Angela Merkel

শিখরেই যাঁর শেষের শুরু

ফ্রান্সে মেরিন ল্য পেঁ-র শক্তি বেড়েছে এর ফলে, এমনকি অতলান্তিকের ওপারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনেও এর প্রভাব দেখেছেন বিশেষজ্ঞরা।

Advertisement

অতনু বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২১ ০৭:২৩
Share:

শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার অলিন্দ থেকে সরে দাঁড়ালেন আঙ্গেলা ম্যার্কেল। তিন দশকের রাজনৈতিক-জীবনের শেষ ১৬ বছর চ্যান্সেলর থাকার পর ম্যার্কেলের এই বিদায়ের পরিপ্রেক্ষিতে অভিজাত বিজ্ঞান-পত্রিকা নেচার বলেছে, ম্যার্কেল-হীন রাজনীতি না কি হয়ে যাবে ‘গরিব’। কোনও রাষ্ট্রপ্রধানের বিদায়বেলায় বিজ্ঞান-পত্রিকা এ ভাবে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছে, এমন ঘটনা দুর্লভ। অবশ্য ম্যার্কেলের মতো রাষ্ট্রনেতাও আসেন না রোজ রোজ। মনে পড়ে ২০১৫ সালের কথা, যখন সিরিয়া থেকে বিপন্ন উদ্বাস্তুর ঢল নেমেছে দুনিয়ায়, আর প্রকৃত অর্থেই ‘ভূত’ দেখেছে ইউরোপ। ‘ইউরোপ কী ভাবে হাজার হাজার শরণার্থীকে জায়গা দেবে’ এ কথা ভেবে খ্রিস্টান ইউরোপ আর শ্বেতাঙ্গ সমাজ থেকে বিচ্যুত হওয়ার প্রবল ভয়ে অস্থির নেতৃবর্গ। সকলে যখন নিজের নিজের সীমান্ত আটকাতে ব্যগ্র, সেই সময়ে উদ্বাস্তুদের জন্য জার্মানির সীমান্ত খুলে দিলেন ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির অধীশ্বরী আঙ্গেলা ম্যার্কেল। নিঃসন্দেহে তাঁর জীবনের সব চাইতে বড় সিদ্ধান্ত এটাই। ম্যার্কেলের উচ্চারণে ‘উই ক্যান ডু ইট’ এখন পরিণত হয়েছে প্রবাদে।

Advertisement

ওই বছরেই তিনি— তিন দশকের মধ্যে প্রথম বার কোনও মহিলা— টাইম ম্যাগাজ়িনের ‘পার্সন অব দ্য ইয়ার’ হওয়ার পিছনে তাঁর দুনিয়া-কাঁপানো উদ্বাস্তু-নীতির অবশ্যই একটা বড়সড় ভূমিকা ছিল। তবে সেটাই হয়তো শেষের শুরু। এর ফলে আজকের জার্মানিতে নিরাপত্তাহীনতার তীব্র আশঙ্কার চোরাস্রোত বইছে, এমন বলেন অনেকেই। মনে করছেন, কয়েক দশকের মধ্যেই হয়তো বদলে যেতে পারে জার্মানির জনবিন্যাস, তার খ্রিস্টান চরিত্র, তার শ্বেতাঙ্গ রূপরেখা— জার্মানদের কথ্য ভাষা, উচ্চারণ, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক রীতিনীতি, উৎসব, সংস্কৃতি, এমনকি জাতিগত দৃঢ়তাও। ইউরোপের অবাধ সীমান্ত পেরিয়ে এই পরিবর্তিত রূপ-বৈচিত্র ডানা ছড়াতে পারে অন্য দেশের ভূখণ্ডেও?

উদ্বাস্তুদের নিয়ে এই প্রবল টানাপড়েন জার্মান জনতার সঙ্গে ‘ফ্রাও’ ম্যার্কেলের সম্পর্কও বদলে দিয়েছে। ২০১৩ সালে তৈরি হয় ‘অল্টারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড’ বা ‘এএফডি’ নামে অতি-দক্ষিণপন্থী, সোশ্যাল মিডিয়া-নির্ভর, তীব্র অভিবাসী-বিরোধী দলটি। ২০১৭-র নির্বাচনে বুন্ডেস্টাগে ৯৪টি আসন পায় ‘এএফডি’। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে অতি-দক্ষিণপন্থীদের এমন রমরমা দেখেনি জার্মানি। জার্মানির পুবে ‘এএফডি’-র জনসমর্থন যথেষ্ট, দ্য গার্ডিয়ান যাকে বলেছে ‘পূর্বের প্রতিশোধ’। যেন দেশের অভ্যন্তরে ঘুমিয়ে থাকা নিয়ো-নাৎসি দৈত্যকে জাগিয়ে তুলেছেন ম্যার্কেল।

Advertisement

‘লেবেনশ্রাম’ অর্থাৎ জার্মানদের ‘থাকবার জায়গা’ বাড়াতে মরিয়া ছিলেন হিটলার। সম্পূর্ণ উল্টো পথে ম্যার্কেলের এই উদ্বাস্তু-নীতি কি আট দশক আগেকার নাৎসি জার্মানি আর তার হলোকাস্টের ঐতিহ্যের পাপমোচন? ওয়েল্ট অ্যাম সোনট্যাগ-এর সাংবাদিক রবিন আলেকজ়ান্ডারের ২০১৭-র রাজনৈতিক থ্রিলার ডি গেট্রিবেনেন আলোচনা করেছে উদ্বাস্তুদের জন্য ম্যার্কেলের জার্মানির সীমান্ত খোলার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা আর নীতির। আলেকজ়ান্ডারের বইতে ম্যার্কেল যেমন সন্ন্যাসিনী নায়িকা নন, নন খলনায়িকাও। আলেকজ়ান্ডার মনে করেছেন, জার্মানি উদ্বাস্তু সমস্যাকে ঠেলে দিয়েছে ইউরোপের সীমান্তে। যা প্রকারান্তরে জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জুড়ে, এমনকি ক্ষমতাশালী করেছে তুরস্কের কর্তৃত্ববাদী প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়েপ এর্ডোগান-কেও।

ম্যার্কেলের উদ্বাস্তু-সিদ্ধান্ত প্রভাব ফেলেছে ব্রেক্সিট ভোটে। প্রতিবেশী ফ্রান্সে অতি-দক্ষিণপন্থী মেরিন ল্য পেঁ-র শক্তি বেড়েছে এর ফলে, এমনকি অতলান্তিকের ওপারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনেও এর প্রভাব দেখেছেন বিশেষজ্ঞরা। এবং প্রকৃত অর্থেই অগণিত সিরিয়ান শরণার্থীর জন্য জার্মানির দরজা খোলার সাহসী সিদ্ধান্ত ম্যার্কেলের নিজের কাছেও ছিল এক বিরাট রাজনৈতিক ঝুঁকি। এর পিছনে আবেগ কিংবা রাজনৈতিক অঙ্ক যা-ই থাকুক, বিশ্বজোড়া উদ্বাস্তু সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যে দুঃসাহস দেখিয়েছেন ম্যার্কেল, তার দামও বড় কম দিতে হয়নি তাঁকে। ভেবে দেখলে, তাঁর আজকের রাজনৈতিক বানপ্রস্থের পিছনেও রয়েছে সে দিনের সেই বরাভয়-দাত্রী রূপ। ২০১৭-র নির্বাচনে কোনওক্রমে জিতলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এতটা কম জনসমর্থন কখনও জোটেনি ম্যার্কেলের দল মধ্য-দক্ষিণপন্থী ‘ক্রিশ্চান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন’-এর। জার্মান দৈনিক বিল্ড একে বলেছে ‘দুঃস্বপ্নের জয়’। রাজনৈতিক প্রভাব বেড়েছে বাম-ঘেঁষা গ্রিন পার্টিরও। ২০১৮-র আঞ্চলিক ভোট আরও বড় ধাক্কা ম্যার্কেলের দলের কাছে। চ্যান্সেলর এবং পার্টির নেতা হিসাবে অবশ্য দায়ভার স্বীকারে অকুণ্ঠ তিনি। ঘোষণা করলেন, তিনি আর চ্যান্সেলরের দৌড়ে থাকছেন না ২০২১-এ। দলের নেতৃত্বেও নয়।

অতি-সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসেছেন আঙ্গেলা ম্যার্কেল। ঊননব্বইয়ের বার্লিনের দেওয়াল ভাঙা আরও অনেকের মতো বদলে দিয়েছে ম্যার্কেলেরও জীবনপ্রবাহ। পূর্ব জার্মানির কমিউনিজ়মের আবহে তাঁর বড় হয়ে ওঠা, রাজনৈতিক জীবনে এক বছর সময়ের মধ্যে লিফলেট বিলি করা থেকে হেলমুট কোলের ক্যাবিনেটে স্থান পাওয়া, পুরোটাই যেন আধুনিক কালের গ্রিমের রূপকথা। ইউক্রেন নিয়ে পুতিনের সঙ্গে আলাপচারিতায় পশ্চিমি দুনিয়ার প্রতিনিধি সেই ম্যার্কেল। তিনি হয়ে ওঠেন ইউরোপের রানি।

দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে নিরপেক্ষ, সহমত তৈরির নেতৃত্ব বা ‘ম্যার্কেলিজ়ম’ দেখে-আসা ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও যেন ধূসর দেখাচ্ছে এখন। ম্যার্কেল-পরবর্তী জার্মানির পক্ষে ইইউ-তে নেতৃত্ব দেওয়ার কাজটা যে সহজ নয়, বলা বাহুল্য।

কেমন হবে এই শরণার্থীদের বেঁচে থাকা ম্যার্কেল-উত্তর জার্মানিতে? উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই এ মুহূর্তে।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement