটি রয়েছে, তা প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তির ক্ষেত্রে একেবারে সুপ্রযুক্ত। রাহুল গান্ধী তথা বিরোধী শিবির ঠিক সেই ভাবমূর্তিতেই আঘাত করতে চাইছেন। এই লক্ষ্যেই অরবিন্দ কেজরীওয়াল আরএসএসের সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতকে চিঠি লিখে প্রশ্ন তুলছেন, আগামী বছর নরেন্দ্র মোদী পঁচাত্তর বছর পূর্ণ করলে তাঁকে রাজনৈতিক অবসর নিতে বাধ্য করা হবে তো? কেজরীওয়াল বার্তা দিতে চাইছেন, মোদীর চাবিকাঠি এখন ফের আরএসএসের হাতে।
এই আক্রমণ থেকে নিজের ভাবমূর্তিকে বাঁচাতে নরেন্দ্র মোদীর সামনে একটাই রাস্তা খোলা ছিল। তা হল, তিনি নিজের লক্ষ্যে স্থির রয়েছেন, তিনি নিজের কর্মসূচি থেকে সরেননি, তা জনগণের সামনে তুলে ধরা। তাঁকে প্রমাণ করতে হত, যতই বিজেপির আসনসংখ্যা ২৪০-এ নেমে গিয়ে থাকুক, যতই তাঁর সরকার শরিক-নির্ভর হয়ে পড়ুক, তা সত্ত্বেও বিজেপি নিজের নির্বাচনী ইস্তাহার থেকে সরছে না।
এই যে মোদী সরকার আচমকা ‘এক দেশ, এক ভোট’ ঝুলি থেকে বার করে আনল, তার পিছনে আসল উদ্দেশ্য সেটাই। এ হল প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজের প্রতিজ্ঞায় অবিচল তা প্রমাণ করে বিরোধীদের নিশানা থেকে নিজের ভাবমূর্তিকে বাঁচানোর রাজনৈতিক বর্ম। ‘এক দেশ, এক ভোট’-এর নীতি নিয়ে লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গেই সমস্ত রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন করানোর পক্ষে নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই সওয়াল করছেন। গত তিনটি নির্বাচনেই বিজেপির ইস্তাহারে তা ছিল। তাঁর নিজস্ব ভাবমূর্তির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে নরেন্দ্র মোদী বরাবরই এমন বড় মাপের সংস্কারের পক্ষে। যা ইতিহাসে তাঁর অবদান হিসাবে থেকে যাবে। ‘এক দেশ, এক ভোট’ সেই ভাবনারই অন্যতম ফসল।
মুশকিল হল, ‘এক দেশ, এক ভোট’ নিয়ে মোদী সরকার যদি এখন মাঠে নামেও, তা হলে ২০৩৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে রাজ্যগুলির বিধানসভা নির্বাচন এক সঙ্গে হতে পারে। কিন্তু তার জন্য মোদী সরকারকে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। লোকসভার সঙ্গে বিধানসভার নির্বাচন এক সঙ্গে করানো এবং লোকসভা-বিধানসভার সঙ্গে পুর ও পঞ্চায়েত ভোট এক সঙ্গে করানোর জন্য অন্তত দু’টি সংবিধান সংশোধনী বিল মোদী সরকারকে সংসদে পাশ করাতে হবে।
সংবিধানের ৩৬৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংবিধান সংশোধনী বিল পাশ করাতে হলে শুধু লোকসভা ও রাজ্যসভার সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন থাকলে হবে না, বিল পাশ করার সময় যাঁরা সংসদে উপস্থিত থেকে ভোট দেবেন, তাঁদের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থনও প্রয়োজন হবে। লোকসভার ৫৪৩ জন সাংসদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের অর্থ ৩৬২ জনের সমর্থন। নরেন্দ্র মোদী হয়তো এই কারণেই লোকসভা ভোটে ‘চারশো পার’-এর লক্ষ্য স্থির করেছিলেন। কিন্তু তা হয়নি। বিজেপি ও শরিক দল মিলিয়ে এনডিএ-র হাতে ২৯৩ জন সাংসদ রয়েছে। বিরোধী জোট ইন্ডিয়া-র কোনও দল ‘এক দেশ, এক ভোট’-এর নীতিকে সমর্থন করছে না। যদি ওয়াইএসআর কংগ্রেস, শিরোমণি অকালি দলের মতো এনডিএ-র বাইরের দলগুলি ভোট দেয়, তা হলেও এনডিএ ৩৬২-তে পৌঁছতে পারবে না। একই অবস্থা রাজ্যসভাতেও। সংবিধান সংশোধনী বিল পাশ করাতে হলে রাজ্যসভার ২৪৫ জন সাংসদের মধ্যে ১৬২ জনের সমর্থন প্রয়োজন। কিন্তু এনডিএ-র হাতে ছ’জন মনোনীত সাংসদ-সহ মাত্র ১২১ জন সাংসদ রয়েছেন। তা হলে কী ভাবে সংবিধান সংশোধন হবে, তার উত্তর মোদী সরকারের কাছে নেই।
এখানেই শেষ নয়। ২০২১ সালে যে জনগণনা হওয়ার কথা ছিল, তা এখনও হয়নি। জনগণনা হলে নতুন জনসংখ্যা অনুযায়ী ২০২৬-এ আসন পুনর্বিন্যাসের কাজ হওয়ার কথা। তাতে লোকসভার আসন সংখ্যা ৫৪৩ থেকে বেড়ে সাড়ে সাতশোর উপরে চলে যাবে। নতুন জনসংখ্যা অনুযায়ী লোকসভায় দক্ষিণের রাজ্যগুলির প্রতিনিধিত্বের অনুপাতে হিন্দি বলয়ের প্রতিনিধিত্ব বেড়ে যেতে পারে। তখন উত্তর ভারত বনাম দক্ষিণ ভারতের বিবাদ কী ভাবে সামলানো যেতে পারে, তার উত্তর বিজেপির কাছে নেই।
প্রধানমন্ত্রী বরাবরই যুক্তি দিয়েছেন, প্রতি বছরই কোনও না কোনও রাজ্যের নির্বাচন থাকায় নির্বাচনের আদর্শ আচরণবিধির ফলে কাজকর্ম ব্যাহত হয়। দেশের কাজের বদলে সবাই প্রচারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। লোকসভার সঙ্গেই বিধানসভা নির্বাচন হলে বিপুল অর্থ সাশ্রয় হবে। কিন্তু তার পরিমাণ কত, কোনও দিনই উত্তর মেলেনি। বিরোধীদের দাবি, নরেন্দ্র মোদী নিজেই প্রধানমন্ত্রী হয়েও পুরসভা থেকে পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপিকে জেতাতে মাঠে নেমে পড়েন। আর কাজ আটকে থাকার যুক্তি খাটে না। কারণ কোনও রাজ্যে ভোট থাকলে মোদী নিজে সেই রাজ্যে ছয় মাস আগে থেকে গিয়ে নানা প্রকল্পের শিলান্যাস, উদ্বোধন করতে থাকেন।
২০১৪-য় যখন নরেন্দ্র মোদী প্রথম ‘এক দেশ, এক ভোট’-এর কথা বলেন, তখন দেশে ‘মোদী ঝড়’ বইছে। বিরোধীদের ধারণা ছিল, মোদী আসলে লোকসভা ভোটের সঙ্গে সমস্ত রাজ্যের বিধানসভা ভোট করিয়ে সেই ‘মোদী ঝড়’-এ সিংহভাগ রাজ্যে বিজেপিকে ক্ষমতায় আনতে চাইছেন। কিন্তু যত সময় এগিয়েছে, দেখা গিয়েছে, ‘মোদী ম্যাজিক’ লোকসভা ভোটে কাজ করলেও রাজ্যের ভোটে কাজ করছে না। আর ২০২৪-এর লোকসভা ভোট প্রমাণ করেছে, ‘মোদীর গ্যারান্টি’-ও ‘মোদী ম্যাজিক’-এর নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।
এতৎসত্ত্বেও ‘এক দেশ, এক ভোট’ নিয়ে মাঠে নেমে মোদী প্রমাণ করতে চাইছেন, ভোটের ফলে তিনি টোল খাননি। তিনি দেশের স্বার্থে সূদূরপ্রসারী লাভের জন্য কাজ করে যেতে চান। আর একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হল, তাঁর এই কর্মসূচির বিরোধিতাতেই বিরোধী শিবিরকে ব্যস্ত রাখা। বিরোধী শিবির নিজে কোনও বিষয় তুলে আনবে, সরকারকে জবাব দিতে হবে— এই পরিস্থিতির থেকে যে কোনও সরকারই চায়, বিরোধীরা সরকারের কর্মসূচি নিয়ে বিতর্ক, বিরোধিতায় ব্যস্ত থাকবেন। সরকার কর্মসূচির পক্ষে সওয়াল করতে থাকবে। লোকসভা ভোটে বিজেপি ধাক্কা খাওয়ার পর থেকে বিরোধীরাই বিতর্কের দিশা ঠিক করে দিচ্ছিলেন। এখন মোদী ‘এক দেশ এক ভোট’ এনে রাজনৈতিক বিতর্কের দিশা ঠিক করতে চাইছেন।
পারবেন কি? জম্মু-কাশ্মীর, হরিয়ানা নির্বাচন চলছে। এর পরে মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড ও দিল্লির ভোট। এর মধ্যে হরিয়ানা, দিল্লি ও মহারাষ্ট্রে যদি বিজেপি ধাক্কা খায়, তা হলে রাহুল গান্ধীরা ফের মোদীর ভাবমূর্তিকে নিশানা করার সুযোগ পেয়ে যাবেন। বিজেপির অন্দরেও তেমনই আশঙ্কা। মোদীকে কি তখন নতুন রাজনৈতিক বর্মের সন্ধান করতে হবে?